পুরোনো ভারত ও গ্রিস পত্নী, উপপত্নী, ও পতিতা সম্বন্ধে যে-সিদ্ধান্তে পৌঁচেছিলো তার সারকথা বলেছিলেন দেমোসথেনেস : ‘পুরুষের কামসুখের জন্যে আছে গণিকারা; প্রতিদিনের ব্যবহারের জন্যে আছে উপপত্নীরা, আর তার সন্তান লালন ও সতী গৃহিণীর দায়িত্ব পালনের জন্যে আছে পত্নীরা।’ এ-তিন ধরনের নারীর মধ্যে পত্নীরাই পেয়েছে সবচেয়ে কম মূল্য, তারা পেয়েছে শুধু পত্নী ও সন্তানের জননী হওয়ার গৌরব। গ্রিসের পুরুষেরা শুধু উপপত্নী ও গণিকায়ই তৃপ্ত ছিলো না; তাদের কাছে প্রমোদের শ্রেষ্ঠ বস্তু ছিলো বালক। সক্রেতিসের ছিলো আলকিবিয়াদেশ নামে এক বালক প্রেমিক, যার জ্বালায় অস্থির হয়ে পড়েছিলেন দার্শনিক। উপপত্নী সব পুরুষ রাখতে পারে না, তাদের জন্যে ছিলো, এবং এখনো রয়েছে, সারিসারি পতিতা। পতিতাকে এখন পতিত মনে করা হয়, শুরুতে এমন মনে করা হতো না, তাদের স্থান ছিলো অত্যন্ত উচ্চে: পতিতারা শুরুতে ছিলো উচ্চিতা: তারা জড়িত ছিলো পবিত্র ধর্ম ও ঐশ্বর্যের সাথে। প্লাউতুস বলেছিলেন, পতিতা সমৃদ্ধ মহানগরীর মতো, অজস্র মানুষ ছাড়া যার চলে না।’ আদিপুস্তক-এ (৩৮ পরিচ্ছেদ) একটি অসাধারণ গল্প রয়েছে শ্বশুর জিহুদা আর পুত্রবধু তামর সম্পর্কে। তামারের বিয়ে হয়েছিলো জিহুদার প্রথম পুত্র এরের সাথে; এর ‘সদাপ্রভুর চোখে দুষ্ট’ বিবেচিত হওয়ায় সদাপ্ৰভু তাকে মেরে ফেলেন। এর কেনো দুষ্ট’ বিবেচিত হয় সদাপ্রভুর চোখে, তা অবশ্য বলা হয় নি বাইবেলে; তবে সম্ভবত সে ছিলো সমকামী, যে স্ত্রীর সাথে প্রথা সিদ্ধ সঙ্গম করতে চায় নি। সমকাম সদাপ্রভুর চোখে প্রচণ্ড ঘৃণা ও বিভীষিকার কাজ, তাই তাকে মেরে ফেলা হয়। এরের কনিষ্ঠ ভাই ওনন; জিহুদা ওননকে বলে, ‘তুমি আপন ভ্রাতার স্ত্রীর কাছে গমন কর, ও তাহার প্রতি দেবরের কৰ্ত্তব্য সাধন করিয়া নিজ ভ্রাতার জন্য বংশ উৎপন্ন কর।’ ওনন জানতো ভাবীর গর্ভে সে উৎপাদন করবে। যে-সন্তান, তা তার হবে না, হবে ভাইয়ের; তাই সে ‘‘ভূমিতে রেতঃপাত করিলা’। এতেও ক্ষিপ্ত হন সদাপ্রভু-তিনি খুবই ক্ষিপ্ত ব্যক্তিত্ব, খেপে উঠতে তাঁর সময় লাগে না, এবং বধ করেন। ওননকে। ওনন যা করে, তাকে আজকাল বলা হয় coitus interruptus, মুসলমানরা বলে ‘আজল’, যা ইসলামে সিদ্ধ। জিহুদার শেল নামের আরেক পুত্র ছিলো, কিন্তু সে অপ্রাপ্তবয়স্ক; তাই সে সাবালক না হওয়া পর্যন্ত জিহুদা তামরকে পিতার গৃহে গিয়ে বাস করতে বলে।
বহু দিন চ’লে যায়, পরলোকগত হয়। জিহুদার স্ত্রী; এবং জিহুদা মেষের লোম কাটার জন্যে যায় তিস্নায়। শ্বশুর আসছে জেনে তামার বিধবার পোশাক ছেড়ে মুখ আবরণে ঢেকে পথের পাশে ব’সে থাকে। জিহুদা তাকে দেখে বেশ্য মনে করে, পুত্রবধুকে চিনতে না পেরে গিয়ে বলে, ‘আইস, আমি তোমার কাছে গমন করি।’ তোমর রাজি হয় তাতে; তবে জানতে চায় মিলনের জন্যে কি পারিশ্রমিক দেবে। জিহুদা। জিহুদা পাল থেকে একটা ছাগবৎস পাঠাতে রাজি হয়, এবং কাজ সেরে বন্ধক হিশেবে তামারের কাছে নিজের ‘মোহর ও সূত্র ও হস্তের যষ্টি’ রেখে চ’লে যায়। তোমর মুখের আবরণ ফেলে আবার বিধবার পোশাক পরে। কিছু দিন পর জিহুদা বন্ধক ফেরত পাওয়ার জন্যে ছাগবৎস পাঠায়, কিন্তু কিছতেই পথের পাশের বেশ্যাটিকে আর পাওয়া যায় না। তিন মাস পর জিহুদাকে কেউ এসে বলে যে তার পুত্রবধু বেশ্যা হয়েছে, বেশ্যাবৃত্তির ফলে তার গর্ভ হয়েছে। জিহুদা সৎ মানুষের ক্ৰোধে জ্বলে উঠে বলে, ‘তাঁহাকে বাহিরে আনিয়া পোড়াইয়া দাও।’ তামারকে ধ’রে আনা হয় জিহুদার কাছে, এবং সূত্রপাত হয় এক বাইবেলীয় নাটকীয় ঘটনার। তোমর বলে, ‘যাহার এই সকল বস্ত, সেই পুরুষ হইতে আমার গর্ভ হইয়াছে।’ সে সাথে সাথে বের ক’রে দেখায় তার শ্বশুরের ‘মোহর ও সূত্র ও হস্তের যষ্টি’। জিহুদাকে স্বীকার করতে হয় যে, ওগুলো তারই। জিহুদা নিজেকে বাচানোর জন্যে বের করে এক খোড়া যুক্তি যে ‘সে আমা হইতেও অধিক ধাৰ্ম্মিকা, কেননা আমি তাহাকে আপন পুত্ৰ শেলাকে দিই নাই।’ পুরুষ চিরকাল কামকে রেখেছে নৈতিকতার ওপরে, অন্তত নিজের বেলা; এতে পৌরাণিক ও আধুনিকের মধ্যে পার্থক্য নেই; তবে পুরোনোদের নীতিবোধ ছিলো আরো শিথিল।
গ্রিক পতিতা থাইসকে মনে পড়ছে, যার তরুণ প্রেমিক ইউথিদেমুসকে নানা যুক্তি দিয়ে ভাগিয়ে নিয়েছিলেন এক দার্শনিক। দর্শন অসাধারণ জিনিশ, কাম খুবই খারাপ. এ-যুক্তি দিয়ে ওই তরুণ প্রেমিককে ভাগিয়েছিলেন কোনো এক প্লাতো বা আরিস্তাতল (মনে রাখতে পারি প্রাতো আর আরিস্ততলের ছিলো একাধিক রক্ষিতা: বিশশতকে যে-দুই দার্শনিকের, সাত্র ও বোভোয়ার, প্রেম কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছে তারাও একনিষ্ঠ ছিলেন না; সার্তের মৃত্যুর পর জানা যায় তাঁর ছিলো বেশ কয়েকটি রক্ষিতা, আর বোভোয়ারও মাঝেমাঝে ঘুমোতেন অন্যদের সাথে)। তাতে দুঃখে ভেঙে পড়েছিলো পতিতা থাইস; এবং লিখেছিলো। এ-পত্রটি :
যখন থেকে তুমি দর্শন পড়া শুরু করেছে। সে থেকেই তুমি অবজ্ঞা করছে! আমাদের মন্দিরকে। সে থেকে তুমি বেশ গর্বে এবং হাতে বই নিয়ে যাচ্ছে অ্যাকাডেমিতে, হেঁটে যাচ্ছে আমার বাড়ির পাশ দিয়ে যেনো তুমি কখনো চোখ ফেলো নি। এ-বাড়ির ওপর। তুমি পাগল হয়ে গেছে, ইউথিদেমুস: তুমি কি জানো না। ওই দার্শনিকটি, যে আমন গম্ভীর মুখে তোমার উদ্দেশে বর্ষণ করে ওইসব বিস্ময়কর বক্তৃতা, সে কী ধরনের মানুষ? তুমি কি জানো ওই লোক আমার সাথে সাক্ষাতের জন্যে চেষ্টা ক’রে আসছে কতোখানি? আর সে কতোখানি পাগল মেগারার পরিচারিকা হারপিলিসের জন্যে? তবে আগে তাকে আমি গ্ৰহণ করতাম না, ওই দার্শনিকের সোনার বদলে তোমাকে বাহুতে জড়িয়ে ধ’রেই ঘুমোতে পছন্দ করতাম আমি। তবে সে যখন আমার ভালোবাসা থেকে তোমাকে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, আমি এখন তাকে আসতে দেবো; এবং যদি তুমি চাও তাহলে আমি তোমাকে দেখতে দেবো যে তোমার নারীবিদ্বেষী বিদ্যালয়শিক্ষক শুধু রাতের স্বাভাবিক প্রমোদেই সন্তুষ্ট নয়। তুমি কি মনে করো যে দার্শনিক গণিকার থেকে উত্তম? যখন কেউ গণিকার সাথে থাকে সে কখনো স্বৈরাচারীর ক্ষমতা চায় না, বা দ্ৰোহ সৃষ্টি করে না রাজ্যে।…বিধাতা আমাদের বেশি আয়ু দেন নি: ঘুম থেকে জেগে তুমি দেখো না যে তুমি নিজেকে অপচয় ক’রে ফেলেছো ধাঁধা এবং বাজেকথায়। বিদায়।