সত্য শব্দটিকে রহস্যীকরণের কাজে তিনি কতোভাবে ব্যবহার করেছেন, তার কয়েকটি উদাহরণ দিই। ধর্ম বইটির একটি প্ৰবন্ধ থেকে :
১. সংসারে প্রতিদিন আমরা যে সত্যকে স্বার্থের বিক্ষিপ্ততায় ভুলিয়া থাকি উৎসবের বিশেষ দিনে সেই অখণ্ড সত্যকে স্বীকার করিবার দিন (উৎসব, ধর্ম, রবীন্দ্র-রচনাবলী, ১৩, বিশ্বভারতী, ১৯৬৭, ৩৩৫)
২. বস্তৃত বিশ্বের সকল জিনিসকেই আমরা যখন বিচ্ছিন্ন করিয়া দেখি, তখনই এই সত্যকে আমরা দেখিতে পাই না (উৎসব, ওই, ৩৩৫)।
৩. মিলনের মধ্যে যে সত্য তাহা কেবল বিজ্ঞান নহে, তাহা আনন্দ (উৎসব, ওই, ৩৩৫)।
৪. আমরা সত্যকে যে-পরিমাণে উপলব্ধি করি, তাহার জন্য সেই পরিমাণে মূল্য দিতে পারি (উৎসব, ওই, ৩৩৬)।
৫. সত্য প্রেমরূপে আমাদের অন্তঃকরণে আবির্ভূত হইলেই সত্যের সম্পূর্ণ বিকাশ হয় (উৎসব, ওই, ৩৩৬)।
৬. তাই বলিতেছি, আনন্দ হইতেই সত্যের প্রকাশ এবং সত্যের প্রকাশ হইতেই আনন্দ (উৎসব, ওই, ৩৩৭)।
সত্য শব্দটি উদ্ধৃতিগুলােতে নিরর্থক, যদিও রবীন্দ্রনাথের অত্যন্ত প্রিয় শব্দ এটি, শব্দটি সুস্পষ্ট কোনো বোধ প্রকাশ না ক’রে করছে রহস্টীকরণ; আর শেষ উদ্ধৃতির বক্তব্য তাঁর নিজেরও নয়, যদিও এটি তার খুবই প্রিয়, জীবনে বহুবার নানা রূপে এটি প্রকাশ করেছেন তিনি; কীটসের বিখ্যাত ‘Beauty is truth, truth beauty’- কে একটু রূপান্তরিত করেছেন, ‘সুন্দর” বা ‘সৌন্দৰ্য’-এর বদলে ব্যবহার করেছেন ‘আনন্দ ; বলতে পারতেন ‘আনন্দই সত্য, সত্যই আনন্দ ; কিন্তু দুটিকে অভিন্ন না ক’রে করেছেন পরস্পরের উৎস। রহস্যীকরণের কাজ তিনি অজস্ররূপে করেছেন; বাস্তবকে বাস্তবরূপে, পরিচিত মূর্ত বস্তুকে মূর্ত বস্তুরূপে না দেখে রহস্যের প্ৰকাশরুপে দেখতেই তার ভালো লাগতো। শক্তিনিকেতন বইটির প্রথম প্রবন্ধের প্রথম পংক্তিতেই পাই :
উত্তিষ্ঠত, জাগ্ৰত! সকাল বেলায় তো ঈশ্বরের আলো আপনি এসে আমাদের ঘুম ভাঙিয়ে দেয়-সমস্ত রাত্রির গভীর নিদ্রা একমুহুর্তেই ভেঙে যায় (উক্তিষ্ঠিত জাগ্রত, রবীন্দ্র-রচনাবলী, ১৩, বিশ্বভারতী, ১৯৬৭, ৪৪৯)।
বেশ ভালো লাগে পড়তে, একটুখানি অপার্থিব আবেগেও আক্রান্ত হই, মনে হয় বেশ একটা রমণীয় রহস্যলোকের মধ্যে পড়ে আছি, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে সকাল বেলার ওই আলো ঈশ্বরের আলো’ কেনো? এ-আলো হ’তে পারতো শুধুই “আলো’, বা “সূর্যের আলো”; “ঈশ্বরের আলো’ বলার সাথে সাথে আমাদের পরিচিত রোদ রহস্যময় বস্তুতে পরিণত হয়, রহস্যীকরণ ঘটতে থাকে দিকে দিকে। সূর্যের আলোকে তিনি সূর্যের আলো ব’লে মানতে পারেন না, তার মন ভরে ওঠে না। হয়তো, তিনি ওই আলোতে তাঁর বিশ্বাসের ছোয়া চান, বস্তুজগতকে রঙিন রহস্যময় ক’রে তুলতে চান তাঁর বিশ্বাস দিয়ে। এমন কাজ পৃথিবী জুড়েই করেছেন বিশ্বাসীরা, যাঁদের অনেকে ভুগেছেন বিশ্বাসের প্রচণ্ড দুরারোগ্য উন্মত্ততায়, যেমন ভুগেছেন অনেক অতীন্দ্ৰিয় উন্মাদ, বা