অ্যালকোহল রাখা নিষিদ্ধ, কিন্তু আমি যেখানেই গেছি, রাজপুত্র, মন্ত্রী, দূতদের ভবনে আমাকে আপ্যায়ন করা হয়েছে হুইস্কি দিয়ে (জনপ্রিয় হচ্ছে জনি ওয়াকার ব্ল্যাক লেবেল)। আমি জানতে পারি যে এক সন্ধ্যায় যে-রাজপুত্রের সাথে আমি হুইস্কি পান করছিলাম, তিনি পরদিন ভোরে এক ব্যক্তিকে মদ্যপানের অপরাধে কারাদণ্ডিত করবেন।
পৃথিবী জুড়েই মুসলমান মদ্যপান করে; আর আরবরা পান করে না, মাছের মতো গিলে। মদ্যপান মুসলমানের জন্যে একদিনে নিষিদ্ধ হয় নি, হয়েছে ক্রমশ, এক বিখ্যাত ব্যক্তির মত্ততার জন্যে এটা নিষিদ্ধ হয়ে যায় চিরকালের জন্যে; এর জন্যে ব্যবস্থা হয় আশিটি চাবুকের, এমনকি মৃত্যুদণ্ডের। তবে আরবরা নতুন ধর্মের আগেও মদ খেয়েছে, পরেও খেয়েছে ও খাচ্ছে, এবং মদ খাওয়া নিয়ে লিখেছে প্রচুর কবিতা, যেগুলো পরিচিত ‘খামরিয়া’ বা মদের কবিতা’ নামে। দ্বিতীয় খলিফার কালে বারবার মদের প্রশংসা ক’রে কবিতা লিখে কারাগারে গেছেন, ও নির্বাসিত হয়েছেন কবি আবু মিহজান; তার একটি কবিতার অংশ এমন :
দাও, বন্ধু, একটুকু মদ আমি পান করি; আমি
ভালোভাবে জানি মদ সম্পর্কে কী নির্দেশ দিয়েছে বিধাতা।
আমাকে দাও খাটি মদ যাতে আমার পাপ হয় বৃহৎ
কেননা অমিশ্র মন্দ পান করলেই পরিপূর্ণ হয় পাপ।
এ-কবিতার প্রতিবাদটুকু চোখে পড়ে সকলেরই। মদের শ্রেষ্ঠ কবি আবু নুয়াস (৭৬২-৮১৪), যাকে বারবার দেখা যায় আরব্য রজনীতে হারুন আলরশিদের সাথে। মদের প্রশংসা ক’রে মৃত্যুদণ্ড তিনি এড়াতে পারেন নি; হায়, নির্বোধ কবি, কেনো প্রশংসা করো; প্রকাশ্যে উচ্চকণ্ঠে নিন্দে করো, এবং গোপনে মাছের মতো খাও। শুধু কবিরাই নন, বীরেরাও মদ খেতেন, তারাই খেতেন বেশি; খালিদ ইবনে ওয়ালিদের জীবনীকার গর্বের সাথে জানিয়েছেন। খালিদ যৌবনে নিয়মিত নামতেন। মদ্যপানের প্রতিযোগিতায়, এবং প্রথম হতেন।
মদ্য একদিনে নিষিদ্ধ হয় নি, প্রথমে এটি প্রশংসিতই ছিলো, পরে নিষিদ্ধ হয়। কয়েক পর্যায়ে। আদিমুসলমানদের কেউ কেউ পান ক’রে খুবই অস্বাভাবিক আচরণ করেছিলেন, যার জন্যে এটা নিষিদ্ধ হয়ে যায়। এ-সম্পর্কে যে-কাহিনী প্রচলিত, তা সত্যিই স্তম্ভিত করে আমাদের। কোনো সচিব সচিবালয়ে গিয়ে বা কোনো অধ্যাপক ক্লাশে গিয়ে মাতলামো করেছে, এমন কখনো ঘটে নি; কিন্তু ওই বিখ্যাত ব্যক্তি খুবই অশোভন আচরণ করেছিলেন উপাসনালয়ে। ১৬.৬৭তে আছে : ‘And among fruits you have the palm and the vine, from which you get wine and healthful nutriment: in this, truly, are signs for those who reflect’ (রোডওয়েল)। এতে রয়েছে একটি শব্দ ‘সংকর’। এর অর্থ নিয়েই অনুবাদকদের মধ্যে বিরোধ : দাউদ অনুবাদ করেছেন ‘intoxicants’, পিকথল করেছেন। ‘strong drink’, ইউসুফ আলি করেছেন ‘wholesome drink’; ইসলামিক ফাউন্ডেশন করেছে ‘মাদক’। মদ্যপান একেবারেই খারাপ নয়; আমি খাই, শামসুর রাহমান খান, এবং খায় লাখ লাখ বাঙালি ও মুসলমান, এবং খেয়েছেন গ্যালিলিও, নিউটন, শেক্সপিয়র, তলস্তয়, রবীন্দ্রনাথ, আইনস্টাইন: খান অজস্র