কিন্তু আমার মতো সবার মনে হয় না; তারা শ্রদ্ধাভক্তি ক’রে সুখী হন। বাঙলা ভাষা এক সময় সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিলো জিন্নাহ বা কায়েদে আজমকে আশ্রয় ক’রে;-কবি, প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক, নাট্যকাররা পাগল হয়ে গিয়েছিলেন ওই ব্যক্তির অলৌকিক মহিমায়। তারা ওই ভদ্রলোকের এতো স্তুতি রচনা করেছিলেন, যা অনেক আর্য দেবতারও ভাগ্যে জোটে নি। আবুল ফজল, পরে যিনি জাতির বিবেক ব’লে গণ্য হন এবং আরো পরে যিনি বিবেকচুৰ্য্যত হয়ে এখন কাটাচ্ছেন নির্বাসনের কাল, একটি নাটক লিখেছিলেন মোহাম্মদীতে। পুরোনো ওই পত্রিকাটি আমি পেয়েছিলাম। আমাদের বাসার পুরোনো বইপত্রের মধ্যে; কায়েদে আজমকে নিয়ে লেখা নাটকটি পড়ে চঞ্চল হয়ে উঠেছিলাম। আমি। কী শোচনীয় সামান্য মানুষদের স্তব ক’রে। স্তবের মধ্য দিয়ে তারা নিজেদের মধ্যে অনুভব করেন তাদের দেবতাদের মহিমা, অর্থাৎ শক্তি। আমার সামনে এখন একটি লেখা প’ড়ে আছে ‘আধুনিক জগতের অন্যতম বিস্ময় : কায়েদে আজম’ নামে, লেখক ইব্রাহিম খা। এভাবেই বিস্মিত হন আমাদের লেখকেরা, স্তুতি করেন রাজনীতিক বীরদের। লেখকদের কতোটা পতন ঘটতে পারে তা পাকিস্থানপর্বের বাঙালি মুসলমান লেখকদের লেখা পড়লে চমৎকার বোঝা যায়। সুফিয়া কামাল ঈদ আর কায়েদে আজম নিয়ে হয়তো শতাধিক পদ্য লিখেছিলেন; তাঁর পদ্যের নাম ‘হে মহান নেতা’, ‘হে সিপাহসালার’, ‘হে মশালধারী’, ‘হে অমর প্রাণী’, ‘নির্ভীক মহাপ্ৰাণ’ ইত্যাদি। তিনি লিখেছিলেন এ-ধরনের চরণমালা :
তসলীম লহ, হে অমর প্রাণ! কায়েদে আজম! জাতির পিতা!
মুকুটবিহীন সম্রাট ওগো! সকল মানব-মনের মিতা।
তোমার মুখের কালাম শুনিল; আজাদ। আমরা আজাদ জাতি!
নিমিষে দাঁড়াল ঝাণ্ডা উড়ায়ে; সম্মুখে আঁধার গহীন রাতি। [‘হে আমার প্রাণ’]
কায়েদে আজম! আমরা তোমার দান,
শির পাতি নিয়া বক্ষঃরক্তে রাখিয়াছি সম্মান। [‘হে সিপাহসালার’]
কী শোচনীয় অর্থবিরহিত শূন্যগর্ভ স্তবস্তুতি। এখানে এসে পড়ে বিশ্বাসের ব্যাপারটি, এবং জানিয়ে দেয় বিশ্বাস কতো স্বল্পায়ু, কতো হাস্যকর। মহিলাকবি ওপরের ছ-পংক্তিতে যা লিখেছেন, তা কবিতা হয়ে ওঠে নি, কতকগুলো পুরোনো মরচেপড়া আবেগ সাজিয়েছেন তিনি এগুলোতে, কিন্তু বুঝতে পারি তাঁর আবেগ উঠে এসেছে তার বিশ্বাস থেকেই। তিনি নিশ্চয়ই মিথ্যে কথা বলেন নি, নিশ্চয়ই তিনি বিশ্বাস করতেন যে ওই ভদ্রলোক ‘জাতির পিতা’, বিশ্বাস করতেন, ‘কায়েদে আজম! আমরা তোমার দান’। কিন্তু বিশ্বাস খুবই করুণ ব্যাপার; তিনি নিশ্চয়ই এখন আর এ-বিশ্বাস পোষণ করেন না। তবে এখনো তিনি বিশ্বাস করেন জাতির পিতায়, শুধু ব্যক্তিটি ভিন্ন, ঠিক যেমন ঘটেছে মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসের বেলা:-যখন তারা এক দেবতা ছেড়ে বিশ্বাস। এনেছে আরেক দেবতায়।
