পুরুষ হচ্ছে রাজ্য; আর পুরুষদের রাজা হচ্ছে রাজারা। রাজারা যেভাবে কাম উপভোগ করেছে, তার মধ্যেই মিলে পুরুষদের কাম ক্ষুধার পরিচয়, পারলে প্রতিটি পুরুষই রাজাদের মতো মেটাতো নিজের ক্ষুধা। রাজারা চিরকালই বহু বিয়ে করেছে, রেখেছে অজস্র উপপত্নী, সেবা নিয়েছে অসংখ্য পতিতার। বহুবিবাহ কেমন রাজকীয় রূপ নিতে পারে, তার পরিচয় পাওয়া যায় হাজার বছর আগের চীনের রাজপ্রাসাদে। সেখানে নিয়ম ছিলো রাজার থাকবে ১টি রানী, ৩টি পত্নী ৯টি দ্বিতীয় শ্রেণীর পত্নী, ২৭টি তৃতীয় শ্রেণীর পত্নী, এবং ৮১টি উপপত্নী। রাজার এমন বিশাল প্ৰমোদবিভাগ চালানোর জন্যে থাকতো কয়েকজন নারী ‘কাম সচিব’। এদের দায়িত্ব ছিলো রাজা যাতে ঠিক নারীটির সাথে ঠিক দিন ঠিক সময় পর পর ঠিক মতো মিলিত হয়, তা পরিচালনা করা। ত্যাং রাজত্বকালে রাজার নারীদের সংখ্যা বেড়ে হাজারে পৌঁছে, এবং কাম সচিবদের কাজ অত্যন্ত বেড়ে যায়। হিন্দু আর মুসলমান রাজারা যখন যার সাথে ইচ্ছে হতো তারই সাথে মিলতো, চীনা রাজাদের সে-স্বাধীনতা ছিলো না, মিলতে হতো সচিবদের নিপুণ হিশেবে অনুসারে। সবচেয়ে বেশি পরিমাণে নারী সংগ্রহ ও উপভোগের জন্যে বিখ্যাত হয়ে আছে বাগদাদের বাদশারা, এবং পরে তুরস্কের অটোমান রাজারা, যাদের মহাকীর্তির নাম হারেম। অটোমান রাজাদের হারেমে থাকতো ৩০০ থেকে ১২০০র মতো রক্ষিতা, এবং তাদের দেখাশোনার জন্যে থাকতো একপাল প্রহরী, সহচর, খোজা, বস্ত্ররক্ষয়িত্রী, দাসী। সৌদি আরবের স্থপতি আবদুল আজিজেরও ছিলো ১৭টি স্ত্রী; আর জন্মেছিলো। ৫৪টি পুত্র ও ২১৫টি কন্যা।
পুরুষ কখনো একনিষ্ঠ নয়, কামে সৎ পুরুষ উপকথামাত্র। ধর্মগুলোর মধ্যে শুধু ইসলামই পুরুষের বহুকামিতা স্বীকার করে, এবং রেখেছে। পুরুষের চারটি বিয়ের বিধান, তবে নারীর জন্যে বিধান করেছে কঠোর একবিবাহ। ইসলামপূর্ব আরব নারী অবশ্য উপভোগ করতো একই সাথে একাধিক স্বামীর সংসৰ্গ, তার সে-সুখের অবসান হয় ইসলামের আবির্ভাবে। আরব ছিলো অনেকটা মাতৃতান্ত্রিক, ইসলামপূর্ব আরবে পিতৃপরিচয় গৌণ ব্যাপার ছিলো, সন্তানেরা পরিচিত হতো মায়ের পরিচয়েই। ষষ্ঠ শতকের শেষ দিকে আরবসমাজের বদল শুরু হয়েছিলো, ব্যবসাবাণিজ্যের ফলে প্রচুর ধন জন্মছিলো পুরুষদের হাতে, দেখা দিচ্ছিলো পিতৃতন্ত্র; পুরুষেরা চাচ্ছিলো তাদের ধনের উত্তরাধিকারী হবে তাদের ঔরসজাত সন্তানেরা, অন্য পুরুষের সন্তানেরা নয়। ইসলাম ওই সময়ে আরবসমাজে প্রতিষ্ঠা করে পিতৃতন্ত্র; মাতা হয়ে ওঠে গৌণ। ধর্মেও ঘটে একই ব্যাপার: অবসান ঘটে মক্কার লাত, মানত, উজ্জা নামের দেবীদের। ইসলামপূর্ব আরবে পুরুষ বিয়ে ক’রে যেতো স্ত্রীর গোত্রে, স্ত্রী থেকে যেতো নিজের গোত্রেই; এবং নারী একই সাথে কয়েকটি বিয়ে করতে পারতো, পুরুষ ও অবশ্য পারতো। ইসলাম পুরুষের বহুবিবাহ সীমাবদ্ধ করে চারটিতে, এবং নারীর বহুবিবাহ নিষিদ্ধ করে সম্পূর্ণরূপে। নারীর বহুস্বামী নিষিদ্ধ করায় শুরুতে এর বিরুদ্ধে আন্দোলনও হয়েছিলো, কিন্তু শক্তিমান ইসলাম নারীদের স্তব্ধ ক’রে দিতে দ্বিধা করে নি।
