শুধু মানুষ নয়, সব প্রাণীর মৃত্যুর কথাই আমার মনে পড়ে। হিংস্র বাঘ, বিশাল হাতী, হরিণ, বা সাপ, বা পিপড়ে কীভাবে মারা যায়। আমি জানি না; তারা কতোটা কষ্ট পায়, তা আমি জানি না। কীভাবে মরে টিয়ে, চড়ুই, কবুতর, কাক, তাও আমার জানা নেই। আমি জানি না তারা মৃত্যুকে মানুষের মতোই ভয় করে কি না। তারা কি জানে মৃত্যুর কথা? আমি দু-একটি পাখি ও বেড়ালকে ধীরেধীরে মরতে দেখেছি; কী তীব্র কষ্টে তারা বিবশ হচ্ছে, মুমূর্ষ হচ্ছে, চোখে চরম হতাশা জমা বাঁধছে, তাও দেখেছি; কিন্তু তারা কি জানতো তারা মারা যাচ্ছে? সম্ভবত অন্য কোনো প্রাণীরই মৃত্যু সম্বন্ধে ধারণা নেই; না কি আছে?
খুব কষ্ট পাই আমি তাদের জন্যে, যারা হঠাৎ ম’রে যায়, আর যারা মরে যায় নামপরিচয়হীন। পরিস্থিতি একটু ভিন্ন হ’লেই তারা মরতো না, থাকতো জীবনের উৎসবে; কিন্তু পরিস্থিতি সামান্য ভিন্ন হওয়ায় তারা স’রে গেছে। তাদের কথা ভাবলে খুব তীব্র নিরর্থকতার বোধে আক্রান্ত হই আমি, যেমন তীব্র নিরর্থকতার বোধ হয় হিরোশিমা আর নাগাসাকির কথা ভাবলে। ওই দুই নগরের মানুষ যুদ্ধের মধ্যেও ভালো ছিলো; হঠাৎ তাদের ওপর লাফিয়ে পড়লো বিস্তৃত নরক। যারা ম’রে গেলো তারা জানলোও না কীভাবে কোথায় থেকে হঠাৎ এলো এমন মৃত্যু। চরম নিরর্থকতার ও আকস্মিকতার বোধ নিয়ে স’রে গেছে। ওই দুই নগরের মানুষ। মৃত্যু কী রূপে দেখা দিয়েছিলো আউসহ্বিট্জে, হিটলারের মানুষনিধনকুণ্ডে? ধাৰ্মিকেরা বলেন বিধাতা করুণাময়, এটা কেমন করুণা তারা? দুটি নগরের অসংখ্য মানুষ ধ্বংস করা হলো আণবিক বোমায়, আউসহ্বিট্জে পোড়ানো হলো লাখ লাখ মানুষ তারই করুণায়? নিশ্চয়ই সমস্ত প্ৰশংসা তার। তিনি কি দয়াময় নন? না কি তিনি মুখ ফিরিয়ে রেখেছিলেন ওই সময়? হোৱাইনবার্গ এমন নির্বিকার বিধাতার কাছে প্রার্থনা করাকে মনে করেন। চরম অভদ্রতার কাজ। এলাই হ্বিসেল বলেছেন আউসহ্বিট্জে শুধু মানুষের মৃত্যু হয় নি, মৃত্যু হয়েছে মানুষ ধারণাটিরও; আউসহ্বিট্জে বিশ্ব পোড়ায় তার আপনি হৃদয়। আউসহ্বিট্জে একা হিটলারের কাজ নয়, ওই কাজে অংশ নিয়েছিলো নানা পেশার মানুষ; লেখক ও শিক্ষকেরা প্রস্তুত করেছিলো ঘেন্নার উর্বর জমি, যেখানে হিটলার বুনেছিলো তার ইহুদিবিদ্বেষের বীজ, ছাত্র ও পাঠকেরা তুলেছিলো তার ফসল: আইনজীবীরা আইন তৈরি ক’রে বিচ্ছিন্ন করেছিলো ইহুদিদের এবং প্রস্তুত করেছিলো বধ্যভূমি, চিকিৎসকেরা নারীপুরুষশিশুর ওপর গ্যাস প্রয়োগ ক’রে চালিয়েছিলো পরীক্ষা; বিজ্ঞানের নামে বিজ্ঞানসাধকেরা সম্পন্ন করেছিলো বন্দীদের ওপর তাদের নৃশংস নিরীক্ষা। ব্যবসা-ব্যবস্থাপকেরা ব্যবহার করেছিলো তাদের শাস্তা শ্রমিকরূপে। কোনো আদিম সমাজে ঘটে নি আউসহ্বিট্জ; ঘটেছিল বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, দর্শন, শিল্পকলায় উন্নত এক সমাজে। এ-সমাজের কাছে কি চাইবো না আমরা মানবিকতা বা মনুষ্যত্ব? তার বদলে যা দেখতে পাই, তা হচ্ছে সব কিছুই সম্ভব মানবসমাজে; মানুষের এক গোত্র সম্পূর্ণ নিৰ্মল করতে পারে আরেক গোত্রকে। একাত্তরে কি তা-ই দেখি নি আমরা? সম্ভব হ’লে কি পাকিস্থানি ঘাতকেরা সম্পূর্ণ নির্মূল করতো না বাঙালিদের?