সচিব, সম্পাদক, অধ্যাপক, মন্ত্রী, সেনাপতি, রাষ্ট্রপতি, উপাচার্য, বিচারপতি, দূত, পুলিশ। নিষেধ মানসিক রোগ সৃষ্টি করে; মুসলমান যখন মদ খায়, তার মনে অপরাধবোধ জন্মে, কেননা পরিবার ও সমাজ তাকে মনে করে মাতাল, দেখে খারাপ চোখে। অনেককে জানি আমি যারা মদ খেয়ে বাসায় ফেরার আগে খান প্রচুর পানশুপুরিজর্দা, কেউ কেউ চিবোন পেয়ারাপাতা; অনেকে অপরাধবোধে ভুগে ভুগে পুরোপুরি মাতাল হয়ে পড়েন, কাঁদতে থাকেন, বাসায় আর ফিরতে পারেন না। এ-অসুস্থতা থেকে উঠে আসতে হবে মুসলমানকে মদকে মনে করতে হবে একটি পানীয়, যা প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ পান করে।
বহু দিন মার্ক্স এঙ্গেলস, সাম্যবাদ, শ্রেণীসংগ্রাম, দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ, বিপ্লব শব্দগুলো শুনি না। কেউ বললে বা দেয়ালে এ-শব্দগুলো দেখলে কেঁপে উঠি, তারপর শান্ত হই। আমি কখনো শ্লোগানে মুখর হই নি, যারা মুখর হতেন এখন তাদের পুঁজির শ্লোগানে মেতে থাকতে দেখি। পৃথিবী কি তার শেষ সামাজিক পরিণতিতে পৌঁছে গেছে, সব অসুখ কি সেরে গেছে পৃথিবীর? পৃথিবীতে কি আর গরিব নেই? পৃথিবী কি এখন ভাসছে ডলারের স্রোতে? এ-শব্দগুলো এখন নিষিদ্ধ শব্দের মতো, এবং এগুলো আজ সম্পূর্ণ নিস্ক্রিয়। মার্ক্স যে বলেছিলেন দার্শনিকেরা এতো দিন শুধু নানাভাবে ব্যাখ্যা করেছেন বিশ্বকে, এখন দরকার তাকে বদলে দেয়া; আমরা কি ফিরে যাবো আবার মার্ক্সের আগে, শুধু ভাষ্যের পর ভাষ্য লিখবো পৃথিবীর? শুধু স্থগিত রাখবো তাকে বদলে দেয়া? গরিব আরো গরিব হ’তে থাকবে ধনী আরো ধনী; আর গরিবেরা শুধু ব্যবহৃত হবে ধনীদের ক্ষমতা দখলের শ্লোগানে? মার্ক্স ধর্মকে বলেছিলেন ‘গরিবদের আফিম’; অনেকটা প্ৰশংসার্থেই তিনি প্রয়োগ করেছিলেন রূপকটি, কিন্তু এর আধুনিকত্বে মর্মাহত হয়েছেন ধাৰ্মিকেরা। ধার্মিকেরা বলে থাকেন যে বিধাতাই শেষ আশ্রয়, যার আর কিছু নেই তার আছে বিধাতা, মার্ক্স এ-অর্থেই ব্যবহার করেছিলেন রূপকটি; তবে তিনি এর মূল্য বদলে দিয়েছিলেন। সব কিছু নিরর্থক হয়ে যাওয়ার পরই এক সময় মানুষ খেতো আফিম, যেমন আজকাল গ্রহণ করে মাদক; আফিমের মাদকতায় তারা সুখ পেতো, কিন্তু শেষে অসার হয়ে পড়তো; বিধাতায়ও তাই হয়, সুখ পেতে পেতে শেষে মানুষ আসার হয়ে পড়ে। গরিবদের সাথে বিধাতার গভীর সম্পর্ক রয়েছে, তাকে পাওয়ার জন্যে টাকা পয়সা লাগে না। ভাওয়ালে পর্তুগিজ পাদ্রি আসসুম্পসাউও বুঝেছিলেন ‘ঈশ্বর থাকেন গরিবদের আঙিনায়’, তাই যেতে হবে সেখানেই। মানুষ শিক্ষিত হয়ে জন্ম নেয় না, জন্ম নিয়েই সে বিচার করতে পারে না। সব কিছু একটি মানুষকে তৈরি করতে দু-দশক সময় কেটে যায়। গরিবের সন্তানকে প্রস্তুত করে দারিদ্র্য: তার কিছু নেই, তাই তার ওপর সহজেই চাপিয়ে দেয়া যায় বিধাতাকে। বাঙলাদেশে এখন তাই হচ্ছে, প্রতিক্রিয়াশীলতা যে তীব্র বেগে বাড়ছে, তার কারণ দারিদ্র্য। ধনীরা ধর্মকে পাত্তা দেয় না, কিন্তু ধর্ম দিয়ে যেহেতু তারা প্রতারণা করতে পারে, তাই নানা খেলা খেলে তারা ধর্মের সাথে: এবং সবচেয়ে করুণ খেলাটি খেলে গরিবদের সাথে।