ধর্মের থেকে ইন্দ্ৰজাল অনেক পুরোনো; প্রকৃতিকে বশ করার জন্যে ধর্মের অনেক আগেই উদ্ভূত হয়েছিলো যাদু, এবং ধর্মে এখনো তা মিশে আছে। এখনো অনেক জনগোষ্ঠি আছে যাদের মধ্যে ধর্মের বিকাশ ঘটে নি, বা আধিপত্যশীল ধর্মগুলো গিয়ে পৌঁছে নি, কিন্তু সেখানে যাদু ও যাদুকরের কোনো অভাব নেই। এক সময় আমাদের দেশে বিশ্বাস করা হতো যে আসামের সবাই, বিশেষ ক’রে নারীমাত্রই, যাদুকর; তারা পুরুষ পেলেই তাকে ভেড়া বানায়; এ-শতকের প্রথম দিকে দেখা গেছে অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের সবাই যাদুকর, কিন্তু তাদের কোনো পুরোহিত নেই, অর্থাৎ বিধিবদ্ধ ধর্ম নেই। সেখানে সবাই মনে করতো তারা যাদু দিয়ে অন্যদের বশ করতে পারে, বা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে প্রকৃতিকে, কিন্তু কেউ সেখানে কোনো দেবতার পুজো করতো না। ফ্রেজার মনে করেন একদা পৃথিবী জুড়েই এসেছিলো এক ইন্দ্ৰজাল বা যাদুর যুগ। ধর্মের উত্থানের ফলে যাদুর অবসান ঘটে নি, ঐন্দ্রজালিকভাবেই সে বদল করেছে তার রূপ, বিভিন্ন ধর্মের ভেতরে এখনো গোপনে বেঁচে আছে। মানুষের কাছে এখনো ধর্মের কঠোর বিধানের থেকে ইন্দ্ৰজালের আবেদন বেশি। এর প্রকাশ পৃথিবী জুড়েই দেখা যায়। পৃথিবী ভীরে ধর্মের যুগের আগে দেখা দিয়েছিলো যাদুর যুগ; কিন্তু মানুষ কেনো যাদু ছেড়ে আশ্রয় নিলো ধর্মের? এর কারণ যাদুর ব্যর্থতা; মানুষ দেখতে পায় যাদু কাম্য ফল দিচ্ছে না; পালন করা হলো অনেক আচার, আবৃত্তি করা হলো অনেক মন্ত্র, কিন্তু কোনোই ফল ফলছে না। মানুষ একদিন বুঝতে পারে প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করার শক্তি নেই ইন্দ্ৰজালের। যা ব্যৰ্থ, তা মানুষ ধ’রে রাখে না; মানুষ পুজো করে সফলতার, সফলতা মানুষের বিধাতা।
যাদুতে এক সময় বিশ্বাস ছিলো মানুষের; যেদিন সে-বিশ্বাস নষ্ট হয়, সেদিন তাদের দরকার পরে নতুন শক্তির, যা যাদুর থেকে শক্তিমান, যা তাদের দিতে পারে তাদের কাম্য ফল। আমরা কল্পনা করতে পারি। সেই সংকটকালের উদ্বিগ্ন চিন্তাবিদদের, আরণ্যিক নির্বোধদের, যারা খুঁজছিলো নতুন পথ, নতুন উপায়, নতুন শক্তিদের, যারা তাদের উদ্ধার করতে পারে, দিতে পারে তাদের কামনার বস্তু। ওই শক্তিকে অবশ্যই হ’তে হবে ইন্দ্ৰজালের থেকে শক্তিমান, কেননা ইন্দ্ৰজালের ব্যর্থতা তারা দেখেছে। তারা তখন প্রকৃতির নিরন্তর আক্রমণে পর্যুদস্ত; তাদের মনে হয় নিশ্চয়ই রয়েছে এমন বহু শক্তি, যারা প্রবাহিত করে ঝড়, বিদ্যুতে ফেড়ে ফেলে আকাশ, বজ্রপাত করে চারদিক কাঁপিয়ে, আকশে জ্বেলে দেয় আলোকমালা, ফলবতী করে নারী ও ভূমিকে ইত্যাদি। নিশ্চয়ই যাদুর থেকে শক্তিমান ওই শক্তিসমূহ। তারা এক ভুল থেকে আরেক ভুলে পৌঁছে—দেখে ভ্রান্ত দুঃস্বপন; যাদু ছেড়ে তারা নিজেদের সমর্পণ করে কল্পিত ওই শক্তিরাশির পায়ে। যাদুকর। যেমন বোঝে নি। প্রকৃতিকে, তারাও বোঝে না; তবে যাদুর ব্যর্থতা এর মাঝেই প্রমাণিত হয়ে গেছে ব’লে নতুন শক্তি কল্পনা করতে তাদের বাধে নি। ওই কল্পিত শক্তিগুলোকে তারা ক’রে তোলে দেবতা; তাদের কাছে চায় সম্পদ, চায় আশীৰ্বাদ, প্রার্থনা করে অভয়। এভাবেই একদিন মানুষ যাদু ছেড়ে আশ্রয় নেয় কল্পিত অতিমানবিক শক্তিরাশির; যাদু থেকে উত্তীর্ণ হয় ধর্মে। যাদু থেকে মানুষ অবশ্য এক দিনে উঠে আসে নি ধর্মে, লেগেছে হাজার হাজার বছর, এমনকি আজো পুরোপুরি উঠে আসে নি। তবে ধর্মে-বহুদেবতায়, বহুদেবতা