দারিদ্র্য কোনো বিধাতার উপহার নয়, কোনো ঐতিহাসিক নিয়তিও নয়; এটা রাজনীতিক, ও প্রচণ্ড সন্ত্রাসের ফল; দারিদ্র্য সম্পদের অভাবের জন্যে ঘটে না, ঘটে তার অপব্যবহারের জন্যে; একথাই জানিয়েছিলেন মার্ক্স। কিন্তু চারপাশে তাকালে কী দেখতে পাই? দেখতে পাই দারিদ্র্য করুণাময়ের দান, তিনি যাকে করুণা করেন তাঁকে পাঁচখানা পাজেরো দান করেন, আর যাকে ইচ্ছে করেন তাকে রেললাইনের পাশে টায়ার পুড়ে রান্না ক’রে খেয়ে মরতে বাধ্য করেন। গরিবদের অনেকের সাথে আমি কথা ব’লে শিউরে উঠেছি, দেখেছি সত্যিই তারা বিশ্বাস করে তাদের দারিদ্র্য বিধাতারই দান। ধর্ম এমন ব্যাপার যা শূদ্র হওয়াকে, দরিদ্র হওয়াকে ধর্মীয় বিশ্বাসে পরিণত করে; শূদ্র ও দরিদ্র বিশ্বাস করে এভাবেই সে স্বর্গে যেতে পারবে। এ-বিশ্বাস অবশ্য তার নিজের নয়, হাজার হাজার বছর ধ’রে এটা তাকে শেখানো হচ্ছে, প্রতিদিন ধাৰ্মিকেরা তাদের এটা শেখান; তাই তাদের মনে এ-বিশ্বাস বদ্ধমূল হয়ে উঠেছে। ধর্ম দিয়ে তাদের এখন আরো মাতিয়ে রাখা সম্ভব। কিছু টাকা ছেড়ে দিলে ধর্ম ও অর্থের মিশ্রণে তাদের মধ্যে উৎপন্ন হয় এমন উত্তেজক মাদক, যা বিপ্লবের সব সম্ভাবনাকে দীর্ঘকালের জন্যে স্থগিত ক’রে দেয়। আমরা অবশ্য অনেক বিপ্লব ও তার ব্যর্থতা দেখেছি। বিশশতক তো যুদ্ধ ও বিপ্লবেরই শতাব্দী। উনিশশতক ছিলো জাতীয়তাবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদ প্রভৃতির শতাব্দী, যা বিপন্ন ক’রে তুলেছিলো পৃথিবীকে; আর বিশশতকে ঘটেছে এতো প্রচণ্ড বিপর্যয় যে বিপ্লবের মধ্য দিয়ে মানুষকে মুক্ত করা দুরাশায় পরিণত হয়েছে। যুদ্ধ আর বিপ্লব এক নয়, যদিও দুটিতেই ঘটে সন্ত্ৰাস; বিপ্লব আধুনিক ব্যাপার, বিপ্লবের সাথে থাকে মুক্তির চেতনা। হান্না আরেভূটু দেখিয়েছেন আধুনিক বিপ্লবের ধারণার সূচনা হয় আঠারোশতকের আমেরিকা ও ফরাশিদেশে। যুদ্ধের ফলে নানা বদল ঘটে, কিন্তু বিপ্লব শুধু বদল ঘটায় না। বিপ্লবের সাথে জড়িত থাকে এ-চেতনা যে সমাজের চলতি অবস্থা অবধারিত নয়, আবশ্যকও নয়। প্রাকৃতিক সূত্রে কোনো ধনীগরিব নেই। বিপ্লবের সম্ভাবনা দেখা দেয় তখনি যখন মানুষ বোধ করে যে দারিদ্র্য অবধারিত নয়, এটা মানুষের সৃষ্টি; মনে করতে থাকে যে একদল মানুষ, পরিস্থিতির সুযোগে, বা শক্তিপ্রয়োগ, বা জোচ্চোরি ক’রে ধন আয়ত্ত করেছে, এবং আরেক দল, যারা তা পারে নি, হয়ে আছে দরিদ্র; তাই ধনীগরিবের পার্থক্য অবধারিত নয়, শাশ্বতও