ইস্কুলে যতোই ওপরের ক্লাশে উঠতে থাকি আমি. ততোই আমার সুখ কমতে থাকে; দেখতে পাই বইগুলো বিশ্বাস করতে বলছে, অনেকের স্তব করতে বলছে। ইতিহাস বই পড়তে গিয়ে মুগ্ধ না হয়ে আমি হয়ে উঠি সন্দেহপরায়ণ; ওই বইগুলোতে দেখি রাজাদের সম্পর্কে উচ্ছাস, যা আমার ভালো লাগে নি। বাঙলা বইগুলোতে যাদের লেখা থাকতো, শেষ দিকে থাকতো তাদের জীবনীও ওই জীবনীতে খুবই প্রশংসা করা হতো তাদের, কিন্তু আমি বুঝে উঠতে থাকি যে ওই লেখকেরা অতো প্রশংসা পেতে পারেন না। মোঃ বরকতউল্লাহর দু-তিনটি লেখা পড়তে হয়েছিলো ওপরের শ্রেণীতে; লেখকপরিচিতিতে বলা হয়েছিলো তিনি দার্শনিক, ওই বয়সে দার্শনিক কী, তা ঠিক বুঝে উঠতে পারি নি, কিন্তু বুঝতে পারি যে তাঁর লেখায় কোনো প্রশ্ন নেই, নানা ভক্তি আছে, কতকগুলো পুরোনো কথা আছে। একটি লেখায় শেখ সাদিকে তিনি এক অলৌকিক মানুষে পরিণত করেন; আমরাও খুব অনুরক্ত হই। সন্দির; কিন্তু প্রতিশ্রুতিমতো বন্ধুর মৃত্যুর দিনে বন্ধুর বাড়িতে তাঁর আসা বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় নি আমার, যদিও আমার বন্ধুরা ওই অলৌকিক ঘটনায় অত্যন্ত মুগ্ধ হয়। ওপরের শ্রেণীতে দুটি ঘটনা আমাকে নাড়া দেয়। প্রথমটি হচ্ছে দ্বিতীয় মওলানাসাব এক স্যারকে লাঠি দিয়ে মারতে যান, কেননা স্যার বলেছিলেন ধর্মের বইগুলো গল্পের বই; আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে আমাদের নির্দেশ দেয়া হয় পাকিস্থানের প্রধানমন্ত্রী সোরাওয়ার্দির একটি ভাষণ মুখস্থ করতে। প্রথম ঘটনাটি ইস্কুলে সাড়া জাগিয়েছিলো; দ্বিতীয়টি ঘটেছিলো নীরবে। সবাই ওই বক্তৃতা মুখস্থ করেছিলো, আমি করি নি; আমার মনে হয়েছিলো ওই নিকৃষ্ট বক্তৃতাটি আমি কেনো মুখস্থ করবো? তিনি শক্তিমান ব’লে? আমি কামিনী রায়ের কবিতা মুখস্থ করতে পারি, কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ মুখস্থ করতে পারি না।
দিন দিন আমার ভেতরে অবিশ্বাস জমে উঠতে থাকে; মনে হ’তে থাকে যা কিছু চলছে, যা কিছুকে খুবই মহৎ মনে করা হয়, তা অতো মহৎ নয়; যা কিছুকে সত্য মনে করা হয়, তার সবই সত্য নয়; যা কিছুকে মান্য করতে বলা হয়, তার সবই মাননীয় নয়।-কিন্তু আসলেই কিসে অবিশ্বাস আমার? দেখতে পাই আমার অবিশ্বাস শক্তিতে;—যা কিছু শক্তিমান, দর্পশালী, যা কিছু পীড়ন করে মানুষকে, তাতেই ক্রমশ আমার অবিশ্বাস গভীর হতে থাকে। বিনা প্রশ্নে কিছু মেনে নিতে আমার ইচ্ছে করে না; আর যা-কিছু সম্পর্কে কারো কোনো সন্দেহ নেই, যা-কিছুর স্তুতি ক’রে অন্যরা সুখ পায়, সেগুলোতেই আমার বেশি সন্দেহ হতে থাকে। এখানে এখন সবাই শক্তির পূজারী; তারা বিধাতায় বিশ্বাস নাও করতে পারেন, কেননা কল্পিত বিধাতা সরাসরি নিজের শক্তি প্রয়োগ করেন না; কিন্তু তারা বিশ্বাস করেন নেতায়, নায়কে, একনায়কে, পিতায়, রাষ্ট্রপিতায়, প্রথায়, ও আরো অজস্র বস্তুতে; কেননা এগুলো শক্তিমান। আমি শক্তিতে বিশ্বাস করি না, আমি অবিশ্বাস করি