থেকে একদেবতায়-উঠে এসে লাভ হয় নি মানুষের, বরং যাদুকরের মধ্যে যে-ঔদ্ধত্য ছিলো, তা সে হারিয়েছে; সে হয়ে উঠেছে কল্পিত অতিমানবিক শক্তির পুতুল। ধর্ম হয়ে উঠেছে অবাস্তব অতিমানবিক শক্তির কাছে নিজেকে সমর্পণ করা, বিসর্জন করা সমস্ত নিজস্বতা ও মর্যাদা। কিন্তু ধর্মের কাছে মানুষ যা চায় তা কি তারা পায়? যা চায়, মানুষ তা পায় না; যেমন এক সময় পেতো না যাদুর কাছে। যাদু যদি তার কামনা পূরণ করতে পারতো, তাহলে মানুষ যাদুকে ছাড়তো না; ধর্মের কাছে মানুষ যা চায়, তা না পেয়ে মানুষ একদিন ধর্মও ছেড়ে দেবে। মানুষের বিধাতা আসলে সফলতা।
প্রশ্ন হচ্ছে বিধাতা বা বিধাতারা আছেন কি না? আমরা দেখেছি দার্শনিকের বিধাতাকে মানে না ধাৰ্মিকেরা, কেননা তাতে বিধাতা হয়ে ওঠেন বিমূর্ত ভাব, যা সব ধর্মেই অভিন্ন। কিন্তু পৃথিবীতে ধর্ম অনেক, ও সেগুলো পরস্পরবিরোধী; সেগুলোর প্রতিপালকরুপে রয়েছেন একান্ত নিজস্ব বিধাতা। তাহলে এমন হ’তে পারে বিধাতা একজন নন, অনেক; আর যদি তিনি একলা হন, তাহলে একটি বাদে সবগুলো ধর্মই অসত্য। আজকাল মানুষ বেশ সাবধান হয়ে গেছে, তারা বেশি। ঘাটাঘাটি করতে চায় না; তাই তারা যখন কারো কাছে জানতে চায়—’আপনি কি বিধাতায় বিশ্বাস করেন, তখন তারা বিশেষ ধর্মের বিধাতার কথা জানতে চায় না। কেই বিধাতায় বিশ্বাস করে এটুকু জানলেই ধাৰ্মিকেরা কাজ-চালানোর-মতো সন্তুষ্ট হয়। এমন একটি ঘটনা ঘটেছিলো আইনস্টাইনের জীবনে। পঞ্চাশপূর্তি উপলক্ষে যখন তাকে সংবর্ধনা দেয়ার আয়োজন চলছিলো নানা দিকে, তখন বস্টনের এক যাজক ক্রমশ তাকে জড়িয়ে ফেলছিলো ধমীয় বিতর্কে। ওই যাজকের মতে আপেক্ষিকতত্ত্ব হচ্ছে ‘মুখোশপরা নাস্তিকতার প্রেত’, যা ‘বিশ্বজনীন সন্দেহ সৃষ্টি করেছে বিধাতা ও তাঁর সৃষ্টি সম্পর্কে’। নাস্তিককে কি সংবর্ধনা দেয়া যায়? তখন এক ধর্মযাজক টেলিগ্রাম ক’রে জানতে চান, আপনি কি বিধাতায় বিশ্বাস করেন?’ আইনস্টাইন উত্তর দেন : ‘আমি বিশ্বাস করি স্পিনোৎসার বিধাতায়, অস্তিত্বশীল বস্তুরাশির সুষমার মধ্যে যিনি নিজেকে প্রকাশ করেন; তবে ওই বিধাতায় বিশ্বাস করি না যে ভাগ্য ও মানুষের কর্মকাণ্ড নিয়ে ব্যস্ত।’ তাঁর উত্তর পেয়ে ওই যাজক সকলকে বোঝাতে সমর্থ হন যে স্পিনোৎসাকে বলা হয় বিধাতামাতাল মানুষ, যিনি প্রকৃতির সবখানে দেখতে পেতেন বিধাতার প্রকাশ, তাই তাঁকে আমরা নাস্তিক বলতে পারি না। আর আইনস্টাইন নির্দেশ করেন। ঐক্য। আইনস্টাইনের তত্ত্বকে যদি যৌক্তিক পরিণতিতে নেয়া হয়, তাহলে তা উপস্থিত করবে: একেশ্বরবাদের এক বৈজ্ঞানিক সূত্র। তিনি দ্বৈতবাদী ও বহুত্ববাদী সমস্ত চিন্তা বিনষ্ট করেছেন।’ তাঁর উত্তরে সবাই উৎফুল্ল হয় যে আইনস্টাইন বিধাতায় বিশ্বাস করেন। তাই তাকে সংবর্ধনা দিতে হবে। কিন্তু আইনস্টাইন বিশ্বাস করেন ‘স্পিনোৎসার বিধাতায়’, ইহুদির বিধাতায় নয়; ওই বিধাতা ধর্মীয় বিধাতা নন, তিনি হয়ে ওঠেন প্রকৃতির সৃশ্যঙখল সূত্রের সমষ্টি। ‘আপনি কি বিধাতায় বিশ্বাস করেন?’-এ-লঘু প্রশ্নের উত্তর বারবার দিতে হয়েছে তাকে; এবং তিনি ঘুরিয়ে পেচিয়ে যে-সব উত্তর দিয়েছেন (তার দুটি বিখ্যাত উক্তি : ‘বিধাতা বিশ্ব নিয়ে পাশা খেলেন না’; বিধাতা সূক্ষ্ম, তবে তিনি বিদ্বেষপরায়ণ নন), সেগুলোর অর্থ দাঁড়ায় তিনি বিধাতায়-যে-বিধাতা মানুষের পাপপুণ্য স্বৰ্গনারক নিয়ে ব্যস্ত-, ও প্রত্যাদেশের মধ্য দিয়ে পাওয়া ধর্মে বিশ্বাস করেন না।