নয়। কোনো বিপ্লব আজো সফল হয় নি; পৃথিবীর দুটি বড়ো বিপ্লব—ফরাশি বিপ্লব ও রাশিয়ার সাম্যবাদী বিপ্লব ব্যর্থ হয়ে গেছে। দু-এক দশকে আর বিপ্লবের মুখ দেখবো ব’লে আশা করতে পারছি না; কেননা প্রতিক্রিয়াশীলতা এখন ব্যাপক, আর গরিবেরা বিশ্বাস করছে যে বিধাতাই তাদের গরিব করেছে, আর ধনী হ’তে চাইলে তাদের সুযোগ নিতে হবে পরিস্থিতির, বা জোচ্চোরির-এটাই বিধাতার বিধান।
চারদিকে চলছে। জীবনের উৎসব, প্ৰাণের রঙিন কার্নিভাল, আবেগে গাল লাল হয়ে উঠছে সবুজ হয়ে উঠছে পাতা; এ-কার্নিভালে কুৎসিত মুখোশ প’রে কে নাচছে তুমুল নাচ?—মৃত্যু। মানুষের চিন্তায় মৃত্যু বিমূর্ত ধারণা নয়, মানুষের মনে মৃত্যু এক সজীব অস্তিত্ব, যার কাজ তার রঙিন উৎসবকে অন্ধকার ক’রে তোলা। সে চলছিলো, একদিন থেমে যাচ্ছে, কোনো দিন জানবে না সে ছিলো। অন্যরা হয়তো জানবে, যদি সে জানার মতো হয়, তবে একদিন ভুলে যাবে। আমি বড়ো হয়েছি মৃত্যুর মধ্যে, মৃত্যুপরিবৃত হয়ে; ছেলেবেলায় মাঝেমাঝেই শুনতাম কোনো বাড়ি থেকে উঠছে করুণ কান্নার রোল, বুঝতাম। কেউ মারা গেছে, কেঁপে উঠতাম। আমার চারদিক অন্ধকারে ঢেকে যেতো, কোনো রাতও আমন অন্ধকার নয়। তারা সাধারণত হতো শিশু-বালকবালিকা, আমার মতোই, কখনো আমার থেকে ছোটো, কখনো বড়ো। বুড়োরাও মরতো, তবে আমন করুণ কান্না উঠতো না তাদের মৃত্যুতে। ভাবতাম আমার জন্যেও মৃত্যু অপেক্ষা ক’রে আছে; আমি ম’রে যাবো, আর কুয়াশায় হাঁটবো না, রোদে দাঁড়াবো না, ঝাঁপিয়ে পড়বো না পুকুরে, উঠবো না গাছে, যাবো না ইস্কুলে। বুক সব সময়ই ভারী হয়ে থাকতো; আমার সারাটি বছরই ছিলো মৃত্যু দিয়ে ঘেরা, প্রতিটা মাসই ছিলো মৃত্যুর মাস; চারদিকে দেখতাম মৃত্যুর মুখ, কিন্তু তার মুখ দেখতে পেতাম না। কলেরা আসবে কার্তিকে, রহস্যময় শাদা শাড়ি পরে এক নারী চুল উড়িয়ে হেঁটে যাবে আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে, তার শাদা আঁচল লাগবে আমাদের বাঁশের বেড়ায়, রাতে আমি বমি ক’রে ফেলবো, আমি ম’রে যাবো; বসন্ত আসবে চোত বা বোশেখে, আমাদের বাড়ির ওপর দিয়ে এক দমকা বাতাস বয়ে যাবে, আমার জুর আসবে, আমি ম’রে যাবো। সারা বাল্যকাল ভরে আমি মৃত্যুকে পথে পথে, বেড়ার পাশে, পুকুরের জলে, ধানের গুচ্ছে, শিশিরে, গাছের ডালে, আর কুয়াশারোদের ভেতরে দেখতে পেয়েছি। যারা আমাদের গ্রামে ম’রে যেতো, যদি তারা আমারই বয়সের হতো, আমি ম’রে যেতাম তাদের সাথে; তাদের সাথে কাফন প’রে আমি নেমে যেতম কবরে, আমার ওপর মাটি ঝ’রে পড়তো, আমার চারদিকে উঠতে থাকতো অবোধ্য শ্লোকের ভীতিকর শব্দ, আগরবাতির দমবন্ধ করা গন্ধ। আমার ঘুম আসতো না। কতোবার যে আমি ম’রে গেছি আমার বাল্যকালে।
