খুব ক্ষতিকর একটি বিশ্বাস দু-হাজার বছর ধ’রে প্রশংসিত ও জনপ্রিয় যে মানুষের জীবনের থাকা উচিত একটা আদর্শ, মানুষকে জীবন যাপন করা উচিত আদর্শ অনুসারে: তার জীবনের লক্ষ্যই হওয়া উচিত ওই আদর্শের বাস্তবায়ন। কিন্তু প্রতিটি আদর্শই কারাগার; কোনো আদর্শকে পরম মনে করা হচ্ছে কারাগারকে পরম মনে করা। আদর্শের শেষ নেই পৃথিবীতে, অজস্র আদর্শ ছড়ানো পথেঘাটে, পৃথিবী জুড়ে দশকে দশকে মাতারা জন্ম দিচ্ছেন বিচিত্র আদর্শের জনকদের; তাদের সবারই উদ্দেশ্য নিজেদের কারাগারে সবাইকে চিরকালের জন্যে আটকে ফেলা। অন্যদের আটকে ফেলে, নিজেদের কারাগারে রেখে পীড়ন ক’রে, সুখ পায় একদল মানুষ। আদর্শগুলোর মুখে অবশ্য চমৎকার কারুকাজকরা মুখোশ থাকে, মুখোশের আড়ালের হিংস্র কুৎসিত মুখটিকে দেখা যায় না, মনে হয় মুখোশের আড়ালে আছে অপার্থিব সুন্দর মুখ; কিন্তু মুখোশ সরিয়ে নিলেই কুৎসিত মুখ দেখে কেঁপে উঠতে হয়। ধর্মগুলো জীবনযাপনের আদর্শের কারাগাররূপে বন্দী ক’রে ফেলতে পেরেছে। মানুষকে; মানুষ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে সব ধরনের কারাগারের মধ্যে নিকৃষ্টতম কারাগারগুলো। এটা ঘটেছে এজন্যে যে ধর্মগুলোই সবচেয়ে দক্ষতার সাথে সবচেয়ে উচু এবং সবচেয়ে প্রশস্ত দেয়ালের কারাগার তৈরি করতে পেরেছে। কারাগারে বাস করার মধ্যে যেমন নেই কোনো মহত্ত্ব, তেমনি আদর্শের মধ্যে থাকাও সম্পূর্ণ মহত্ত্বহীন। কিন্তু মানুষকে দীক্ষিত করতে পারলে তারা কারাগারের স্তুতিতেও মুখর হয়ে উঠতে পারে, বিশ্বাস করতে পারে যে কারাগারই স্বৰ্গ, দাবি করতে পারে যে আমাদের কারাগারই সত্য ও শ্রেষ্ঠ; তাই সবাইকে ঢুকতে হবে আমাদের কারাগারে। মানুষ জীবন যাপন করার জন্যে জন্মেছে, তার জীবনের কোনো লক্ষ্য নেই।-কোনো থাকবে?-জীবন যাপনই তার লক্ষ্য, বিশেষ আদর্শযাপন জীবনের লক্ষ্য নয়। জীবন হচ্ছে বিস্তৃত, দিগন্ত থেকে দিগন্তে ছড়ানো প্রান্তর, তাতে আছে অপরিমিত আলো বাতাস জল রোদ বৃষ্টি ছায়া মাটি মাধুর্য; আদর্শ হচ্ছে ছিদ্ৰহীন দেয়ালের পরাক্রান্ত বেষ্টনি। আদর্শের ভেতরে যারা আছে, তারা অসুস্থ; হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান, ইহুদি, বৌদ্ধ, শিখ, বাহাই, কাদিয়ানি, ফ্যাশিবাদী, মৌলবাদী, কঠোর সাম্যবাদী অসুস্থ। ক্যালিগুলার একটা আদর্শ ছিলো, যেমন ছিলো মুসোলিনি, হিটলার, স্তালিন, ও আরো অনেকের, যেমন আছে একনায়কদের; আমরা জানি সেগুলো মানুষের জন্যে কতো মর্মান্তিক। জীবনকে যে কয়েকটি সরল সূত্রে পরিণত করেছে, জীবনে যে শুধু দেখতে চায় ওই সূত্রগুলোর কাজ, সে সুস্থ নয়; আর যারা ওই সূত্রানুসারে বেঁচে থাকে, তারাও সুস্থ নয়। তারা মানুষ নয়, তারা খচ্চর।
আদর্শগুলো বিধিবিধান বা প্রথা ছাড়া আর কিছু নয়; ওগুলোর কাজ বিশেষ ধরনের সমাজ টিকিয়ে রাখা। ওগুলো মানুষকে খুঁজতে দেয় না নিজের পথ, বের করতে দেয় না তার নিজের নিরর্থক জীবনের তাৎপর্য। মানুষ তাই বলি হয়ে গেছে বিশেষ ধরনের সমাজ, রাষ্ট্র, সংস্কৃতি, ও পরিবারের; মানুষের একান্ত মানবিক ব্যাপারগুলোও হয়ে উঠেছে ক্লান্তিকর। তাই সব কিছু ব্যর্থ হয়ে গেছে মানুষের : তার কাম, বিয়ে, পরিবার, সন্তান সবই পর্যবসিত হয়েছে ব্যর্থতায়। সমাজ, রাষ্ট্র, সভ্যতা আরো পরের ব্যাপার ব্যক্তির জীবনে, সেগুলো