কাম নিয়ে শুরুতে মানুষের বিশেষ উদ্বেগ ছিলো না; কামকে তারা তখন নৈতিকতার মানদণ্ডে পরিণত করে নি, পুরুষ ও নারী উভয়েই এটা উপভোগ করেছে অপরাধবোধে না ভুগে। কিন্তু যেই দেখা দিতে থাকে সম্পত্তি ও সম্পত্তির অধিকার, পুরুষ ক্ৰমশ হয়ে উঠতে থাকে প্ৰভু, বুঝতে পারে সন্তান উৎপাদনে তার ভূমিকা, তৈরি করে কতকগুলো কৃত্রিম সংস্থা-বিয়ে, পরিবার, সমাজ, তখনই কাম হয়ে উঠতে থাকে মানুষের বড়ো উদ্বেগ, স্বৰ্গচ্যুতি ঘটে মানুষের। এর আগে নারী কাম উপভোগ করেছে দেহপ্রাণভরে; কিন্তু পুরুষ বিয়ে, পরিবার, সমাজ তৈরি ক’রে ছিনিয়ে নেয় নারীর কামসুখ, তাকে ভেঙেচুরে বিন্যস্ত করে নিজের নিচে, কিন্তু খোলা রাখে নিজের কামসুখের সমস্ত দরোজা ও সারণী। পুরুষ নিজের জন্যে রাখে বহুপত্নী, অজস্র উপপত্নী, এবং অসংখ্য পতিতা। পুরুষ থেকে যায় বহুগামী, কিন্তু ভুলতে পারে না যে নারীও ছিলো বহুগামী, এবং তার বহুগামিতার শক্তি পুরুষের থেকে অনেক বেশি। তাই পুরুষ মেতে ওঠে নারীনিন্দায়; বলে নারী হচ্ছে জরায়ুর মুখ, যে নিজের তৃপ্তির জন্যে মিলিত হয় শয়তানের সাথেও; বলে নারী হচ্ছে অভিচারিণী, ডাইনি, কির্কি, সাইরেন; বলে স্ত্রীলোক স্বভাবতই রতিপ্রিয়, পুরুষসংসর্গ তাদের যেমন প্রীতিকর দেবতারাও তাদের কাছে তেমন প্রীতিকর নয়; বলে নারী নরকের দরোজা; বলে নারী আর আগুনের ক্ষুধাই শুধু কখনো মেটে না। এটা ঠিক যে নারীর উপভোগশক্তি পুরুষের থেকে অনেক বেশি; কিন্তু পুরুষের সভ্যতা নারীকে বিকল ক’রে অবারিত ক’রে রাখে পুরুষের ভোগের পথ। পুরুষ নিজের সুবিধা ও সুখের জন্যে সৃষ্টি করে একনিষ্ঠতা, সতীত্ব নামে নানা নৈতিক ধারণা; তবে পুরুষ কখনোই একনিষ্ঠ আর সৎ থাকে নি, কিন্তু নারীকে বাধ্য করেছে একনিষ্ঠ ও সতী থাকতে, এবং সব সময়ই সন্দেহ করেছে নারীর সতীত্ সম্পর্কে। পুরুষ হচ্ছে সব ধরনের নৈতিক ধারণার স্বাপ্লিক ও প্রণেতা, আর নারী তার দণ্ডভোগী। উনিশশতকে ভিক্টোরীয়রা নিজেদের সুবিধার জন্যে নারীর ভাবমূর্তি বদলে দিয়ে রটাতে থাকে যে নারী স্বভাবতই একনিষ্ঠ, তার কামও কম; কিন্তু মানুষ, নারী ও পুরুষ, কখনোই একনিষ্ঠ নয়। আমি কয়েকজন নারীর সাথে কথা ব’লে দেখেছি;—তারা হেসেই উড়িয়ে দেন নারীর একনিষ্ঠতার ধারণা, জানান যে বাধ্য হয়েই তারা একনিষ্ঠ, যদিও তাদের স্বামীরা বহুগামী। এক তরুণী, যার প্রথম বিয়ে ভেঙে যায় কয়েক মাসেই, এবং দু-মাসের মধ্যেই আরেকটি বিয়ে করে, তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম দুটি পুরুষের সাথে সংসর্গে তার মনে কোনো অপরাধবোধ জেগেছে কি না। তরুণী হেসে উঠে বলে- কী যে বলেন, স্যার, এতেই তো মজা। সম্প্রতি পত্রিকায় একটি সংবাদ বেরিয়েছে বাঙলাদেশেরই পল্লীর এক তরুণী সম্পর্কে, যে একই সাথে দুটি বিয়ে ক’রে কিছু দিন থাকছিলো এক স্বামীর সাথে এবং কিছু দিন অন্যজনের সাথে। একনিষ্ঠতা তার কাছে কোনো ব্যাপারই নয়; বুঝতে পারি দ্বিনিষ্ঠ হয়েই সে পাচ্ছিলো তার কাম্য সুখ। কিন্তু সমাজ এটা মেনে নিতে পারে না; তবে তার ভাগ্য ভালো সমাজ তাকে বেশি শান্তি দেয় নি।
