বিজ্ঞানহীন আদিম মানুষ করেছিলো মহাজগতের রহস্যীকরণ; আর বিজ্ঞান যতোই এগিয়েছে ততোই করেছে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ:-আকাশমণ্ডলকে উদ্ধার করেছে রহস্যজাল থেকে, করেছে মহাজগতের বিরহসীকরণ। কোপারনিকাস দাবি করেছেন। পৃথিবী মহাজগতের কেন্দ্র নয়; গ্যালিলিও প্রমাণ করেছেন কোপারনিকাস। সত্য; ব্রুনো জানিয়েছেন যে অজস্র নক্ষত্রের মধ্যে সূর্য একটি নক্ষত্ৰমাত্ৰ; নিউটন দেখিয়েছেন গতি ও মাধ্যাকর্ষণের একই সূত্র কাজ করে পৃথিবীতে ও সৌরলোকে, যে-সূত্রে গ্রহউপগ্রহ ঘোরে সেই একই সূত্রে আপেল পড়ে মাটিতে। এর ফলে ঘটতে থাকে আকাশমণ্ডলের বিরহস্যীকরণ। হাবেল এই বিরহস্যীকরণপ্রবণতাকে বেশ এগিয়ে দেন, দেখান যে মহাজগতে রয়েছে আরো অজস্ৰ নক্ষত্রমণ্ডল (১৯২৯), বাড়ছে মহাজগত। আরিস্তাতল, টলেমি ও ধর্মগ্রন্থের জগতের সীমা ছাড়িয়ে বহু দূরে চ’লে গেছেন হাবেল; কিন্ত কোথাও দেবদূত, বিধাতা, স্বর্গ নরক নামের বিখ্যাত ব্যাপারগুলো দেখতে পান নি। কোনো দিন দেখা যাবে না।
বিজ্ঞান শুধু মহাজগতকেই আদিম রহস্যজাল থেকে উদ্ধার করে নি, জীবন বা প্রাণকেও উদ্ধার করেছে। লাইবিগ, উনিশ শতকেই, দেখিয়েছিলেন যে গবেষণাগারে প্রাণের উদ্ভব ঘটানো খুবই সম্ভব। তবে চার্লস ডারউন ও আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস ঘটান কালান্তর, উল্টেপাল্টে দেন। ধর্মীয় বিশ্বাস; তাঁরা দেখােন প্রাকৃতিক নির্বাচনের ফলে, কোনো বিধাতার নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই, বিকশিত হ’তে পারে জীবন। জীবনকে রহস্যের জাল থেকে মুক্ত করা ধর্মীয় অনুভূতিকে অনেক বেশি আহত করে আকাশমণ্ডলকে রহস্যমুক্ত করার থেকে। ধর্মগুলো তাই পদার্থবিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে কোলাহল করে না, করে জীববিজ্ঞানের বিরুদ্ধে। তবে ধর্ম, বিশেষ ক’রে খ্রিস্টধর্ম বারবার নিজেকে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করেছে বিজ্ঞানের সাথে খাপ খাওয়াতে তার বিশেষ অসুবিধা হয় না, কেননা ধর্মকে টেনে নানা দিকে সুবিধা মতো ছড়ানো যায়। খ্রিস্টীয় যাজকেরা এক সময় বাধা দিতে চেষ্টা করে ডারউইনি বিবর্তনবাদকে, কেননা তা ধর্মবিরোধী; শেষে না পেরে বিবর্তনবাদকে ঘোষণা করে পরম বিধাতার মহাপরিকল্পনারূপে। বিজ্ঞানের সাথে ধর্মের তাল মেলানোর এটা এক করুণ হাস্যকর উদাহরণ। সত্যিই বিরোধ রয়েছে বিবর্তনবাদ ও বিধাতার মধ্যে। বিবর্তনবাদ মেনে নিলে স্বীকার করতে হয় যে বিধাতা আদিকারণমাত্র, তিনি সূচনা করেছেন প্রাকৃতিক সূত্রগুলো, সচল করেছেন মহাজগতের সব কিছু থেকে। কিন্তু ধর্মগুলো অবসরপ্রাপ্ত বিধাতায় বিশ্বাস করে না। বড়ো কথা হচ্ছে ধর্মগুলো প্রথম