মৃত্যু খুবই কাছে থেকে দেখেছি আমি, বাল্যকালে; যৌবনের পর আর মৃত্যু কাছে থেকে দেখি নি। মৃত্যু বাল্যকালের পর আমার কাছে মূল্য বা মর্যাদা হারিয়ে ফেলে; আমি ভুলেই যাই যে মৃত্যু আছে, বা থাকলেও আমার তাতে কিছু যায় আসে না, তার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। পঞ্চম/ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ি তখন, আমাদের পাশের বাড়ির এক বুড়ো, যাকে আমি দাদা বলতাম এবং তিনিও আমাকে দাদা বলতেন, তিনি মারা যাবেন, তাঁর পাশে কেউ নেই, শুধু আমি ছিলাম। তিনি মারা গেলেন, আমি সবাইকে ডেকে জানালাম যে দাদা মারা গেছেন। আমার কোনো কষ্ট লাগে নি; এমনকি আমি তার কবরও অনেকটা খুঁড়েছিলাম। কয়েক বছর পর যখন আমার ছোটো এক ভাই ম’রে গেলো, রাতে অসুখ হয়ে চ’লে গেলো ভোরেবেলাতেই, কথা বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গেলো, আমি তাঁর কবর খুঁড়তে পারি নি, আমি তার কবরে ঝাঁপিয়ে পড়তে চেয়েছিলাম। এখনকার শিশুদের, অন্তত আমার শ্রেণীটি যাদের জন্ম দিচ্ছে ও লালনপালন করছে, তারা মৃত্যু চেনে না, মৃত্যু তারা দেখে নি; আমার কাছে মৃত্যুর যেমন জীবন্ত অস্তিত্ব ছিলো, তাদের কাছে মৃত্যুর তেমন অস্তিত্ব নেই। তারা দূর থেকে শোনে মৃত্যু আছে, কিন্তু তা তাদের নাড়া দেয় না, একবার শুনে তারা অন্য দিকে মন দেয়, ক্রিকেট খেলতে যায়; তারা কান্নার করুণ সুর শুনতে পায় না। তারা সব। কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন, মৃত্যুর ভয় ও বেদনা থেকেও বিচ্ছিন্ন। তারা হয়তো অনেক কুসংস্কার থেকে মুক্ত; এবং মুক্ত অনেক ভয় থেকে। ইউরোপ আমেরিকায় মৃত্যু আরো বিমূর্ত, আরো নিরবয়ব হয়ে উঠেছে; সেখানে অনেকে আছে, যারা কখনো কারো মৃত্যু দেখে নি, কোনো লাশ দেখে নি। সেখানে শিশুদের পিতামাতারা সাধারণত মারা যায় না, আর সাধারণত শিশুরা মারা যায় না; যারা মারা যায়, তারা জীবন থেকে অনেক আগেই অনেক দূরে স’রে গেছে। হাসপাতাল তাদের মানবিকভাবে লোকান্তরিত হওয়ার ব্যবস্থা করে, সমাহিত্যকারী প্রতিষ্ঠানগুলো মানবিকভাবে তাদের সমাহিত করে; চারপাশে কোথাও মৃত্যুর দাগ লাগতে দেয় না। সেখানে কেউ মরে না, একদিন অনুপস্থিত হয়ে যায়।