নৈতিকতার সীমা হওয়া উচিত সংকীর্ণ; আমার কোনো কাজ যেনো অন্যকে ক্ষতিগ্রস্ত না ক’রে—এটুকু; কিন্তু ব্যাধিগ্রস্ত নীতিপ্রণেতারা এর সীমা বাড়িয়ে মানুষের জীবনের সব কিছুকে ঘিরে ফেলেছে, বন্দী ক’রে ফেলেছে, তার বাস্তব ও স্বপ্নকে বিপর্যস্ত ক’রে ফেলেছে; তবে আমার কোনো কাজ যেনো অন্যকে ক্ষতিগ্রস্ত না ক’রে’— এ-শর্তটিকেও পূরণ করতে পারে নি। প্রথাগত নৈতিকতার লক্ষ্য স্বাধীনতা কেড়ে নেয়া; তা যতো বেশি স্বাধীনতা কাড়তে পারে ততো বেশি নৈতিক মনে করে নিজেকে। এ-সমাজ কি নারীকে মুখ খোলা রেখে বাইরে বেরোতে দেয়? না, দেয় না; তাই এ-সমাজ অত্যন্ত নৈতিক ও ধাৰ্মিক। এ-সমাজে কি পুরুষ অন্য কোনো নারীর সাথে বেড়াতে যেতে পারে? না, পারে না; তাই এ-সমাজ খুবই নৈতিক ও ধাৰ্মিক। নৈতিকতা এমনই পীড়াদায়ক ও হাস্যকর। কিন্তু ব্যক্তির স্বাধীনতা হরণকে বিবেচনা করা উচিত অত্যন্ত অনৈতিক ব’লে, মানুষ স্বাধীনতা দেয়াই হওয়া উচিত নৈতিকতার ভিত্তি। নৈতিক মানদণ্ড খুবই নিকৃষ্ট মানদণ্ড, কেননা তা বস্তুনিষ্ঠ নয়; তা কিছু অসুস্থ মানুষের তৈরি মানদণ্ড। এখন সমাজগুলো চলছে নানা ধর্মীয় নৈতিকতার মানদণ্ডে, অর্থাৎ কয়েক হাজার বছর আগের কিছু মানুষের ভালোলাগা/মন্দলাগা ও বিশ্বাসের ওপর। খুব সরল উদাহরণ হিশেবে খাদ্যের ওপর বিধিনিষেধের ব্যাপারটি বিবেচনা করতে পারি। বিভিন্ন ধর্মে বেশ কিছু খাদ্য নিষিদ্ধ; হিন্দুর গোমাংস খাওয়া নিষিদ্ধ বা অনৈতিক, মুসলমানের শুয়োরমাংস খাওয়া ও মদ্যপান নিষিদ্ধ বা অনৈতিক। মুসলমান ও, হিন্দু ছাড়া, সবাই গোমাংস খায়, তাদের ধর্ম ও নৈতিকতা ক্ষুন্ন হয় না, কোনো ক্ষতিও হয় না; মুসলমান ছাড়া সবাই তৃপ্তির সাথে শুয়োরমাংস খায় ও মদ্যপান করে, তাদের ধর্ম ও নৈতিকতা নষ্ট হয় না, কোনো ক্ষতিও হয় না। যা অধিকাংশের জন্যে নৈতিক, তা অল্প কিছু মানুষের জন্যে অনৈতিক: তাই বুঝতে পারি। এখানে যে-নৈতিকতা কাজ করে, তা নিতান্ত স্বেচ্ছাচারী; তাই একে নৈতিকতা বলা যায় না। হিন্দু গরু খেলে কারো কোনো ক্ষতি হয় না, মুসলমান শুয়োরমাংস খেলে বা মদ্যপান করলে কারো কোনো ক্ষতি হয় না; তাই একে অনৈতিক মনে করতে পারি না। কিন্তু এ-নিষেধগুলো কেনো? এ-নিষেধগুলোর পেছনে নৈতিকতা নেই, বিজ্ঞান নেই;-আজকাল ছদ্মবিজ্ঞানীরা আদিম মানুষের অজস্র কুসংস্কারকে বিজ্ঞানসম্মত ব’লে প্রমাণ ক’রে প্রচুর ধন উপার্জন করছে; এগুলোর পেছনে আছে বিধানপ্রণেতারাদের কুসংস্কার ও স্বেচ্ছাচার।
মুসলমানের চোখে শুয়োর জঘন্যতম ঘেন্নার বস্তু; এর নামে মুসলমান যতোটা শিউরে ওঠে নরকের নামেও ততোটা ওঠে না। বন্দুকের টোটয় শুয়োরের চর্বির গুজব শুনে তারা মহাবিদ্রোহই ঘটিয়েছিলো ১৮৫৭ সালে। একটি ঘটনা মনে পড়ছে। বিলেতে ব্রিটিশ কাউন্সিলের আপ্যায়নে আমরা ছিলাম কিছু দিন। প্রান্তরাশে একটি সুস্বাদু মাংসাটুকরো প্রতিদিনই থাকতো, যার নাম ‘বেকন’। কয়েক দিন পর আমার এক ধাৰ্মিক বাঙলাদেশীয় বন্ধু ও আমি একই টেবিলে বসি। তিনি বেকন কেটে কেটে খেতে খেতে বলেন- ‘এই বেকন জিনিশটা যে কী বুঝতে পারছি না, কিন্তু এর থেকে সুস্বাদু জিনিশ আর আমি খাই নি।’ তিনি জানতে চান—’বেকন কী?’ আমি বলি—‘এটা শুয়োর মাংস।’ বন্ধুটি সাথে সাথে দাড়িয়ে যান, দু-হাতে মুখ চেপে ধরেন, প্রাতরাশ না ক’রেই দৌড়ে বেরিয়ে যান। ঘৃণা ও সংস্কার কতোটা প্রবল হ’তে পারে মানুষের সেদিন আমি চোখের সামনে দেখতে পাই। শুয়োর একটি নিরীহ প্ৰাণী, সেটি কোনো নৈতিকতা ও ধর্মের কথা জানে না; জানে না তাকে কারা ঘৃণা করে, কারা করে না। ঘৃণার ব্যাপারটিই আপত্তিকর, ঘৃণাকারীরা অসুস্থ। বলা হয়েছে যে শুয়োরমাংস হচ্ছে ‘রিজস’, অর্থাৎ ‘abomination’, ‘unclean’, বা ‘ঘৃণা’ ও ভীতির বস্তু’ বা ‘অপবিত্র’। অধিকাংশ মুসলমান, যদি জিজ্ঞেস করা হয় সে কেনো শুয়োর খায় না, বলে যে এটা নিষিদ্ধ। তবে একদল শিক্ষিত মেলে যারা গর্বের সাথে বলে, তারা এটা খায় না, কেননা এটা খেলে রোগ হয়। মজা হচ্ছে যে আরবে শুয়োর ছিলো অপরিচিত; তবে এটা কেনো নিষিদ্ধ হলো? এটা ঠিক যে শুয়োরমাংস খেলে Trichinosis নামে একটি মৃদু রোগ হ’তে পারে, তবে এটা উনিশশতকের আগে কেউ জানতো না। গরু, ছাগল, মেষ প্রভৃতি পশুর মাংস থেকেও মানুষের শরীরে রোগ ছড়াতে পারে, সেগুলো তো খাই আমরা। শুয়োর নিষিদ্ধ হলো কেনো? আমি তা ব্যাখ্যা করবো না। অবশ্য শুয়োর মুসলমানের জন্যে নিষিদ্ধ হওয়ায় শুয়োররা যে খুব দুঃখিত, তা নয়; তারা এসে কেন্দেকেটে বলে না যে দয়া ক’রে আমাদের খাও: লাভই হয়েছে তাদের এতে, তাদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে গেছে।
মদ্যপানও নিষিদ্ধ মুসলমানের জন্যে; তবে মদকে শুয়োরমাংসের মতো ঘেন্না করে না তারা, বরং ধনী মুসলমান খুবই ভালোবাসে অ্যালকোহল, গরিবরাও অপছন্দ করে না। মদের বিরুদ্ধে মুসলমান জগতে একটা বড়ো অপপ্রচার চলে ব’লে এই চমৎকার বস্তুটির ভাবমূর্তি বেশ নষ্ট হয়ে গেছে; এবং মুসলমান পরিবারে খামোখা গোলমাল লেগে থাকে। স্বৰ্গে মদ থাকবে, মর্তেও এটা খারাপ নয়। মদ সম্বন্ধে মুসলমানের কপটতা ভালোভাবে ধরা পড়ে বর্তমানে উৎপাদিত ‘ইসলামি বিয়ার’ ও এ-ধরনের পানীয়তে। বিয়ার হচ্ছে বিয়ার, তাতে অ্যালকোহল থাকবে; কিন্তু ধাৰ্মিক মুসলমান অ্যালকোহল খাবে না, মদের নাম খাবে। কী শোচনীয় এই নৈতিকতা। মদ মুসলমানের কল্পনাকে বেশ ভ’রে রাখে-মুসলমান মদের প্রতি বিকর্ষণ বা আকর্ষণ বোধ করে, কিন্তু কখনো ভুলে থাকতে পারে না। মদ মুসলমানের কল্পনাকে কতোখানি ভ’রে রাখে তার পরিচয় পাই বিপুল পরিমাণ আরবি ও ফারসি কবিতায়; এবং নজরুলের এ-পবিত্ৰ পংক্তিটিতে : ‘খোদার প্রেমের শারাব পিয়ে বেহুশ হয়ে রই পড়ে।’ আরবি কবিতা ও আরব্য রজনী মদের গন্ধে ভরপুর। ইসলামি পাকিস্থানে মদ্যপান সম্পর্কে খুশবন্ত সিং জানিয়েছেন যে মদ সেখানে রাভি নদীর মতো প্রবল বেগে প্রবাহিত হয় না, তবে সব ধনীর বাড়িতেই চুইয়ে চুইয়ে পড়ে। চার্লস গ্রাস (টাইমস্ লিটেরেরি সাপ্লিমেন্ট, ২২ এপ্রিল ১৯৯৪) সৌদি আরবে মদ্যপানের কপটতা সম্পর্কে লিখেছেন :