উইলিয়ম ব্লেইক, যার কাছে ভোরের তরুণ তরুণকে অরুণ মনে হয় নি, মনে হয়েছে দেবদূতরা দলেদলে স্তব করছে পরমেশ্বরের। আমরা জানি সূর্যের আলো ঈশ্বরের আলো নয়, এটা নিরন্তর জ্বলন্ত গ্যাসের কাজ, আর ভোরের সূর্যে দেবদূতরাও স্তবগান করে না, ওই ঈশ্বর আর তাঁর দেবদূতরা অবাস্তব অলীক কল্পনামাত্র। পুরোনো প্যালেস্টাইন বা পুরোনো ভারতের সত্যুদ্রষ্টারা আজ হঠাৎ এসে টেলিভিশন, বিমান, নিয়ন আলো দেখলে এগুলোও তাদের মনে হবে ঈশ্বরের মহিমার প্রকাশ; এবং অনুপ্রাণিত হয়ে রচনা ক’রে ফেলবেন নানা রকমের বেদ ও সংহিতা।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানের যেগুলোকে বলেছেন ‘পূজা’, সেগুলোতে বিশ্বজগতের রহস্যীকরণপ্রক্রিয়া নিয়েছে চূড়ান্ত রূপ: ধর্মপ্রবর্তক বা প্রচারকের মতো তিনি কাজ করেন নি, কবি তিনি এবং তাদের থেকে বহু দূরবর্তী, তাদের মতো তার হাতে শেকল নেই, মানুষকে বন্দী করার জন্যে তিনি বেরিয়ে পড়েন নি, মানুষকে তিনি করতে চেয়েছেন মুক্ত, কিন্তু অলীক পরমসত্তায় বিশ্বাস আলোবাতাসের মতো এগুলোতে কাজ ক’রে চলছে। এগুলো দাঁড়িয়ে আছে বিশ্বাসের ভিত্তির ওপর; এগুলো উপভোগ করার জন্যে বেশ খানিকটা বিশ্বাস দরকার। তবে বিশ্বাস করেন। না। যারা, পরমসত্তা যাদের কাছে হাস্যকর, তাঁরা এগুলো কীভাবে উপভোগ করেন, বা আদৌ কি উপভোগ করেন? রবীন্দ্রনাথের প্রভু বা পরমসত্তায় বিশ্বাস হাস্যকর আমার কাছে, তবে আমি উপভোগ করি এগুলো; কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কেনো উপভোগ করি? এমন হ’তে পারি। আমি এখনো রহস্যীকরণপ্রক্রিয়ার শিকার হয়ে আছি, নিজেকে পুরোপুরি মুক্ত করতে পারি নি। তার প্রভাব থেকে, তবে বোধ করি এগুলো উপভোগ করি আমি এগুলোর তীব্র আবেগ, মানবিক অনুভূতির অতুলনীয়তা, অসাধারণ সৌন্দর্য, পার্থিব চিত্রের পর চিত্র, রূপক, চিত্ৰকল্প প্রভৃতির জন্যে। রবীন্দ্রনাথের আন্তরিকতা, আবেগতীব্রতা ও রূপময়তার জন্যে মাঝেমাঝে যা বিশ্বাস করি না, তাও আমাকে অভিভূত করে, শিউরে দেয়। তাঁর পরমসত্তা অবশ্য সুধীন্দ্রনাথাকথিত ‘ইহুদির হিংস্র ভগবান’’ নয়, চণ্ডরোষে ধেয়ে আসার জন্যে সে উদ্যত হয়ে নেই; তার পরমসত্তা পরম প্রেমিক, সুন্দর, প্রিয়তমের মতো কখনো কখনো সুখকররূপে নিষ্ঠুর।
রবীন্দ্রনাথ তার পরমসত্তাকে শুধু দয়াময় প্রেমিক হিশেবেই দেখতে পছন্দ করতেন না, নিষ্ঠুরতাও চাইতেন তার কাছে, তা অবশ্যই মোহন নিষ্ঠুরতা। তিনি সব কিছু পরিবৃত দেখতেন। পরমসত্তার অস্তিত্ব দিয়ে। তা যেমন হতে পারে এমন প্রাত্যহিক : ‘যে-কেহ মোরে দিয়েছ সুখ দিয়েছ তারি পরিচয়/সবারে আমি নমি ॥/যে-কেহ মোরে দিয়েছ দুখ দিয়েছ তারি পরিচয় / সবারে আমি নমি।’, বা তা হতে পারে এমন মহাজাগতিক : ‘তোমায় আমায় মিলন হবে ব’লে আলোয় আকাশ ভরা।’ প্রাকৃতিক সব কিছুতে তিনি দেখছেন পরমসত্তার স্পর্শ: