বিশ্বাস কাকে বলে? আমরা কি বলি আমি পিপড়েয় বিশ্বাস করি, সাপে বিশ্বাস করি, জলে বিশ্বাস করি, বা বজপাতে, বা পদ্মানদীতে বিশ্বাস করি? এসব, এবং এমন বহু ব্যাপারে বিশ্বাসের কথা ওঠে না, কেননা এগুলো বাস্তব সত্য বা প্রমাণিত। যা সত্য, যা প্রমাণিত, যা সম্পর্কে কোনো সন্দেহ নেই, তাতে বিশ্বাস করতে হয় না; কেউ আমরা বলি না যে আমি বিদ্যুতে বিশ্বাস করি, বা রোদে বিশ্বাস করি, বা গাড়িতে বিশ্বাস করি, কেননা সত্য বা প্রমাণিত ব্যাপারে বিশ্বাস করতে হয় না, বিশ্বাস করতে হয় অসত্য, অপ্ৰমাণিত, সন্দেহজনক বিষয়ে। অসত্য, অপ্ৰমাণিত, কল্পিত ব্যাপারে আস্থা পোষণই হচ্ছে বিশ্বাস। ‘বিশ্বাস কর’ ক্রিয়াটি নিশ্চয়তা বোঝায় না, বোঝায় সন্দেহ; আর এ-ক্রিয়ার সাথে অকর্তপদে দু-রকম বিভক্তি হয়, এবং বাক্যের অর্থ বিস্ময়করভাবে বদলে যায়। আমি বলতে পারি “আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি, কিন্তু ঈশ্বরকে বিশ্বাস করি না”। এ-বাক্যে প্রথম ঈশ্বর অধিকরণ কারক, এতে বসেছে ‘এ’ বিভক্তি; আর দ্বিতীয় ঈশ্বর কর্মকারক, এতে বসেছে ‘কে’ বিভক্তি; এবং বাক্যটি বোঝাচ্ছে ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করলেও আমি তার ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে সন্দেহ পােষণ করি। বাঙলায় কিছুর অস্তিত্ত্বে বিশ্বাস করার জন্যে অধিকরণে সপ্তমী বিভক্তি হয়। বিশ্বাস নিশ্চয়তা বোঝায় না, সন্দেহই বেশি বোঝায়; তবে বিশ্বাসীদের স্বভাব ভাষার স্বভাবের বিপরীত;-ভাষা যেখানে বোঝায় অনিশ্চয়তা, বিশ্বাসীরা সেখানে বোঝেন নিশ্চয়তা। মানুষের বিশ্বাসের শেষ নেই, কোটি কোটি বিশ্বাস পোষণ করে মানুষ। এমন মনে করার কোনো কারণ নেই যে এখন যেসব বিশ্বাস চলছে, সেগুলো চিরকাল ধ’রে চলছে; এখনকার বিশ্বাসগুলোর বয়স খুব বেশি নয়, এগুলোর আগে লাখ লাখ বিশ্বাসের উদ্ভব ও বিনাশ ঘটেছে; দেবতা বা ঈশ্বর বা বিধাতা বা কোনো বিশেষ স্রষ্টায় বিশ্বাস সেদিনের, চারপাঁচ হাজার বছরের, কথা; মানুষের বয়স তাদের বিভিন্ন ধরনের দেবতা বা বিধাতাদের বয়সের থেকে অনেক বেশি।
বিশ্বাসের সাথে অন্ধকারের সম্পর্ক গভীর, বিশ্বাস অন্ধকারের আত্মজ; আলোর সম্পর্ক তার কম বা নেই। অন্ধকারের কাজ হচ্ছে বস্তুকে অদৃশ্য করা, তার রূপরেখাকে রহস্যময় করা; আলোর কাজ তাকে দৃশ্যমান করা; অন্ধকার রহস্য সৃষ্টি করে, আলো ঘোচায় রহস্য। আলোকিত ঘরে রহস্য নেই, দিনের বেলা রহস্য নেই; কিন্তু অন্ধকার ঘর রহস্যে বোঝাই, রাত রহস্যে পূর্ণ। বিশ্বজগত মানুষের কাছে অন্ধকার ঘর বা রহস্যময় রাতের মতো, তার অধিকাংশ এলাকা মানুষের অজানা, আর যতোটুকু জানা, তাও সবাই জানতে চায় না, অন্ধকারই তাদের কাছে বেশি আকর্ষণীয় মনে হয়। বিশ্বজগতকে আলো জেলে জানতে না চেয়ে মানুষ তাকে রহস্যে ভ’রে তুলেছে, তার রূপ বদলে দিয়েছে; এর ফলে ঘটেছে। বিশ্বজগতের রহস্যীকরণ। বিশ্বাস হচ্ছে রহস্যীকরণপ্রবণতা, যা বস্তুনিষ্ঠভাবে সত্য জানতে চায় না, বরং মিথ্যেকে আকর্ষণীয় ও শক্তিশালী ক’রে তুলতে চায়। রহস্যীকরণপ্রবণতা মিথ্যেকেই ক’রে তুলেছে সত্য; এজন্যে সত্য