বিশ্বাসের অবসানের কাল এসে গেছে, ভাটায় গড়াচ্ছে তার সমুদ্ৰ—আরনল্ড এটা অনুভব করেছিলেন অনেকেরই আগে। বেদনা বোধ করেছিলেন তিনি, তবে হাহাকার করেন নি। ওই বেদনা থেকে জন্মেছিলো তার মহান কবিতা ‘ডোভার সৈকত’। তাঁর কবিতাটিকে শুধু ধর্মীয় বিশ্বাসের ভাটার কবিতা মনে হয় না। আমার; সমস্ত বিশ্বাসের ভাটার কবিতাই মনে হয়। এটিকে। কবিতাটি পড়তে ইচ্ছে করছে আমার। কবিতাটি অনুবাদ করতে চাই আমি।
ডোভার সৈকত
ম্যাথিউ আরনল্ড
সমুদ্র প্রশান্ত আজ রাতে।
ভরা জোয়ার এখন, ভাসে রূপবতী চাঁদ
প্ৰণালির জলের ওপরে;—ফরাশিদেশের উপকূলে
আলো মৃদু হয়ে নেভে গেলো এইমাত্র; বিলেতের উপকূলশৈলগুলো,
মৃদু আলোকিত ও বিস্তৃত, দাড়িয়ে রয়েছে শান্ত উপসাগরের থেকে মাথা তুলে।
জানালার ধারে এসো, কী মধুর রাতের বাতাস!
শুধু, পত্রালির দীর্ঘ সারি থেকে
যেখানে সমুদ্র মেশে চাঁদের আলোয় শাদা তটদেশে,
শোনো! তুমি শোনো ঢেউয়ের টানে স’রে-যাওয়া নুড়িদের
ঘর্ষণের শব্দ, এবং অবশেষে,
যখন ফিরে আসে উচ্চ বালুময় তটে,
শুরু হয়, আর থামে, তারপর শুরু হয় পুনরায়,
কোলাহলপূর্ণ ধীর লয়ে, এবং বয়ে আনে
মনে বিষাদের চিরন্তন সুর।
সোফোক্লিজ বহুকাল আগে
শুনেছিলেন এ-সুর অ্যাজিআনে, আর এটা তাঁর মনে
বয়ে এনেছিলো মানুষের দুর্দশার
ঘোলাটে জোয়ার-ভাটা; আমরাও
এই শব্দে পাই একটি ভাবনা,
সেই সুর শুনে এই দূর উত্তর সাগরের তীরে।
বিশ্বাসের সমুদ্রও
একদিন ছিলো ভরপুর, এবং পৃথিবীর তটদেশ ঘিরে
ছিলো উজ্বল মেখলার মতো ভাঁজেভাঁজে।
কিন্তু এখন আমি শুধু শুনি
তার বিষণ্ণ, সুদীর্ঘ, স’রে-যাওয়ার শব্দ,
স’রে যাচ্ছে, রাত্রির বাতাসের শ্বাস, বিশাল বিষণ্ণ সমুদ্রতীর,
আর বিশ্বের নগ্ন পাথরখণ্ডরাশি থেকে।
আহা, প্ৰিয়তমা, এসো আমরা
সৎ হই একে অপরের প্রতি! কেননা এই বিশ্ব, যা আমাদের সামনে
স্বপ্নের দেশের মতো ছড়িয়ে রয়েছে বলে মনে হয়,
যা এতো বৈচিত্ৰপূৰ্ণ, এতোই সুন্দর, এমন নতুন,
তার সত্যিই নেই কোনো আনন্দ, কোনো প্রেম, কোনো আলো,
নেই কোনো নিশ্চয়তা, নেই শান্তি, নেই বেদনার শুশ্রূষা;
আর আমরা এখানে আছি যেনো এক অন্ধকার এলাকায়,
ভেসে যাচ্ছি যুদ্ধ ও পালানোর বিভ্রান্ত ভীতিকর সংকেতে,
যেখানে মূর্খ সৈন্যবাহিনী রাত্রির অন্ধকারে যুদ্ধে ওঠে মেতে।
