মানুষ অজস্র ব্যাপার মেনে চলে, বা মেনে চলতে বাধ্য হয়, যেগুলোকে তারা ধ্রুব মনে করে, বিশ্বাস করে বা বিশ্বাস করতে বাধ্য হয় যে, ওগুলোর মধ্যে রয়েছে। মহত্ত্ব। তবে ওগুলোতে নেই কোনো মহত্ত্ব বা ধ্রুবতা, সব বিশ্বাসই অচিরজীবী ও অসার; ওগুলোর বড়ো অংশই আদিম পুরোনো কিছু মানুষের খামখেয়াল বা স্বার্থ বা বিশ্বাসের বাস্তবায়ন। কিছু মানুষ সব সময়ই হয় আত্মগবী উন্মাদ, যারা চায় অন্যদের জীবনকে নিজের চিন্তার মাপে কাটতে ও শেলাই করতে; তাই অধিকাংশ মানুষ নিজেদের জীবন যাপন করতে পারে না, করে পরের জীবন যাপন, কিছু প্রাচীন মানুষের পরিকল্পিত উদ্ভট জীবন। জীবনযাপনে মানুষ প্রাচীন উদ্ভট পরিকল্পনার বন্দী: পুরোনো কালের কিছু মানুষ হাত-পা বেঁধে সাতার কাটার জন্যে ছেড়ে দিয়েছে আধুনিক কালের মানুষদের। তাই মানুষ ভালো নেই, মানুষের অবস্থা খুবই খারাপ; মানুষ যাপন করছে পোকার জীবন। মানুষের সবচেয়ে বড়ো রোগ অবশ্যই দারিদ্র্য, ওই দারিদ্র্যও সৃষ্টি করেছে মানুষ; তবে দারিদ্র্য পেরিয়ে গিয়ে পরিবার, সমাজ, সংস্কৃতি, রাষ্ট্র, সভ্যতায় মানুষ যে-জীবন যাপন করে, তা মানুষকে অসুস্থ অসুখী ছাড়া আর কিছু করতে পারে না। সমাজ, পরিবার, রাষ্ট্র, সভ্যতা একরাশ হাস্যকর বিধিবিধানের সমষ্টি, জমকালো কুচকাওয়াজের মতোই হাস্যকর, তাতে প্রচুর রয়েছে উচ্চরোল, অভিবাদন, দৃঢ় পদক্ষেপ; কিন্তু সবটাই অসার। বিধিবিধান মানুষের স্বভাববিরোধী, কিন্তু বিস্ময়কর হচ্ছে মানুষই তৈরি করেছে বিধিবিধান, আর কোনো প্ৰাণী করে নি। তবে মানুষ কখনোই আন্তরিকভাবে মেনে নেয় নি বিধিবিধান; সাধারণত যারা বিধান তৈরি করে, সেই শক্তিমানদের প্রথম কাজই হয় বিধান ভাঙা, কিন্তু তারা বিধান দিয়ে বেঁধে ফেলে অধিকাংশ মানুষকে। মানুষ ভালো নেই; মানুষের মুখের দিকে তাকালে কারো মুখে আমি ভালো থাকার ছাপ দেখি না;-আরিস্ততলের মুখে দেখতে পাই ভালো না থাকার দাগ, যাজ্ঞবল্কের মুখেও দেখি, সম্রাট ও দসু্যদের মুখে দেখি ওই দাগ, রবীন্দ্রনাথের মুখেও দেখি; ফেরিঅলার মুখেও দেখতে পাই একই দাগ-মানুষ ভালো নেই। আমার মুখেও দেখি একই দাগ।
জীবনে মানুষ জীবন যাপন করে না; যাপন করে অন্য কিছু জীবনযাপনের নামে মানুষ ক’রে চলছে প্রথাযাপন। প্রথা জীবনের শত্ৰু, প্রথা জীবনকে নিরক্ত ক’রে তোলে, তার ভেতর থেকে শুষে নেয় প্রাণ; কিন্তু প্রথায় অভ্যস্ত হয়ে গেলে প্রথাকেই মনে হয় জীবন। অধিকাংশ মানুষ প্রথা যাপন ক’রে গৌরব বোধ করে যে তারা জীবন যাপন করছে। প্রথার হাত এমন তুষারশীতল যে তার ছোয়ায় একান্ত মানবিক উষ্ণ ব্যাপারগুলোও তুষারিত হয়ে যেতে পারে, তাতে আর থাকে না। কোনো মানবিক তাপ। যে-সমাজে প্রথার পরিমাণ যতো বেশি, তার মানুষ ততো মৃত, নিরক্ত, অসুস্থ, বিকৃত, ততো প্রতিভাহীন; সেখানে দিকে দিকে দেখতে পাওয়া যায় লাশ, দেখা যায় বিকৃত অসুস্থ মানুষ। প্রথার বাইরে গেলে মানুষ সুস্থ ও সৎ হয়ে ওঠে, কমে তার কপটতা; তখন সে মানুষ হয়ে ওঠে। প্রথা হচ্ছে সে-সমস্ত বিধান, যেগুলোর কোনো অন্তঃসার নেই, কিন্তু মেনে চলতে বাধ্য হয় মানুষ। প্রথা জীবনের মৃতরূপ, জীর্ণ লোকাচার, স্রোতহীনতা, শৈবালোচ্ছন্নতা। প্রথাগুলো, সাধারণত, মানুষ পায় ধর্ম থেকে; জীবনকে প্রথায়, নিরর্থক