আমি রাজনীতিক দেবতায় বা বিধাতায় বা মহানায়কে বা নেতায় বিশ্বাস করি না। অতিজাগতিক বিধাতাদের মতো রাজনীতিক বিধাতাদের কাজও মানুষকে বন্দী ক’রে ফেলা, তাদের নিজেদের বন্দনাকারীতে পরিণত করা। রাজনীতিক বিধাতারা তুচ্ছ মানুষ আমার কাছে; আমি জানি তাঁরা শক্তিমান, কিন্তু শক্তির স্তব করার মতো শোচনীয়তা আর নেই। আমি যাদের স্তব করি, স্তব নয়—যাদের প্রতি অনুরাগ বোধ করি, তারা কেউ রাজনীতিক দেবতাদের মতো বাহ্যিক শক্তিধর নন। রাজনৈতিক নেতারা আন্তর প্রতিভাসম্পন্ন নন, তাঁদের সবটাই বাইরের, ভেতরে কিছু নেই; বিশেষ পরিস্থিতিতে তাঁরা হঠাৎ বিশাল আকারে দেখা দেন; ভিন্ন পরিস্তিতিতে তাঁরা অনেকেই চোখের আড়ালে থেকে যেতেন। পৃথিবী চিরকাল চতুর্থপঞ্চম শ্রেণীর মানুষদের দিয়ে শাসিত হয়েছে, যদিও তাদের কেউ কেউ রাজ্য স্থাপন করেছেন, জয় করেছেন মহারাজ্য, এমনকি এনে দিয়েছেন স্বাধীনতা। কিন্তু স্বাধীনতা কি কখনো একজন রাজনীতিক এনে দিতে পারেন? পৃথিবী জুড়েই দেখা যাচ্ছে যে অধিকাংশ রাজনীতিকই দুৰ্বত্ত; ক্ষমতা দখল করার পর আর তারা ক্ষমতা ছাড়তে চান না, মানুষকে অশেষ দুৰ্দশায় তলিয়ে দিয়ে তারা উপভোগ করেন। মধ্যযুগীয় সম্রাটের জীবন, তাদের অবৈধ ধন ও নারীর কোনো হিশেবে নেই; কিন্তু তারা করেন অতিমানবিক আচরণ, সাধারণ মানুষের কাছে তারা দাবি করেন। বিধাতার মর্যাদা। অধিকাংশ রাজনীতিক, যাদের মৃত্যুতে সাত দিন ধ’রে শোক পালন করা হয়, ঝুলিয়ে রাখা হয় পতাকা, পরে স্মৃতিসৌধ তোলা হয়, তাদের মৃত্যুতে সামান্য ও শূন্যতা সৃষ্টি হয় না সমাজে। তারা সাধারণত বিশেষ কোনো কাজের যোগ্য নন। বাজারের চর্মকারটি মারা গেলে বাজারে একটা শূন্যতা দেখা দেয়, বহু লোক জুতো শেলাই করাতে এসে ফিরে যায়, তাদের জীবনে কিছু সময়ের জন্যে হ’লেও বিপর্যয় দেখা দেয়; কিন্তু একজন নেতার মৃত্যুতে তেমন কোনো শূন্যতা দেখা দেয় না। ওই নেতা জুতোও শেলাই করতে পারতেন না, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বর্ণমালা বা সরল অংক শেখানোর যোগ্যতাও তার ছিলো না, তিনি আসলে সমাজের কোনো প্রকৃত কাজেই লাগেন নি। কিন্তু তিনি ছিলেন খুবই শক্তিধর; এবং তাঁর মৃত্যুর পর আমরা সাত দিন শোক পালন করি, যদিও শোক পালন করা উচিত বাজারের চর্মকারটির মৃত্যুতে। রাজনীতিকদের মতো আন্তর গুণহীন লোক সমাজে আর নেই। মানুষের দুর্ভাগ্য আন্তর গুণহীন মানুষেরাই শাসন করে মানুষকে।