আইনস্টাইন মহাবিজ্ঞানী; কিন্তু কোনো মহাবিজ্ঞানী বিধাতায় বিশ্বাস করলেই কি প্রমাণিত হয়ে যান বিধাতা? বিজ্ঞানীরাই কি বিধাতার অস্তিত্ব সম্পর্কে চূড়ান্ত বিশেষজ্ঞ? বিধাতা সম্পর্কে শেষকথা কি শুনতে হবে বিজ্ঞানীদেরই কাছে? বিজ্ঞানীদের মুখে বিধাতা আছেন? শুনে যারা মনে করে প্রমাণিত হয়ে গেছেন বিধাতা, আর কোনো সন্দেহ নেই তাঁর অস্তিত্ব সম্বন্ধে, তারা আসলে অবিশ্বাসী; গোপনে গোপনে তারা সন্দেহ পোষণ করে তাদের ধর্মপ্রবর্তকে ও ধর্মগ্রন্থে। বিজ্ঞানীমাত্রই মুক্ত মনের মানুষের নন, বহু বিজ্ঞানী ছিলেন ও আছেন, যাঁরা অত্যন্ত কুসংস্কারগ্রস্ত; যেমন-নিউটন, ও সাম্প্রতিক সালাম। নিউটন মাধ্যাকৰ্ষণতত্ত্ব আবিষ্কার ক’রে বিধাতাকে পরিণত করেছিলেন এক অন্ধ ঘড়িপ্রস্তুতকারীতে, যে ঘড়ি তৈরি ক’রে দম দিয়ে দিয়েছে, তার আর কিছু করার নেই; কিন্তু নিজে কয়েক হাজার পাতা লিখেছিলেন ধর্মের পক্ষে; তবে তা প্রকাশ করেন নি। সালামের জন্যে আমার মায়া হয়, তাকে আমার এক করুণ প্রহসনের নায়ক ব’লেই মনে হয়। মুসলমানেরা তাকে মুসলমান ব’লে স্বীকার করতো না, কিন্তু তিনি নিজেকে মনে করতেন অন্ধ মুসলমান। খুবই সংকীর্ণ এলাকায় আজকাল কাজ করেন বিজ্ঞানীরা, কোনো এলাকায় নোবেলপ্রাপ্ত অন্য এলাকা সম্পর্কে অজ্ঞ হ’তে পারেন চৌরাস্তার মুদিটির মতোই। বিধাতা মহাজগত ঘেঁটে প্রমাণ করার বস্তু নন, তিনি ধরা পড়বেন না হাবেল টেলিস্কোপে, তাঁর ছবি ওই দূরবীক্ষণযন্ত্রের ক্যামেরা তুলতে পারবে না। বিধাতাকে মহাজগতে খুঁজতে হবে না, খুঁজতে হবে মানুষের ইতিহাসে; খুঁজে দেখতে হবে তাঁকে/ তাদের কখন সৃষ্টি করেছে মানুষ; মানুষের কোন দুঃস্বপ্ন থেকে উৎপত্তি হয়েছে তার/তাদের।
ধার্মিকেরা মনে করে আকাশমণ্ডল, ওই গ্ৰহতারাচাঁদ, প্রকাশ করছে বিধাতার গৌরব; আর ধূলোবালিপাথরজলের পৃথিবী হচ্ছে বিধাতার হস্তকর্ম। পুরোনো বাইবেল-এ এমন একটি গীত রয়েছে, ওই গীত কোনো সত্যের প্রকাশ নয়, ওই গীত জেগেছিলো মহাজগতকে বুঝতে না পারা মানুষের মনে। ওই তারকাপুঞ্জ, ওই নতুন একফালি বা পূর্ণিমার ধবধবে চাঁদ, ওই সোনালি সূর্য বিধাতার গৌরব গাইছে না, ওগুলো আমাদের চারপাশের ধুলোবালির থেকে সামান্যতম পরিমাণেও পবিত্র নয়। চাঁদে বেশ আগেই মানুষ ফেলে এসেছে তার পায়ের ছাপ। বিজ্ঞানীরা, বিশেষ ক’রে এ-বিষয়ে ভাবেন যে-বিজ্ঞানীরা, তারা কী মনে করেন বিধাতা ও বিধাতার সৃষ্টি বা হাতের কাজ সম্পর্কে? তারা মনে করেন যদি আবিষ্কার করা যেতো এমন কোনো প্রাকৃতিক সূত্র, যা বিধাতার কাজ সম্পর্কে আমাদের দিতো বিশেষ ধারণা, তাহলে