আরনল্ড শেষে আর অলৌকিক বিশ্বাসে সীমাবদ্ধ থাকেন নি, মুখোমুখি হয়েছেন লৌকিক বিশ্বাসেরও, প্রেম ও দুর্দশাগ্রস্ত পৃথিবীর,–Where ignorant armies clash by night : যেখানে মূর্খ সৈন্যবাহিনী রাত্রির অন্ধকারে যুদ্ধে ওঠে মেতে। আমরা এখন তার থেকেও অন্ধকার সময়ে রয়েছি।
সারাক্ষণ আমি ভাবি না বিশ্বাস-অবিশ্বাস নিয়ে; বিশ্বাসের ব্যাপারটি ভুলেই থাকতে পারি, ভুলেই থাকি; তার থেকে অজস্র আকর্ষণীয়তায় ভারে আছে পৃথিবী ও জীবন। এই রোদ অজস্র বিশ্বাসের থেকে চিরন্তন, এই বৃষ্টি মূল্যবান লাখ লাখ বিশ্বাসের থেকে, কর্কশ। কাকের ডাককেও মনে হয়। পাচ কোটি বিশ্বাসের থেকে সুখকর; আর রয়েছে মানুষের মুখ, মানুষের শরীর, এবং রয়েছে বই। বারট্র্যান্ড রাসেল যখনই উল্লেখ করেছেন ধর্মগুলোর নাম, তখনই নাম করেছেন চারটি ধর্মের : ইহুদি, খ্রিস্টান, ইসলাম, ও সাম্যবাদ। সাম্যবাদ ও ধর্ম তার কাছে, শুনে অনেকেই বিস্মিত হবে এতে প্রথম; কিন্তু তার ব্যাখ্যার পর আর সন্দেহ থাকে না যে ওটিও একধরনের ধর্ম। সব ধর্মই নিয়ন্ত্রণবাদী, সাম্যবাদ ও তাই; তবে এর সীমাবদ্ধতা হচ্ছে এর কোনো বিধাতা নেই। ধর্মগুলো সাধারণত টিকে থাকে রাষ্ট্র নির্ভর ক’রে, কিন্তু রাষ্ট্রের ওপরও থাকতে হয় একজন বিধাতা : রাষ্ট্র ও বিধাতা মিলেই টিকিয়ে রাখে ধর্মগুলোকে। ধর্মের প্রবক্তারা জানেন বিধাতা সরাসরি কাজ করেন না, বাণী দিয়েই শেষ হয় তার কাজ; তাই দখল করতে হবে রাষ্ট্রযন্ত্র; রাষ্ট্রযন্ত্রই তখন কাজ করবে বিধাতার। কয়েক শতাব্দী ধ’রে উৎপীড়িত হয়ে খ্রিস্টানরা যেদিন দখল করে রোমীয় সামাজ্য, তখন থেকে তাদের বিধাতার আর কোনো কাজ থাকে না; তারাই তখন পীড়ন করতে থাকে অন্যদের। ইসলাম ব্যাপারটি বুঝেছিলো শুরুতেই, তাই শুরুতেই দখল করেছিলো রাষ্ট্রযন্ত্র; যা নানা বাক নিয়ে ধারাবাহিকভাবে চলছে এখনো। জয়ীর মতো সফল আর কেউ নয়; কিন্তু জয় উ ৎকর্ষ বোঝায় না, পৃথিবী ভীরে বারবার জয়ী হয়েছে নিকৃষ্ট, পরাভূত হয়েছে উ ৎকৃষ্ট। তবে জয়ী টিকে থাকে।
