১৯৮১তে স্টিফেন হকিং গিয়েছিলেন ভাটিকানের এক সম্মেলনে, যাতে ক্যাথলিক গির্জা স্বীকার করে যে গ্যালিলিওকে শাস্তি দেয়া ঠিক হয় নি; তারা অনুতপ্ত। পোপ উপদেশ দেন যে বিগ ব্যাংয়ের পর মহাজগতের বিবর্তন নিয়ে বিজ্ঞানীরা গবেষণা করতে পারেন; তবে বিগ ব্যাং নিয়ে গবেষণা করা উচিত হবে না, কেননা সেটি ছিলো সৃষ্টির মুহুর্ত, তাই সেটি ছিলো বিধাতার কাজ। পোপ বিগ ব্যাংয়ের কথা শুনেছেন, কিন্তু ওই দিন হকিং যে-বক্তৃতা দিয়েছিলেন, তা শোনেন নি। তাঁর মূল বক্তব্য ছিলো স্থান-কাল সসীম, তবে তার সীমারেখা নেই: অর্থাৎ মহাজগতের শুরু নেই, কোনো সৃষ্টির মুহুর্ত নেই; তাই কোনো বিধাতাও নেই। মহাজগত সম্পর্কে নিজের তত্ত্ব ব্যাখ্যা করে হকিং বলেছেন :
যতোদিন আমরা মনে করেছি। মহাজগতের একটা শুরু আছে, ততোদিন আমরা মনে করতে পেরেছি যে এর একজন স্রষ্টাও আছেন। কিন্তু মহাজগত যদি হয় স্বয়ংসম্পূর্ণ, যার কোনো সীমানা নেই, তখন তার কোনো শুরু থাকে না, শেষও থাকে না; তখন শুধু থাকে মহাজগত। তখন স্রষ্টার/বিধাতার কী দরকার?
এভাবেই নষ্ট হলো আরণ্যিক নির্বোধের ভ্রান্ত দুঃস্বপন।
আমার অবিশ্বাস
এ-বইয়ের পরিচ্ছেদগুলো লেখার সময় মনে পড়ছিলো ম্যাথিউ আরনল্ডকে, যিনি একশো তিরিশ বছর আগে, ১৮৬৭তে, দেখেছিলেন আলো নিভে আসছে ফরাশি উপকূলে, আর সমুদ্রের ভাটার টানে শুনেছিলেন বিষাদের সুর। সমুদ্রের ভাটার টানে তিনি পেয়েছিলেন একটি রূপক-ধর্মীয় বিশ্বাসের অবসানের রূপক; এবং লিখেছিলেন একটি মহান কবিতা : Dover Beach। বাঙলায় এমন কবিতা কেউ লেখেন নি- (বহু পরে সুধীন্দ্রনাথ বেদনাহীনভাবে ঘোষণা করেছিলেন ‘শূন্যগর্ভ পুরাণ-সংহিতা’); আমাদের কবিদের হয়তো সমুদ্রের স্বরের সাথে বিশেষ পরিচয় নেই, এবং এখনো হয়তো তাদের বিশ্বাসের সমুদ্রে চলছে প্রচণ্ড জোয়ার। বিশ্বাস অধিকাংশ মানুষের জন্যেই এক বড়ো আশ্ৰয়;—তা কোনো আশ্ৰয়ই দিতে পারে না, কিন্তু তারা মনে করে কোনো এক মহাশক্তিমান সব সময়ই তাদের সাথে রয়েছেন অভিভাবক হিশেবে। এক চমৎকার মতিভ্ৰম সুখী ক’রে রাখে তাদের। আমার এক ছাত্রীও একদিন বিচলিত হয়ে কেঁপে কেঁপে বলেছিলো, স্যার, বিশ্বাস না করলে আমরা বাঁচবো কী নিয়ে, আমরা কি নিঃস্ব হয়ে যাবো না, শূন্য মনে হবে না। নিজেকে? আমাদের কী থাকবে?? আমি জানি বিশ্বাস মানুষকে শান্তি দেয়, নির্বোধ সুখে রাখে; কিন্তু শান্তি আর সুখ গর্দভদেরই উপভোগ্য, মানুষের নয়। বিশ্বাসকে যারা করেছে জীবনের বড়ো আশ্রয়, তারা ওটি হারাতে ভয় পায়; কেননা বিশ্বাসে। তারা অভ্যস্ত হয়ে গেছে। তাদের সুখে রাখে অভ্যাস, তারা ভয় পায় অভ্যাস থেকে স’রে যেতে। একদিন মানুষ যখন মুক্ত হবে অলৌকিক বিশ্বাস থেকে, তারা ভয় পাবে না; কেননা অভ্যাস আর প্রথা তাদের পীড়ন করবে না। বিশ্বাস না থাকলেও জীবনে অনেক কিছু থাকে; সে-সবের জন্যেই জীবন যাপন করার উপযুক্ত। বিশ্বাসের থেকে বারান্দার চড়ুইটিও জীবনের জন্যে অনেক মূল্যবান; চড়ুইটি যা দিতে পারে বিশ্বাস তা দিতে পারে না। আমি বারবার বলেছি—‘জীবন তাৎপর্যহীন’; এটা ভীতিকর মনে হবে অনেকের: আবার কেউ কেউ বলতে পারেন- ‘তাৎপর্য? তাৎপর্য থাকতে হবে কেনো জীবনের? আমার জীবন আছে, একদিন থাকবে না। এই তো সব।’ আমাদের সমাজ আদিম; এখানে প্রশ্ন নেই, তাই যন্ত্রণাও নেই, রয়েছে বিভ্রান্ত বিশ্বাসের নিরন্তর নির্বোধ উত্তপ্ত উদ্দীপনা।
ম্যাথিউ আরনল্ড ভিন্ন সমাজের, তিনি কবি ও জ্ঞানী; তিনি দেখেছিলেন শেষ হয়ে আসছে বিশ্বাসের কাল; এবং তারই মনে হয়েছিলো যে একদিন কবিতাই নেবে ধর্মের স্থান। আমি অবশ্য কবিতাকে ধর্মের মতো নিরর্থক মনে করি না; কবিতা ধর্মের স্থান নেবে—এটাও এক সুন্দর বাজেকথা; কবিতা থাকবে কবিতা হয়েই, কবিতাকে অন্য কারো জায়গা জুড়ে বসতে হবে না। অন্যদের তুলনায় তিনি বেশ আগেই দেখেছিলেন সত্যটি যে বিশ্বাসের সমুদ্রে ভাটা চলছে; কয়েক বছরের মধ্যেই দেখা যায়। আরনল্ড যা বোধ করেছিলেন আবেগের ভেতর দিয়ে, রূপায়িত করেছিলেন যা রূপকে, একদল জ্ঞানী তা দেখছেন মগজ দিয়ে, এবং লিখছেন বিধ্বংসী বইপত্র। বেশ সংকটে তখন ইউরোপি সভ্যতার সব কিছু, তবে সবচেয়ে সংকটে ধর্ম। ডারউইন জীবন সৃষ্টির দায়িত্ব থেকে তখন মুক্তি দিয়েছেন বিধাতাকে, আর নিটশে ঘোষণা করেছেন বিধাতা মৃত’; তবে এগুলো নয়, ধর্মকে সবচেয়ে বেশি আহত করেন ধার্মিকেরাই। গবেষকেরা তখন বিকাশ ঘটাচ্ছিলেন এমন এক খ্রিষ্টধর্মীয় বিদ্যার, যার নাম উচ্চতর সমালোচনা’ (আহা, কবে যে এ-বিদ্যার বিকাশ ঘটবে নবীন ধর্মগুলো নিয়ে); আর এ-বিদ্যাই বাজিয়ে দেয় বিশ্বাসের মৃত্যুঘণ্টা। ১৮৬০-এ বেরোয় প্রবন্ধ ও সমালোচনা নামে যাজকদের লেখা একটি বই, যাতে তাঁরা দাবি করনে খ্রিস্টধর্মীয় বইগুলোকেও বিচার করতে হবে অন্যান্য বইয়ের মতোই। এতে শুরু হয় কোলাহল, এবং তাদের বিরুদ্ধে আনা হয় ধর্মদ্রোহিতার অভিযোগ, ফরাসি দেশে বেরোয় আর্নেস্ত রেনাঁর জেসাসের জীবন, জর্মনিতে বেরোয় স্ট্রাউসের একই বিষয়ের বই। ওয়েলহাউসেন ইসরায়েলের ইতিহাস নামক বইতে দেখান যে পুরোনো বাইবেলের কিছু অংশ লেখা হয়েছিলো মোজেসের অন্তত এক হাজার বছর পর। এটা এক বড়ো আঘাতের মতো দেখা দেয়, কেননা এতোদিন বিশ্বাস করা হতো বাইবেল হচ্ছে বিধাতার নিজের বাণী: তাই কোনো সন্দেহ নেই। এ-বইয়ে। ১৮৭২ সালে জর্জ স্মিথ দেখান যে নুহের প্লাবনের উপাখ্যান আসলে এসেছে ব্যাবিলনের এক উপাখ্যান থেকে। এটা আরেক বড়ো আঘাত দেয় বিশ্বাসীদের মনে। দেখানো হয় যে বাইবেলের অনেক কিছুরই মিল রয়েছে ব্যাবিলন ও অন্যান্য প্রাচীন জাতির উপাখ্যানের সাথে, যাদের সংস্পর্শে আসতে হয়েছিলো ইহুদিদের। এর ফলে ধ’সে পড়তে থাকে ইহুদি ও খ্রিস্টধর্মীয় বিশ্বাস। আরনল্ড শুনেছিলেন বিষাদের সুর; এ-বইগুলো কোনো সুর ধ্বনিত করে না, চারদিকে ছড়িয়ে দেয় ভেঙে পড়ার প্রচণ্ড শব্দ।