বিশ্বের রহস্যীকরণে সবচেয়ে বড়ো ভূমিকা নিয়েছে ধর্ম; এবং ধর্ম সব কিছুকে গ্ৰাস ক’রে মানবপ্রতিভার সব কিছুকে বাধ্য ও উৎসাহিত করেছে বিশ্বের রহস্যীকরণে অংশ নিতে। ধর্মপ্রবর্তকেরা, ও তাদের অনুসারীরা, বুঝেছেন যে দখল করতে হবে শক্তিকেন্দ্র; এবং শক্তিকেন্দ্র দখল করতে পারলে আর কিছুই তাদের বাহুর বাইরে থাকবে না। মানুষের প্রতিভার সব এলাকায় যেতে চাই না। আমি, থাকতে চাই শিল্পকলা, বিশেষ ক’রে সাহিত্যে, এবং দেখতে পাই যে সাহিত্য। বিশেষভাবেই অংশ নিয়েছে বিশ্বজগতের রহস্যীকরণে। সাহিত্য তাই একটি সুন্দর অন্ধকারের এলাকা। চিত্রকলায়ও এটা খুবই ঘটেছে; হিন্দু ও খ্রিস্টান চিত্রকরেরা উৎসাহের সাথে, হয়তো আর্থ অনুপ্রেরণায় অনেকটা, রহস্যীকরণে যোগ দিয়ে বিশ্বকে ঢেকে দিয়েছেন রহস্যের আবরণে। দেবদেবী, মেরি ও ক্রাইস্টের অজস্র ছবি এঁকেছেন ও মূর্তি তৈরি করেছেন তাঁরা, যেগুলোর কোনো কোনোটি আমার প্রিয়; কিন্তু ওই সব মূর্তি ও ছবির সৌন্দর্যের থেকে বিশ্বাসীদের কাছে ওগুলো আকর্ষণীয় রহস্যীকরণের জন্যে, বিশ্বাস সম্পর্কে মনে ভুল বিশ্বাস সৃষ্টির জন্যে, তাদের মনের ভুল বিশ্বাসকে গভীর ক’রে তোলার জন্যে। মুসলমানদের ছবি আঁকা নিষিদ্ধ, বিশেষ ক’রে স্রষ্টা ও প্রবর্তকের ছবি আঁকা আত্মহত্যার থেকেও শোচনীয় ব’লে মুসলমান চিত্রকরেরা এ থেকে বিরত রয়েছেন। সাহিত্য রহস্যীকরণের কাজ করেছে প্রবলভাবে, বিশ্বের গৌণ ও প্রধান লেখকেরা কবিতা, গান, উপাখ্যান ও সন্দর্ভে দলবেঁধে অংশ নিয়েছেন বিশ্বজগতের রহস্যীকরণে। তাই সাহিত্য প্রধানত অপবিশ্বাসের জগত; এখনো সাহিত্যে যে-প্রবণতা দেখতে পাই, তা অন্ধকারের প্রবণতা, ভুল ধারণা সৃষ্টির প্রবণতা। অজস্র বিশ্বাসের কাছে আত্মসমর্পণ ক’রে সাহিত্য হয়ে আছে এক ভুলের বিশ্ব, যদিও তার সৌন্দর্য অশেষ। শুধু সত্যের নয়, মিথ্যেরও সুন্দর রূপ রয়েছে; অনেক সময় মিথ্যের রূপই বেশি সুন্দর সত্যের রূপের চেয়ে, তাই কবিরা ও নানা ধারার লেখকেরা অজস্র মিথ্যের সৃষ্টি করেছেন সুন্দর রূপ। মিথ্যেকেই তাঁরা বিশ্বাস করেছেন সত্য বলে।
বিশ্বের সাহিত্যের বড়ো অংশ দাঁড়িয়ে আছে বিশ্বাসের ভিত্তির ওপর; অর্থাৎ যা অসত্য, অপ্রমাণিত, সন্দেহজনক, তার ওপর। পরিবার ও প্রথা থেকে পাওয়া বিশ্বাস কবিরা প্ৰকাশ করেছেন তীব্র আবেগে, তাকে করেছেন রূপময়; কিন্তু তার ভিত্তিটাকে সরিয়ে নিলে ওই আবেগ ও রূপ সম্পূর্ণ কাঠামোসহ ভেঙে পড়তে পারে, একদিন পড়বে। অধিকাংশ কবিই পরিবার ও সমাজ থেকে পাওয়া বিশ্বাস যাচাই করেন নি, যাচাই করার শক্তি নেই। অনেকেরই, তারা ভেসে গেছেন আবেগে। কবিতা ও গানের বিনোদক ভূমিকা রয়েছে, তারা দেখেছেন যাচাই না ক’রে আবেগে ভেসে গেলে বিনোদনের কাজটি সম্পন্ন হয় আরো ভালোভাবে। জনগণ প্রাপ্ত বিশ্বাসে স্বস্তি