আমি আর দ্বিতীয়বার জীবন যাপন করতে চাই না: পুনর্জন্ম আর পরলোকে উত্থান আমার কাছে হাস্যকর, এমনকি কেউ যদি আমাকে আবার বাল্যকালে পৌঁছে দিতে পারে, যাপন করতে দেয় আমার ফেলে-আসা বাল্যজীবন, আমি তাতে রাজি হবো না, যদিও বাল্যকাল আমার অত্যন্ত প্রিয়; এবং তা আমাকে দিন দিন আরো ব্যাকুল করছে। বাল্যকালে আমার একটি বড়ো সুখ ছিলো যে বিশ্বাস করতে হতো না। ধর্ম রাড়িখালে গুরুত্বহীন হয়ে উঠেছিলো আমার বাল্যকালেই; ও নিয়ে কেউ মাতামাতি করতো না-কিন্তু এখন মাতামাতি শুরু হয়েছে। আমাদের গ্রামের অধিকাংশ মানুষ নিজেদের মতো ক’রে তাদের বিধাতাকে বিশ্বাস করতেন; বিধাতা বলতে তাঁরা কী বুঝতেন, তা কেউ জানে না। তাদের আমি বেশি মাছিদে, মসজিদকে তারা মছিদ’ বলতেন—শব্দটিকে তারা বাঙলা ক’রে নিয়েছিলেন, যেতে দেখি নি; নামাজ পড়তেও দেখেছি খুবই কম। তাদের সময়ই ছিলো না; সেই সকালে তারা ক্ষেতে যেতেন, চাষ করতেন, বা ধান বুনতেন, বা গরু চরাতেন, তাদের ঘরে ফেরার ঠিক ছিলো না। ধর্মকর্ম ছিলো বিশেষভাবে নারীদের কাজ: তারাও তা যে ঠিকমতো করতেন, তা নয়। মাকে একবার আমি একটি সুরা বলতে বলেছিলাম, মা প্রথম রাজি হয় নি, পরে যখন বলে, দেখতে পাই তা অনেকখানিই ভুল। রাড়িখালের অধিকাংশই ধর্মের পদগুলো ঠিকমতো উচ্চারণ করতে পারতেন না, আজো পারেন না; কিন্তু তাতে তাদের কিছু যায় আসে নি। এখন অবশ্য রাড়িখালে আমি অদ্ভুত শাদা লম্বা পোশাক পরা লোকদের ঘুরতে দেখি, যখনই গ্রামে যাই, তারা রাড়িখালের নয়, তাদের ভাড়া ক’রে আনা হয়েছে; আর তারা যখন ওই অদ্ভুত পোশাক প’রে পথ দিয়ে হাটে রাড়িখালের চাষীরা নরকের ভয়ে হয়তো কেপে ওঠে। রাড়িখালে এখন মাইক্রোফোনে ধৰ্মচর্চা হয়, যেমন ডিশ অ্যান্টেনায় চর্চা হয় সংস্কৃতির। কিন্তু পাতার ফাঁক দিয়ে ভোরে কারো মধুর কণ্ঠ ভেসে আসে না, ভেসে আসে মাইক্রোফোনের ঘড়ঘড় শব্দ। কয়েক দিন আগে ভোরের আগে আমার ঘুম ভেঙে গিয়েছিলো; হঠাৎ আমি চারদিক থেকে ছুটে আসা অজস্র মাইক্রোফোনের প্রচণ্ড ও অস্পষ্ট শব্দে কেঁপে উঠি। কোনোটির কথাই বুঝতে পারছিলাম না। আমি, যদিও আমি বোঝার খুবই চেষ্টা করছিলাম; আমি শুনতে পাচ্ছিলাম। শুধু নিরন্তর গোলমাল। আমি শুনেছি। একদিন না কি পবিত্র বইগুলোর অক্ষর রাশি মুছে যাবে, পবিত্র শ্লোকগুলো অর্থের বদলে প্রচার করবে: গোলমাল। সে-সময় কি এসে গেছে। এরই মাঝে?