ওই সূত্র হতো প্রকৃতির চূড়ান্ত সূত্র। প্রকৃতির ওই শেষসূত্র যদি বের করা যেতো, তাহলে আমরা জানতাম সে-সূত্রগুলো, যা চালাচ্ছে মহাজগতের সব কিছু। স্টিফেন হকিং এ-সূত্রগুলোকেই বলেছেন ‘বিধাতার মন’ বা ‘দণ বধভঢ় মত ঐমঢ়’। বিজ্ঞানীরা ঐমঢ় শব্দটি মাঝেমাঝে ব্যবহার করেন; তবে ওই বিধাতা কোনো বিশেষ ধর্মের বিধাতা নন; ওটি রূপক, প্রাকৃতিক চূড়ান্ত সূত্রগুলোর রূপক হচ্ছে ‘বিধাতার মন’। অনেক মানুষের মনেই বিধাতার ধারণা অত্যন্ত বিস্তৃত। ও নমনীয়: তারা সবখানেই দেখতে পেতে পারে তাদের বিধাতাকে। তাদের প্রয়োগে বিধাতা এক অস্পষ্ট ধারণা, সেটি বহুঅর্থময়। স্টিভেন হেবইনবার্গ বলেছেন, ‘আপনি যদি বলেন যে ‘বিধাতা হচ্ছেন শক্তি’, তাহলে আপনি একতাল কয়লার মধ্যে বিধাতাকে পেতে পারেন।’
বিভিন্ন ধর্মের বিধাতারা একতাল। কয়লার মধ্যে থাকেন না, পারমাণবিক ঘর্ষণের মধ্যে পাওয়া যাবে না তাঁকে/তাঁদের; তিনি/তাঁরা ছড়িয়ে থাকেন না বিশ্বের কল্পিত শৃঙ্খলা সুষমার মধ্যে। তিনি/তাঁরা নির্বিকার প্রাকৃতিক শেষসূত্র নন। তাঁকে/তাঁদের বুঝতে হবে ঐতিহাসিকভাবে, যেভাবে তাঁকে/তাঁদের কল্পনা করেছে মানুষ, যেভাবে আছেন তিনি/তাঁরা বিভিন্ন ধর্মে ও ধর্মগ্রন্থে। ওই বিধাতারা নির্বিকার নিরাসক্ত উদাসীন নন তাদের ভক্তদের সম্বন্ধে, বরং অত্যন্ত বেশি, কখনো কখনো বিরক্তিকররূপে, আগ্রহী ও আসক্ত মানুষের সব কিছুতে; আর ভক্তদের বিশ্বাসে তারা বিশ্বজগতের স্রষ্টা, বিধানকর্তা, শেষ বিচারক। তারা মানুষের অন্তরঙ্গতম ব্যাপারের ওপরও তীক্ষ্ণ চোখ রাখেন; এমনকি স্নানাগারেও নগ্ন স্নান করা যায় না, তারা উকি দেন। সেখানেও। বিজ্ঞানীরা মাঝেমাঝেই ঐমঢ় বা বিধাতা শব্দটি এমনভাবে প্রয়োগ করেন যে তার সাথে কোনো পার্থক্য থাকে না প্রাকৃতিক ধ্রুব সূত্রগুলোর। কিন্তু বিধাতা/বিধাতারা বিভিন্ন ধর্মের বিধাতা, যাদের রয়েছে বিশেষ বিশেষ নাম। ওই বিধাতাদের, যারা মানুষের জন্মমৃত্যু বিবাহ একবিবাহ বহুবিবাহ ভালোমন্দ পাপপুণ্য সঙ্গম জেনা বিহার বিপরীত বিহার প্রার্থনা উপবাস স্বৰ্গ নরক নিয়ে ভাবছেন নিরন্তর, যারা আগ্রহী আসক্ত, তাদের কি পাওয়া যেতে পারে প্রকৃতির শেষসূত্রগুলোতে? বিজ্ঞানীরা বলেন তাকে/তাঁদের পাওয়া যাবে না। প্রাকৃতিক শেষসূত্রে। বিজ্ঞানের সূত্রগুলো শীতল অবিচল নির্বিকার; মানুষ সম্পর্কে সেগুলোর কোনো আগ্রহ আসক্তি নেই, ওগুলো কোনো পাপপুণ্য স্বৰ্গনরক স্বকীয়া পরকীয়া পুজো আরাধনা উপবাস তীর্থযাত্রা জানে না। প্রতিবেশীকে ভালোবাসলে বা না বাসলে সেগুলোর কিছু যায় আসে না।