রীতিতে, পরিণত করাই ধর্মের কাজ। ধর্মের কোনো উপকারিতা নেই, বস্তুগতভাবে কখনোই প্রমাণ করা যাবে না যে এর রয়েছে উপকারিতা; তবে এর অপকারিত রয়েছে প্রচুর, বস্তুগতভাবে সব সময়ই তা প্রমাণ করা যায়; কিন্তু ধর্ম যেহেতু শক্তিশালী, সব সময় মানুষকে রাখে সামাজিক ও মহাজাগতিক ভয়ের মধ্যে, তাই ধর্মের অপকারিতার কথা কেউ বলে না। মহাজাগতিক ভয়ের থেকে অবশ্য সামাজিক রাষ্ট্রিক ভয়ের পরিমাণ বেশি; কেননা অধিকাংশ সমাজ ও রাষ্ট্র কাজ করে ধর্মের রক্ষীবাহিনীরূপে, তার তৎপরতার কোনো শেষ নেই। ধর্ম ও ক্ষমতার মধ্যে রয়েছে এক বড়ো সম্পর্ক ধর্মের বিধাতাদের কল্পনা করা হয় সর্বশক্তিধর রূপে, আর ধর্মও ক্ষমতা ছাড়া চলতে পারে না।
বাল্যকাল, এখন, আক্রান্ত তিনটি আদিম শক্তি-রাজনীতি, ধর্ম ও কাম— দিয়ে, যেগুলোর পীড়নে বাল্যকাল থেকে ঝরে যাচ্ছে সমস্ত স্বপ্ন সমস্ত সুখ; আমার বাল্যকাল আক্রান্ত ছিলো একটি আদিম শক্তি-রাজনীতি দিয়ে। গ্রামে গিয়ে পৌছোতো একের পর এক দীর্ঘ দূরবতী নাম : কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ, কায়েদে মিল্লাত লিয়াকত আলি খান, ফিল্ডমার্শাল মােহাম্মদ আইউব খান—এসব গিয়ে পৌছোতো, আমরা এসব নামকে দেবতাদের নাম, যদিও মুসলমানের দেবতা নেই, মনে ক’রে মুখস্থ করতাম; নামগুলো পুরোপুরি বলতাম। যাতে প্রকাশ না পায় অবিনয়। মুসলমানরা নামের ব্যাপারে খুবই স্পর্শকাতর, তারা নামের ডানে বাঁয়ে নানা বস্তু লাগিয়ে থাকে, যা মনে করিয়ে দেয় প্রাচীন আরবের একটি বিশ্বাস যে নামের সাথে রয়েছে যাদুর সম্পর্ক। আরবরা আসল নাম গোপন ক’রে রাখতো, ব্যবহার করতো আবু লাহাব বা আবু হুরায়রার মতো অভিধা, যাতে কেউ যাদু করতে না পারে:-যাদু করার জন্যে দরকার আসল নাম! বাঙালি মুসলমান কেমন পাগল ছিলো ওসব পাকিস্থানি নামে, তা কি আমি দেখি নি? দীর্ঘ দেহের ওই সব ক্ষুদ্র মানুষদের দ্বারা কেমন বিহ্বল ছিলো বাঙালি মুসলমান, তা কি আমি ভুলে গেছি? মুসলমানের কাছে তাদের অতীতের সব নাম ও সৱ কিছু পবিত্র, তাই তাদের সম্পর্কে কোনো কথা বলা যায় না। আমি একবার মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ বলেছিলাম, এক স্যার তাতে অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন, আমাকে দিয়ে কায়েদ আজম বলিয়েছিলেন। তিনি কায়েদে আজম, জাতির পিতা, তিনি ছাড়া মুসলমানরা থাকতো হিন্দুদের চাকর, এসব বলেছিলেন স্যার। তখন থেকেই এসব নামে আমার বিরাগ দেখা দিতে থাকে, ঘেন্না লাগতে থাকে রাজনীতিক দেবতাদের। ছাত্রজীবন থেকে আজ পর্যন্ত নানা রাজনীতিক বিধাতা সম্পর্কে কবিতা লেখার চাপ পড়েছে আমার ওপর;-আমি তা অবহেলা ক’রে গেছি; আমার খুব ভালো লাগে যে আমার বন্ধুরা অবলীলায় রাজনীতিক বিধাতার পর বিধাতা নিয়ে কবিতা লিখে ফেলেন, বিহ্বল হয়ে ঘোষণা করেন যে ওই বিধাতারা না থাকলে থাকতেন না তারা, কিন্তু আমি কখনো ওই রকম আবেগ বোধ করি নি। রাজনীতিকদের আমার কখনো মনে হয় নি মহান, আমি তাদের মধ্যে দেখেছি শক্তি ও অন্তঃসারশূন্যতার যৌগ। রাজনীতির লক্ষ্যই হচ্ছে শক্তি, আর যাঁরা জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত, সারাটি জীবন ব্যয় করেন শক্তির জন্যে, তাঁদের আমার বেশ দানবিক মনে হয়।