পুরুষ কামের দাস, কাম চরিতাৰ্থ করার জন্যে সে সব সময় ব্যগ্ৰ; কিন্তু তার মনে কাম জাগায় পাপবোধ: কাম তার কাছে পাপ। এ-পাপবোধকে তীব্ৰ ক’রে তুলেছিলেন খ্রিস্টান সন্তরা; কাম তাদের কাছে চরম পাপ।। সন্তরা নিজেরা অবশ্য চিরকৌমাৰ্যব্রত পালন করেন নি; যৌবনে প্রচুর কামে ক্লান্ত হয়ে ঘেন্না ধ’রে যায় তাদের, তারপর যুদ্ধ ঘোষণা করেন। কামের বিরুদ্ধে; এবং এক সময় গির্জা তাদের অভিষিক্ত করে সন্ত হিশেবে। সন্ত পলের মতে সব ধরনের যৌনসংসর্গ, বিবাহিতই হোক আর অবিবাহিতই হোক, পাপ। এর প্রভাব পড়েছিলো ব্ৰাহ্মদের, এমনকি তলস্তয় আর গান্ধির ওপরও। উনিশ শতকে কিছু ব্ৰাহ্ম স্বামী-স্ত্রী ঠিক করেছিলো তারা জীবনে আর কখনো সঙ্গম করবে না, থাকবে ভাইবোনের মতো। তলস্তয়, যিনি যৌবনে মনে করতেন রূপসী তরুণী উপভোগ পাপ নয়, স্বাস্থ্যের লক্ষণ, আর গান্ধি, দু-তিনটি তরুণী ডাক্তারের সঙ্গ ছাড়া যিনি সুস্থ থাকতেন না, বুড়ো বয়সে সিদ্ধান্তে পৌঁছেন সঙ্গম খুবই খারাপ কাজ। ক্লান্ত বুড়োদের মগজে দেখা দেয় কতোই না বিকৃতি। সন্ত পালের মতে কৌমার্য স্বৰ্গীয়। রাসেল বলেছেন সন্তরা স্বৰ্গীয় কৌমার্য টিকিয়ে রাখার জন্যে গিয়ে আশ্রয় নিতেন মরুভূমিতে, যুদ্ধে লিপ্ত থাকতেন। শয়তানের সাথে, যে তাদের কল্প লোক ভ’রে দিতো বিচিত্র ধরনের কামোদ্দীপক দুঃস্বপ্নে। সন্ত জেরোম জানিয়েছেন কেমন কামযন্ত্রণায় কাটতো তার সময় চলসিসের মরুভূমিতে, কামযন্ত্রণায় দেখতে পেতেন তার সামনে নাচছে দলে দলে তরুণী। টমাসের মতে মানুষের প্রধান কাজ বিধাতাকে ভালোবাসা, দ্বিতীয় কাজ প্রতিবেশীদের অল্পসল্প ভালোবাসা। তিনি অবিবাহিত সঙ্গম নিষিদ্ধ করেন, কেননা সন্তানদের পিতামাতার সাথে থাকা দরকার। প্রকৃতিবিরুদ্ধ ব’লে তিনি নিষিদ্ধ করেন জন্মনিয়ন্ত্রণ: তবে তিনি চিরকৌমার্য নিষিদ্ধ করেন নি। তিনি নির্দেশ দেন একবিবাহের; কেননা পুরুষের বহুবিবাহ নারীদের প্রতি অন্যায়, আর নারীদের বহুবিবাহ সৃষ্টি করে পিতৃত্ব সম্বন্ধে অনিশ্চিত। তিনি ভাইবোনের অজাচার নিষিদ্ধ করেন এ-যুক্তিতে যে এতে স্বামীস্ত্রী ও ভাইবোনের ভালোবাসা মিলে এমন আবেগ সৃষ্টি করবে। যে তারা সারাক্ষণ লিপ্ত থাকবে সঙ্গমে। সংসর্গ পাপ, কিন্তু পাপ যে কোথায় শুরু হয় খ্রিস্টান গির্জা তা ঠিকমতো শনাক্ত করতে পারে নি। খ্রিস্টান গির্জা চুম্বন, আলিঙ্গন, মর্দনকে বিশেষ সীমা পর্যন্ত নিষিদ্ধ মনে করে না। এক ক্যাথলিক ধর্মযাজক বিধান দিয়েছিলেন যে স্বীকারোক্তির সময় পুরুষ ধর্মযাজিকার স্তনযুগল মর্দন করতে পারে, যদি তার কোনো খারাপ উদ্দেশ্য না থাকে। খ্রিস্টান সন্তরা মুখর ছিলেন সঙ্গমের নিন্দায় : অগাস্টিনের মতে সঙ্গম মূলতই ঘেন্নার ব্যাপার; আরনোবিউসের মতে এটা নোংরা ও হীন কাজ; তার তুলিয়ানের মতে সঙ্গম লজাজনক। সন্তরা বিস্মিত হয়ে ভাবতেন সন্তান জন্মানোর এমন নোংরা। উপায়ের বদলে বিধাতা কেনো বের করলেন না কোনো উৎকৃষ্টতর উপায়। বিধাতা কি করতে পারেন এমন নোংবা কাজ? না, এর জন্যে বিধাতার কোনো দোষ নেই; সন্তারা ভেবে বের করেন যে সব দোষ আদম ও হাওয়ার।