পায়, ওই বিশ্বাসকে যখন কেউ প্ৰবল ক’রে তোলে তখন তা হয়ে ওঠে অত্যন্ত উপভোগ্য, তখন তারা একই সাথে ভোগ করে শিল্পকলা ও বিশ্বাস। শিল্পকলার সৌন্দর্য অবশ্য অধিকাংশ মানুষই উপভোগ করতে পারে না, তারা উপভোগ করে তার ভেতরের মানবিক ও বিশ্বাসগত আবেগ, এবং কবিরা তা কাজে লাগিয়ে থাকেন। কবিতায় বিশ্বাস যতোটুকু থাকে ততোটুকু অকবিতা, বিশ্বাসের বাইরে যতোটুকু থাকে ততোটুকু কবিতা; যুগে যুগে বিশ্বাস ভেঙে পড়ে, কিন্তু সৌন্দর্য অতো অল্প সময়ে ভেঙে পড়ে না। বিশ্বাসের কবিতা হচ্ছে ভুল কাঠামোর ওপর দাঁড়ানো আবেগগত সৌন্দর্য।
রবীন্দ্রনাথকে মনে হয় বিশ্বাসের পরম রূপ: বিশ্বকে রহস্যীকরণের এক প্রধান ঐন্দ্রজালিক। তাঁর কবিতা ও গানে, এবং বহু প্রবন্ধে, পাই বিশ্বাসের কাঠামোর ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে থাকা সৌন্দর্য। রবীন্দ্রনাথ যে-বিশ্বাস পোষণ করেছেন, তা ভেতর থেকে উঠে আসে নি তার; উঠে এসেছে পরিবার থেকে, এবং তাকে তিনি উপনিষদের বহু সুন্দর মিথ্যেয় সাজিয়েছন জীবন ভরে। তিনি বিশ্বাস করতেন এক পরমসত্তায়, ওটা তাঁর নিজের উপলব্ধি নয়, পরের উপলব্ধি; তাঁর পিতা। বহুদেবতাবাদী ধর্ম ছেড়ে একদেবতাবাদী পরমসত্তায় বিশ্বাস না আনলে, তার পরিবার ওই একক পরমসত্তার স্তবে মুখর না হ’লে তিনিও থেকে যেতেন বহুদেবতাবাদী। রবীন্দ্রনাথের পরমসত্তায় বিশ্বাসের সাথে প্রথাগত ধর্মের বিশেষ মিল নেই; তাঁর বিশ্বাসে প্রথাগত ধর্মের স্বৰ্গনরক নেই, আবশ্যিক আরাধনা নেই, তাঁর পরমসত্তা সৃষ্টিকে শাস্তি দেয়ার জন্যে ব্যগ্র হয়ে নেই। তিনি পরমসত্তার সাথে পাতিয়েছিলেন এক ব্যক্তিগত সম্পর্ক, য়া অনেকটা প্রবল শক্তিমান প্রেমিকের সাথে আবেগকাতর অসহায় প্রেমিকার সম্পর্কের মতো; তার পরমসত্তা অনেকটা ধর্ষকামী-যে সুখ পায় পীড়ন ক’রে, তার পীড়ন মধুময়, আর তিনি নিজে অনেকটাই মর্ষকামী—যিনি সুখ পান পীড়িত হয়ে, পরমসত্তার পীড়নে দলিত দ্রাক্ষার মতো তার ভেতর থেকে মধু উৎসারিত হয়। সম্পর্কটি অনেকখানি হৃদয়গত ও শারীরিক। বিশ্বজগতের রহস্যীকরণের কাজ রবীন্দ্রনাথ করেছেন বিচিত্ররূপে; এবং এ-কাজে তিনি একটি শব্দ বারবার ব্যবহার করেছেন, শব্দটি হচ্ছে সত্য। বিশ্ব রহস্যীকরণে তার চাবিশব্দ সত্য, যখনই তিনি তার বুঝতে-না- পারা পরম উপলব্ধি বা বিশ্বাসের কথা বলতে চেয়েছেন, যা সম্পর্কে তার নিজেরই ধারণা অস্বচ্ছ, তখনই তিনি ব্যবহার করেছেন এ-শব্দটি; এবং অনুরাগীরা এক সুখকর বিভ্রান্তির মধ্যে বাস করার স্বাদ পেয়েছেন। ‘সত্য যে কঠিন/কঠিনেরে ভালোবাসিলাম” বা “সত্যের দারুণ মূল্য লাভ করিবারে’ ইত্যাদি উক্তিতে কবিতা কম, বিভ্রান্তি বিপুল; তবে রহস্যীকরণের কাজটি সম্পন্ন হয়েছে, সত্য একরকম অলৌকিক সামগ্ৰী এ-বোধ তৈরি হয়েছে চমৎকারভাবে।