দেখা দেয় নি আদিকারণ সম্পর্কে অনুসন্ধিৎসু বিজ্ঞানমনস্ক ব্যক্তিদের মধ্যে, দেখা দিয়েছিলো এমন ব্যক্তিদের মনে, যারা কল্পনা করেছিলেন মানুষের সমস্ত ব্যাপারে প্রচণ্ডভাবে উৎসাহী ও আসক্ত বিধাতাদের। কিছু কিছু কপট মানুষ, বিশেষ ক’রে রাজনীতিবিদেরা ও সুবিধাবাদী বিখ্যাত ব্যক্তিরা, ব’লে থাকেন যে ধর্ম ও বিজ্ঞানের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই; তবে এটা মিথ্যেকথা-ধর্ম ও বিজ্ঞান সম্পূর্ণরূপে পরস্পরবিরোধী: বিজ্ঞান সত্যের সাধক আর ধর্ম মিথ্যের পূজারী।
বিজ্ঞানের সূত্রগুলোর রয়েছে সৌন্দর্য; কোনো দিন যদি আবিষ্কৃত হয় প্রকৃতির শেষসূত্র, যা ব্যাখ্যা করবে মহাজগতের সব কিছু, তাও হবে সুন্দর। তবে ওই সূত্রগুলোতে কোনো বিশেষ মর্যাদা পাবে না জীবন, মানুষ, বুদ্ধি। তাতে মিলবে না। কোনো মূল্যবোধ বা নৈতিকতা বা ধর্ম তাতে পাওয়া যাবে না কোনো বিধাতা, যিনি/যারা মানুষ সম্পর্কে সর্বদা ভাবিত চিন্তিত উদ্বিগ্ন বিনিদ্ৰ আসক্ত। বিজ্ঞান আজকাল মনে করে না যে বিধাতার অস্তিত্বের কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ রয়েছে। কোনো কোনো বিজ্ঞানী মনে করেন যে মহাজগত ভ’রে ছড়িয়ে আছে জৈব উপাদান, যার ফলে মহাজগত ভ’রেই জন্মাতে পারে বুদ্ধিমান প্রাণী। এটা এখনো অনুমান; এটা ঠিক হ’লেও তা কোনো বিধাতার পরিকল্পনার ইঙ্গিত দেয় না। যতোই আবিষ্কৃত হচ্ছে মৌলিক ভৌত সূত্র, ততোই স্পষ্ট হচ্ছে যে, ওগুলোর সাথে মানুষের কোনো সম্পর্ক নেই; ওগুলো মানুষের সংবাদ জানে না। প্রাকৃতিক সূত্রে মানুষ সম্পর্কে আগ্রহী কোনো বিধাতার উপস্থিতি নেই, পরিচয় নেই তার কোনো পরিকল্পনার; ওই সূত্রে মানুষের বিশেষ মূল্য নেই। ওই সূত্রের কাছে ‘অমৃতের পুত্র’, ‘সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ’ নিরর্থক। বিজ্ঞানীরা এখন ধর্ম ও বিধাতা সম্পর্কে ভাবেনই না, যদিও দু-একটি গোড়াও মিলবে। তাঁদের অধিকাংশ ধর্ম সম্পর্কে এতো অনীহ যে তাদের নাস্তিকও বলা যায় না। আজকাল যেমন রয়েছে ধর্মীয় মৌলবাদীরা, তেমনি আছে ধর্মীয় উদারতাবাদীরা। ধর্মীয় মৌলবাদীরা আদিম, তারা তাদের বিশ্বাসে অবিচল, এবং অত্যন্ত ক্ষতিকর: উদারতাবাদীরা বিভ্ৰান্তিকর। উদারতাবাদীরা মনে করে মানুষ পোষণ করতে পারে নানা বিশ্বাস, এবং তাদের সবার বিশ্বাসই চম ৎকার। তারা কেউ বিশ্বাস করতে পারে পুনর্জন্মে, কেউ অপুনর্জন্মে; কেউ বিধাতার ত্ৰিত্,ে কেউ নিঃসঙ্গ একাকীত্বে; এবং সবাই বিশ্বাস করতে পারে তাদের বিধাতাই সত্য। এসবই চমৎকার তাদের কাছে। কিন্তু একটি গোলমাল রয়েছে : ধাৰ্মিকদের বিশ্বাস অবশ্যই ভুল; কিন্তু ধর্মীয় উদারতাবাদীদের এমনকি ভুলও বলা যায় না, তারা ভুলের থেকে বেশি ভুল।