শব্দটি এখন বিভ্রান্ত করে আমাদের। বিশ্বাসের সম্পর্ক ইন্দ্ৰজালের সাথে, বিজ্ঞানের সাথে নয়; এখনো মানুষ ইন্দ্ৰজাল দিয়ে আক্রান্ত, অভিভূত; বিজ্ঞান দিয়ে আলোকিত নয়। মানুষ বিশ্বজগত সম্পর্কে খুব কম জানে, কিন্তু যতোটুকু জানে, তাও কম নয়; মানুষের জানার বিষয়গুলো বিচার করলে বিস্মিত না হয়ে পারি না। মানুষ তার কল্পিত দেবতাদের থেকে অনেক বেশি প্রতিভাবান, শক্তিমান, এবং জ্ঞানী; তবে। অধিকাংশ মানুষ ওই জ্ঞান থেকে বহুদূরবর্তী। পুরোনো পৃথিবীর বহু বিস্ময়ের কথা শোনা যায়, পুরোনো পৃথিবীর মহাপুরুষেরা বহু বিস্ময়কর কাজ করেছেন বলে বহু রটনা প্রচলিত, কিন্তু পুরোনো মহাপুরুষেরা তুচ্ছ যাদুর বেশির কিছু করতে পারেন নি, প্রকৃত বিস্ময়কর কাজ করেছে আধুনিক মানুষ।
মানুষ যতো বিশ্বাস পোষণ করে, তার প্রথম প্রধান উৎস পরিবার; তারপর তার সমাজ, তার রাষ্ট্র, তার সভ্যতা। মুসলমান পরিবারে জন্ম নিলে প্রথম তার ভেতরে ঢুকবে মুসলমানের বিশ্বাসগুলো, পাশের বাড়ির হিন্দু পরিবারে জন্ম নিলে প্রথম তার ভেতরে ঢুকতো হিন্দুর বিশ্বাসগুলো; খ্রিস্টান পরিবারে জন্ম নিলে ঢুকতো খ্রিস্টানের বিশ্বাসগুলো, ইহুদি পরিবারে জন্মালে ঢুকতো ইহুদিরগুলো। বিশ্বাস কারো ভেতর থেকে সহজাতভাবে উঠে আসে না, বিশ্বাস সহজাত নয়; মানুষ নিজের ভেতর থেকে কোনো বিশ্বাস অনুভব করে না, বিশ্বাস পারিবারিক সামাজিক রাষ্ট্রিক; পরিবার তাকে যে-বিশ্বাসগুলো দেয়, সেগুলোকেই সে পবিত্র শাশ্বত ধ্রুব মনে করে; ভয়ে সে এগুলোকে আঁকড়ে ধরে, লোভে সে এগুলোকে জড়িয়ে ধরে। কোনো বিশ্বাসই পবিত্র শাশ্বত ধ্রুব নয়, যদিও প্রত্যেকে তার বিশ্বাসকে তাই মনে করে। পবিত্র শব্দটিই নিরর্থক, এর কোনো সর্বজনীন তাৎপর্য নেই; একজনের কাছে যা পবিত্র আরেকজনের কাছে তা ঘৃণার বস্তু হ’তে পারে, সাধারণত হয়ে থাকে; যেমন উগ্ৰ ধাৰ্মিকের কাছে তার প্রতিদ্বন্দ্ব ধর্মের সব কিছুই ঘূণ্য। ধাৰ্মিক হিন্দু মুসলমানের পবিত্র গৃহ পোড়াতে দ্বিধা করে না, ধাৰ্মিক মুসলমান অবলীলায় পদদলিত করে হিন্দুর পবিত্র দেবদেবীমূর্তি; খ্রিস্টান-ইহুদিও নিদ্বিধায় একই আচরণ করে। তাই পবিত্রতার বোধ সর্বজনীন নয়, পবিত্রতার বোধ উঠে আসে নিজের বিশ্বাস থেকে, ভয় থেকে। আসলেই পবিত্রতা নিরর্থক শব্দ; কোনো কিছু পরিচ্ছন্ন হ’তে পারে, পবিত্ৰ হ’তে পারে না, পবিত্রতার কোনো বাস্তব রূপ নেই। কোনো কিছুই শাশ্বত নয়; মানুষের কোনো কোনো বিশ্বাস একশো দুশো বা দু-তিন হাজার বছর ধ’রে চলছে, তাও অবিকল একইভাবে চলছে না, কিন্তু মানুষ ওগুলোকেই শাশ্বত ব’লে ভাবছে; মনে রাখছে না পৃথিবী থেকে বহু বিশ্বাস লোপ পেয়ে গেছে, যেগুলোকে এক সময় শাশ্বত মনে করা হতো, যেগুলো কয়েক হাজার বছর টিকে ছিলো। ধ্রুব নয় কোনো কিছু; যদিও বিশ্বাসীরা তাদের বিশ্বাসকে তাই মনে করে। ধ্রুব বলতে বুঝবো তা, যা অবিচল একক একমাত্র সত্য; কিন্তু বিশ্বাসের কোনো শেষ নেই, এবং বিশ্বাসগুলো পরস্পরবিরোধী। এগুলোর একটি ধ্রুব হতে পারে, সবগুলো ধ্রুব হ’তে পারে না; কিন্তু এগুলোর প্রতিটিই এতো ত্রুটিপূর্ণ যে এগুলোর একটিকেও ধ্রুব মনে করতে পারি না।