আউসহ্বিট্জে বিধাতার ভূমিকা কী? এ-প্রশ্ন শুনে আমি হো হো ক’রে হেসে উঠবো; ন্যায়পরায়ণ ধাৰ্মিকেরা চুপ ক’রে থাকবেন, স্থূল ধাৰ্মিক হয়তো একে গণ্য করবে ইহুদিদের ওপর বিধাতার অভিশাপ ব’লে। কিন্তু বাঙলাদেশে গণহত্যায় কি ভূমিকা বিধাতার? রাজনীতিক কারণে হয়তো সবাই চুপ থাকবে। বাঙলাদেশে গণহত্যা বা আউসহ্বিট্জে বিধাতার ভূমিকা কি দর্শনের বিষয় হ’তে পারে? হ্যা, হতে পারে; যেমন আউসহ্বিট্জে বিধাতার ভূমিকাকে দর্শনের বিষয়ে পরিণত করেছেন এলাই হ্বিসেল। হ্বিসেল নিজে বন্দী ছিলেন আউসহ্বিট্জের মৃত্যুশিবিরে; কিন্তু বেঁচে গিয়েছিলেন, তবে ওই বাঁচা বদলে দিয়েছিলো তাঁর সব কিছু। তিনি বলেছেন লেখক হওয়ার কথা তার ছিলো না; কিন্তু তিনি লেখেন, কেননা তিনি তাৎপর্য দিতে চান তার বেঁচে থাকাকে; নইলে তিনি পাগল হয়ে যাবেন। যে-ইহুদিনিধনকুণ্ড জ্বলিয়েছিলো হিটলার, তার মূলে রয়েছে সামাজিক রাজনীতিক আর্থনীতিক কারণ ও তার ব্যক্তিগত বিকার; তবে হ্বিসেল এর সাথে যুক্ত করেন বিধাতাকেও। তার মতে বিধাতাকে বাদ দিয়ে এ-মহানরক ব্যাখ্যা করা যায় না। কীভাবে বিধাতাকে জড়ানো যায় এমন অশুভ ব্যাপারে? তাহলে কি বিধাতা আর শয়তানের মধ্যে পাতাতে হবে আবার বন্ধুত্ব, মিটমাট ক’রে ফেলতে হবে তাদের পুরোনো কলহ? বিধাতাকে কি দাঁড় করাতে হবে কাঠগড়ায়? ধার্মিকেরা সব সময় বিধাতাকে শুভ দেখতে চান, আর অশুভ সব কিছু চাপিয়ে দেন। শয়তানের বা মানুষের ওপর। হ্বিসেল এটা মেনে নেন না; তার মতে বিধাতাকে অতি শুভ মনে করাতেই বৈধতা পায় অশুভ। এ নিয়ে তিনি লিখেছেন এক অসাধারণ নাটক : বিধাতার বিচার।
মৃত্যু কাকে বলে? মৃত্যু হচ্ছে জীবনপ্রক্রিয়ার উল্টোনো অসম্ভব পরিসমাপ্তি; আর ফেরা নেই, আর অগ্ৰগতি নেই; চিরকালের জন্যে থেমে যাওয়া। যে ছিলো সে আর নেই; আর সে নিশ্বাস নেয় না, তার শিরা আর কাপে না, আলো তাকে আর চকিত করে না, আঘাত তাকে আর ব্যথা দেয়া না। তাপহীন হয়ে ওঠে তার শরীর, কিছুক্ষণ পর শক্ত হয়, আরো কিছুক্ষণ পর পচন ধরে। জীবনের কিছু আর তার জন্যে নয়-একদিন স্বপ্ন ছিলো, সোনা ছিলো, তা আজ নিরুত্তর শান্তি পায়, যেনো কোন মায়াবীর প্রয়োজনে লাগে; তার জন্যে অপেক্ষমান এখন মাটি ও আগুন। বিজ্ঞান এখন নানা উপায় বের করেছে নিশ্চিতভাবে জানতে যে সত্যিই লোকটি মরেছে কি না? কেনো এতো উপায়? মানুষ মরতে চায় না ব’লেই—গলিত স্থবির ব্যাং আরো দুই