শক্তিতে, ক্ষমতায়, দৰ্পে। আমার সমস্ত অবিশ্বাস জন্মেছে শক্তিতে অবিশ্বাস থেকে। শক্তি অমানবিক, শক্তি নিজেকে ছাড়া আর কাউকে মূল্য দেয় না; শক্তি সব ধরনের যুক্তি ও মানবিকতাকে পর্যাদস্ত করতে চায়। নিটশে বিশ্বাস করতেন, এবং ২ নিটশেকে গালি দিয়েও সবাই হিটলারের মতোই বিশ্বাস করে, যে ‘জীবন শক্তিলাভের বাসনা ছাড়া আর কিছু নয়। আমি মেনে নিই। নিটশেকে যে সবাই প্রচণ্ড শক্তি চায়, যারা যতো আদিম তারা ততো বেশি শক্তি চায়;-শক্তি : সীমাহীন, অযৌক্তিক, প্রচণ্ড, অমানবিক; কিন্তু আমি ওই শক্তির প্রতিপক্ষ, আমি তার মুখোমুখি দাঁড়াতে চাই। কামিনী রায় বা জসীমউদদীন আমার শ্রদ্ধেয় পৃথিবীর সমস্ত রাষ্ট্রপতি আর প্রধানমন্ত্রী আর আলেকজান্ডারের থেকে। শক্তিমানেরা তুচ্ছ, তারা ইতিহাসের পরিহাস; তাদের শ্রদ্ধা করার কিছু নেই। আমার ছেলেবেলায় চারপাশে খুবই প্রশংসা শুনতাম হিটলার আর নেপোলিয়নের; আমাদের বইতে তাদের সম্পর্কে লেখাও ছিলো; কিন্তু আমি বুঝে উঠতে পারতাম কেনো তাদের মহাপুরুষ ভাববো। তাদের আমি কখনো মহাপুরুষ ভাবি নি। শক্তি সব সময়ই দূষিত ও ক্ষতিকর, শক্তি রোগের মতো। আমি ঘৃণা করি শক্তি ও শক্তিমানদের, অবজ্ঞা করি শক্তি ও শক্তিমানদের; তারা রোগ; তারা দূষিত করে মানুষকে, নষ্ট করে মানুষের মস্তিষ্ক আর হৃদয়।
ভক্ত কখনো আমি হ’তে পারি নি, যদিও আমি অনেকেরই অনুরাগী। আমি দেখেছি অনেক প্রতিভাবান মানুষও বেঁচে থাকেন কারো উপগ্ৰহরূপে; ওভাবে বেঁচে থাকাতেই গৌরব বোধ করেন তারা, ধন্য হয় তাদের জীবন; এটা আমার কাছে মর্মান্তিক। ভক্ত হ’লে নানা বাস্তব স্বাৰ্থ চরিতার্থ হয়; তবে ভক্ত হওয়ার মূলে থাকে বিশেষ মনস্তাত্ত্বিক কারণ। ভক্তরা মহিমা অর্জন করে দেবতাদের সংস্পর্শে। ভক্তরা জানে, বা তাদের অবচেতন মনে একটি বোধ কাজ করে যে তারা দেবতা হয়ে উঠবে না, কিন্তু দেবতার মহিমা তাদের ভেতরে সঞ্চারিত হোক, এটা তারা চায়; তাই দেবতার পায়ে আত্মোৎসর্গ ক’রে তারা অর্জন করে মহিমা। কোনো কোনো দার্শনিক প্রচার করেন যে মানুষের থাকা উচিত বিশ্বাস করার বাসনা-উইল টু বিলিভ’: আমি এটাকে খুবই বাজে দৰ্শন বলে মনে করি; আমি, অনেকটা রাসেলের মতোই, মনে করি মানুষের থাকা উচিত সন্দেহ করার, এমনকি অবিশ্বাস করার বাসনা। বিশ্বাস খুবই ক্ষতিকর। ধর্মের বইগুলো নির্দেশ দেয় বিশ্বাস করতে, বলে ওগুলোতে প্ৰকাশ পেয়েছে চিরন্তন সত্য; তবে নির্দেশ মাত্ৰই অবিবেচিত শক্তির প্রকাশ। ওগুলোতে যদি সত্যিই চিরন্তন সত্য প্রকাশ পেয়ে থাকে, তাহলে তার চেয়ে ভালো আর কিছুই হ’তে পারে না; কিন্তু আমরা কি একটু বিচার ক’রে দেখতে পারি না কাকে বলে চিরন্তন সত্য? চিরন্তন সত্য হচ্ছে, ওই বইগুলোর মতে, একরাশ নির্দেশ যা মানতে হবে বিনাপ্রশ্নে। ধর্মের বইগুলোর রীতি ঢুকে গেছে আমাদের সব কিছুতে। রবীন্দ্রনাথ এখন বেশ বড়ো রকমের এক দেবতা হয়ে উঠেছেন বাঙালির; আমি তার প্রতিভার অনুরাগী, কিন্তু আমি মনে করি না যে তিনি বিচারের ওপরে।