একই সাথে পুরুষের একাধিক স্ত্রী রাখা এখন অত্যন্ত নিন্দিত; এবং নারীর একই সাথে একাধিক স্বামী রাখার কথা সভ্যরা কেউ কল্পনাও করতে পারে না, যদিও তিব্বতে এটা এখনো প্রচলিত। এ-কামনির্ভর একনিষ্ঠ নৈতিকতার উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে খ্রিস্টধর্ম থেকে; একেই এখন মনে করা হয় নৈতিকতার পরাকাষ্ঠী। এক সাথে চার স্ত্রী রাখার বিধানের জন্যে ইসলাম আজকাল খুবই বিব্রত, তাই অনেক মুসলমান রাষ্ট্রে এটা নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে নানা শর্ত জুড়ে। পৃথিবী জুড়ে সবাই এখন নির্বিচারে বিশ্বাস করে যে এককালে এক স্বামী-এক স্ত্রীই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ নৈতিকতা। নৈতিকতার মানদণ্ডে কোনো কিছু বিচার করাই অনৈতিক—যুগে যুগে নৈতিক বিচার ভুল ব’লে প্রমাণিত হয়েছে, এবং তথাকথিত আধুনিক মানুষের এ-বিশ্বাস মূলত ঘোর অনৈতিক ও শিহরণজাগানো কপটতায় পরিপূর্ণ। এক স্বামী-এক স্ত্রী সংস্থার মধ্যে যেমন নেই কোনো নৈতিকতা, তেমনি কোনো অনৈতিকতা নেই এক স্বামী-একাধিক স্ত্রী, এবং এক স্ত্রী-একাধিক স্বামীর মধ্যে। আমাদের নৈতিকতাবোধ দূষিত, কেননা এর ভিত্তি কাম বা যৌনসংসর্গ। তবে কাম বা যৌনসংসর্গ পেরিয়ে গভীরে ঢুকলে দেখি যে বর্তমান নৈতিকতার ভিত্তি মালিকানা বা অধিকার। আমরা নিজেদের সম্পত্তির ওপর অন্যের সামান্যতম অধিকার যেমন স্বীকার করি না, তেমনি নারী ও পুরুষের শরীর ও কামকে মনে করি একান্তভাবে পরস্পরের সম্পত্তি; পুরুষটি ও তার দেহ ও তার কাম নারীর সম্পত্তি, আর নারীটি ও তার দেহ ও তার কাম পুরুষটির সম্পত্তি। কাম ও অধিকারভিত্তিক নৈতিকতা কোনো নৈতিকতাই নয়, তা অনৈতিকতা।
এর ভেতরে রয়েছে এক বড়ো কপটতাও। পৃথিবী জুড়ে পুরুষ প্রকাশ্যেই বহু নারী ভোগ করছে, আর নারীরাও গোপনে, যদিও পরিমাণে অনেক কম, ভোগ করছে বহু পুরুষ। ইউরোপ-আমেরিকায় নারীপুরুষ উভয়েরই বহুবিবাহ নিষিদ্ধ, কিন্তু বহুকাম নিষিদ্ধ নয়; সেখানে পুরুষ ও নারী উভয়েই একই সময়ে ও সারা জীবনে উপভোগ করছে বহু নারী ও পুরুষ। তাই একনিষ্ঠতা এক হাস্যকর কপট ধারণায় পরিণত হয়েছে; পরিণত হয়েছে বলা ঠিক হচ্ছে না, একনিষ্ঠতা কখনোই ছিলো না। কাম ও অধিকারকে নৈতিকতার ভিত্তি ক’রে মানুষ কোন অনৈতিক পাতালে নেমেছে, তার পরিচয় পাই টেস্টটিউবে