সম্মিলিত ক্রিয়াকাণ্ড; সেগুলোর ব্যর্থতা তো আরো শোচনীয়, কিন্তু মর্মান্তিক হচ্ছে প্রতিটি নারীনরের কাম, বিয়ে, পরিবার, সন্তান নিয়ে ব্যর্থতা। প্রতিটি মানুষের-নারী ও নরের—মুখের দিকে তাকালে চোখে পড়ে ব্যর্থ তার কাম, ব্যর্থ তার বিয়ে, ব্যর্থ তার পরিবার, ব্যৰ্থ তার সন্তান। মানুষ যে-সব মহৎ ব্যাপার গ’ড়ে তুলেছে বিবাহ, পরিবার, সন্তান নামে, সেগুলো গ’ড়ে উঠতো না, যদিও না থাকতো তার সুন্দর ভয়াবহ অশ্লীল কাম; বিয়ে, পরিবার, সন্তান তার কামের সৃষ্টি। তবে কাম ও সন্তান জৈবিক, বিয়ে ও পরিবার জৈবিক নয়, সামাজিক; কাম থেকে জন্মে তার সন্তান, সমাজ থেকে জন্মে বিয়ে ও পরিবার। কাম ও সন্তান অকৃত্রিম, বিয়ে ও পরিবার কৃত্রিম। কামের রূপ সর্বত্র অভিন্ন, কিন্তু বিয়ে ও পরিবারের রূপ বিভিন্ন। বিবর্তনের ফলে যেদিন উদ্ভব হয়েছিলো কামের, সেদিন থেকেই শুরু হয়েছে মানুষের যন্ত্রণা; ধর্মীয় বিশ্বাসে ঘটে একই ব্যাপার-কামই হচ্ছে নরনারীর জন্যে নিষিদ্ধ। গন্ধম। বিজ্ঞানীদের ধারণা দু-বিলিঅন বছর আগে আবিষ্কৃত হয়েছিলো কাম। তার আগে বিভিন্ন জৈববস্তু এলোমেলো পরিব্যক্তি অর্থাৎ জিনগুলোর প্রকৃতিবাদলের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি করতো অবিকল নতুন জৈববস্তু; কিন্তু কাম বিকাশের পর সব কিছু বদলে যায়। আধুনিক বিশ্বের সব কিছু–সন্তান, কবিতা, নভোযান, কম্পিউটার–জন্মেছে কাম থেকে; সব কিছুই শক্তিমান সুন্দর অশ্লীল কামের আত্মজ।
বোকাচ্চিওর দেকামেরন-এর একটি গল্প, কীভাবে শয়তানকে নরকে পুরতে হয়’, মনে পড়ছে। অসাধারণ তাৎপর্যপূর্ণ মজার গল্প এটি। এক তরুণ সন্ন্যাসী সাধনা ক’রে চলছিলেন গুহায়, সেখানে এসে উপস্থিত হয় এক সরল রূপসী নিষ্পাপ তরুণী, যে নিজেকে সমর্পণ করতে চায় ক্রাইস্টের পায়ে। স্বৰ্গে আদমের যে-অবস্থা হয়েছিলো, তাই হয় তরুণ সন্ন্যাসীর; কয়েক দিনের মধ্যে জেগে ওঠে। শয়তান—তার কাম। কামে সন্ন্যাসী থারথার কাঁপতে থাকেন। নিষ্পাপ তরুণী জানতে চায়—কী হয়েছে, সন্ন্যাসী, আপনি কাপছেন কেনো? সন্ন্যাসী বলেন-আমার ভেতর শয়তান জেগে উঠেছে, তাই কাপছি আমি। তরুণী জানতে চায়-কোথায় শয়তান, সন্ন্যাসী? সন্ন্যাসী তরুণীকে দেখিয়ে দেয় উত্তেজিত পাপিষ্ঠ শয়তানকে। তরুণী জানতে চায়-প্ৰভু, আমি কী করতে পারি, আমাকে বলুন। সন্ন্যাসী বলেনশয়তানকে নরকে পুরতে হবে, তাহলেই শান্তি পাবো। আমি, সুখী হবেন ক্রাইস্ট। তরুণী বলে-নরক কোথায় পাবো, সন্ন্যাসী? সন্ন্যাসী তরুণীকে দেখিয়ে দেয় যে নরক রয়েছে তার নাভিমূলের নিচে। তরুণী বলে—তাহলে আপনি শয়তানকে নরকে পুরুন } সন্ন্যাসী ও তরুণী কয়েক দিন ধ’রে দিনরাত শয়তানকে নরকে পুরে শাস্তি দিতে থাকে, দাউদাউ জুলতে থাকে নরক পুরতে থাকে শয়তান। অবিরাম নরকে জুলে নিস্তেজ হয়ে পড়ে শয়তান, সে আর যন্ত্রণা দিতে পারে না; কিন্তু তরুণী আবেদন জানাতে থাকে-সন্ন্যাসী, শয়তানকে নরকে পুরুন, আমার নরক জুলছে। আর না পেরে গুহা ছেড়ে পালাতে থাকেন তরুণ সন্ত; তার পেছনে পেছনে দৌড়োতে থাকে তরুণী, এবং চিৎকার করতে থাকে-হে সন্ন্যাসী, আপনার শয়তান তো শাস্তি পেয়ে শান্ত হয়েছে, কিন্তু আমার নরক যে জুলছে। ওই তরুণ হয়তো পরে হয়ে উঠেছিলেন কামবিদ্বেষী কোনো সন্ত: কোনো সন্ত পল, বা কোনো সন্ত টমাস।