মুহুর্তের ভিক্ষা মাগে? অনুমেয় উষ্ণ অনুরাগে? মৃত্যুর ভয়ে চিরকালই জামে গেছে মানুষ; আধুনিকদের থেকে সম্ভবত পুরোনোরাই ভয় পেয়েছে বেশি; তাই মৃত্যু নিয়ে তাদের ভাবনাকল্পনার শেষ নেই। তারা কল্পনা করেছিলো আত্মা; আর আত্মাকে বিস্মৃতির নদী পার করিয়েছে, বাস করিয়েছে বিস্মৃতিলোকে তাকে ত্ৰাণ করার উপায় কল্পনা করেছে, ছায়ামূর্তিরূপে রেখেছে মৃতদের দেশে, প্রেতলোকে, শেষে বিচার করিয়েছে, এবং পাপপুণ্য অনুসারে রেখেছে স্বর্গে বা নরকে। মৃত্যুভয়েই দেখা দিয়েছিলো এসব উন্মত্ত কল্পনা; সত্যের মুখােমুখি না হয়ে তারা তৈরি করেছিলো সুখকর সুন্দর মিথ্যে। অনেক পাগল ভেবেছে মৃত্যু হচ্ছে জীবনেরই আরেক রূপ, তার জীবন ছুটে চলেছে এক অবস্থা থেকে আরেক অবস্থায়, এক বিমানবন্দর থেকে আরেক বিমানবন্দরে। হিন্দুরা ভয়ে কল্পনা করেছে। বারবার জীবন, বৌদ্ধরা নিস্ক্রান্ত্র হয়ে যেতে চেয়েছে জীবন থেকে। আমি যেমন ছেলেবেলায় চারপাশে মৃত্যু দেখতাম পুরোনোরাও দেখতেন, তাই তাঁরা অনেক কিছুর মুখে দেখতে পেতেন মৃত্যু। তাঁরা মৃত্যু ও নারীকে দেখতেন অভিন্নরূপে। হোমারে পাই পাখিনারী সাইরেনদের, যারা মৃত্যুর প্রতিমূর্তি। কঙ্কালও এক সময় ছিলো মৃত্যুর প্রতীক। রোম্যান্টিক কবিরা অবশ্য শিশুর মতোই কল্পনা করেছেন মৃত্যুকে; রবীন্দ্রনাথের কাছে কখনো তা রাধার কাছে কৃষ্ণের মতো, কখনো মায়ের এক স্তন থেকে আরেক স্তনে স্থানান্তর-প্রচুর মাতৃদুগ্ধ পানের ব্যবস্থা রয়েছে মৃত্যুর পর; ডান যদিও বোধ করেছিলেন যার জন্যেই ঘণ্টা বাজুক তা বাজে তাঁর জন্যেই, কিন্তু কবিতা লিখতে গিয়ে বলেছেন, ‘মৃত্যু তুমি গর্বিত হয়ো না’, চিৎকার ক’রে বলেছেন, ‘মৃত্যু তুমি নেই। মৃত্যুর থেকে গর্ব করার অধিকার আর কার আছে? হাহাকারের মতো শোনায় ডানের এই চিৎকার। তবে মৃত্যু সাম্যবাদী, সবাইকে নামিয়ে আনে একই সমতলে—একই আবর্জনাস্তুপে: সব সোনার ছেলেরা অবশেষে চিমনিঝাড়ুদার বালকদের মতো ধুলোয় মেশে, এবং রাজা ও সম্রাটের হাড় পড়ে থাকে। পাশাপাশি। আসলেই কি থাকে-মর্মর প্রাসাদ ওঠে। ভিখিরির কবরে? কবরে না কি গরিবও কোটিপতিকে, মৃত্যুদণ্ডিত কবি পিটার পেট্রিক্স-এর ভাষায়, বলতে পারে : We’re equal now, I’ll not an inch resign;/This is my dunghill, as the next is thine। স্বৰ্গনরক নেই, আমরা কেউ স্বৰ্গে বা নরকে যাবো না, কিছু দিন শুয়ে থাকবো নিজ নিজ গোবরগাদায়।