শিশুপ্রজননে। এ—অসাধারণ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের মূলে রয়েছে করুণ কামভিত্তিক নৈতিকতা। মনে করা যাক স্ত্রীটি উর্বর, কিন্তু স্বামীটি অনুর্বর; এ-ক্ষেত্রে বর্তমান আবিষ্কার কোনো অজ্ঞাত পুরুষের বীর্যে ও নারীটির ডিমে টিউবে উন্মেষ ঘটাচ্ছে একটি মানুষের: তারপর সেটি ঢুকিয়ে দিচ্ছে নারীটির জরায়ুতে। আবিষ্কারটি অসাধারণ, ব্যাপারটি খুবই চমৎকার; কিন্তু সবটাই গভীরভাবে অনৈতিক। আমরা যদি উন্নত নৈতিকতার অধিকারী হতাম, কামকে ভিত্তি না করতাম নৈতিকতার, তাহলে একটি উর্বর পুরুষ দিয়ে সহজেই গর্ভবতী করতে পারতাম নারীটিকে। কিন্তু নারীর সতীত্ আমাদের টিকিয়ে রাখতেই হবে, তার ভেতর অন্য কোনো পুরুষকে আমরা ঢুকতে দিতে পারি না: স্ত্রীটি একটু সুখ পাক, তাও আমরা চাই না, কিন্তু সন্তান চাই; এবং সাথে সাথে বুেশ বড়ো একটা ব্যবসাও ক’রে নিতে চাই। এর চেয়ে শোচনীয় অনৈতিকতা আর হতে পারে না। প্রাচীন ভারত ছিলো আমাদের থেকে অনেক উন্নত নৈতিকতাসম্পন্ন: সেখানে ব্যবস্থা ছিলো ক্ষেত্ৰজ সন্তান জন্মদানের। মহাভারত-এ বিচিত্রবীর্যের ছিলো দুই স্ত্রী : অম্বালিকা ও অম্বিকা। সন্তান জন্মদানের আগেই ক্ষয়রোগে বিচিত্রবীর্যের মৃত্যু হ’লে সত্যবতী ব্যাসকে দিয়ে অম্বালিকার গর্ভে উৎপাদন করে পাণ্ডুকে, আর অম্বিকার গর্ভে ধৃতরাষ্ট্রকে। অন্য পুরুষের দ্বারা নারীর সন্তান জন্মানোই ছিলো ক্ষেত্ৰজ রীতি, ওই সন্তান পরিচিত হতো। পিতার নামেই বীৰ্যদাতা পুরুষটির পরিচয়ে নয়। তারা কামকে বড়ো ক’রে তোলে নি ব’লে তারা ছিলো উন্নত নৈতিকতাসম্পন্ন। আমাদের নৈতিকতা অনৈতিক ও কপট। বিবাহ ও পরিবার যে পরিণত হয়েছে ব্যর্থ সংস্থায়, তার মূলে এই অনৈতিক ও কপট নৈতিকতা; বর্তমান বিবাহরীতিতে নারীপুরুষ উভয়েই অসুখী। এখন পৃথিবী জুড়ে চলছে অবিশ্বাস ও অপ্রেমের সংসার। ইউরোপ আমেরিকা এখন মেনে নিচ্ছে সমকাম ও সমলৈঙ্গিক বিয়ে, চলছে স্বামীস্ত্রী বিনিময়, এবং সেখানে গোপনে চলছে সম্মিলিত বিয়ে বা কাম, ও আরো অজস্র রীতি। যদি কোনো পুরুষ একাধিক নারীর সাথে বিবাহিত বা অবিবাহিত জীবন যাপন করতে চায়, তারা সবাই যদি তাতে সুখী হয়, তাতে কারো আপত্তি থাকা উচিত নয়; এবং কোনো নারী যদি একাধিক পুরুষের সাথে বিবাহিত বা অবিবাহিত জীবন যাপন করতে চায়, তারা সবাই যদি তাতে সুখী হয়, তাতেও কারো আপত্তি থাকা উচিত নয়। তাদের ওই জীবনযাপন অন্য কাউকে ক্ষতিগ্রস্ত করে না, সুখী করে তাদের; তাই তা অনৈতিক নয়। মানুষ ক্রমশ সেদিকেই এগোচ্ছে, বর্তমানের অনৈতিক নৈতিকতা বেশি দিন তাদের বাধা দিয়ে আটকে রাখতে পারবে না। একদিন সমাজ থেকে উঠে যাবে কাম ও অধিকারভিত্তিক বিবাহ, পরিবার, ও নৈতিকতা।