হায়, প্রার্থনা;–আত্মসম্মানবোধহীন দুর্বলের লোলুপবাণীবিন্যাস।
প্রার্থনায় প্রকৃতির অমােঘ নিয়ম বদলে দেয়া যেতে পারে, এটা যাদুকর ও বিজ্ঞানী কেউ বিশ্বাস করেন না; তাঁরা জানেন প্রকৃতির নিয়মগুলো অপরিবর্তনীয়, অবিচল, ওগুলোর কাছে প্রার্থনা বা অভিযোগ বৃথা’। বিজ্ঞান কোনো পরমসত্তায়ই বিশ্বাস করে না; তবে ধর্ম বিশ্বাস করে এক/একাধিক লোকোত্তর শক্তিতে; মনে করে ওই শক্তিগুলো যদিও স্বেচ্ছাচারী, তবু আবেদননিবেদন ক’রে তাদের তুষ্ট। ক’রে ফল পাওয়া যেতেও পারে। ফল না পাওয়া গেলেও ক্ষতি নেই, যদি পাওয়া যায় তাহলে অনেক লাভ। এটা সৎ মানুষের স্বভাব নয়, বস্তুবাদী চতুর মানুষের স্বভাব। যাদুতে অনেক সময় নানা ধরনের প্রেতের সাহায্য নেয়া হয়; তবে ওই প্ৰেত দেবতা নয়, তাকে পুজো করা হয় না, নানা মন্ত্র দিয়ে তাকে নিয়ন্ত্ৰণ ক’রে তাকে দিয়ে কাজ উদ্ধার করা হয়। যাদু পুজো না ক’রে নিয়ন্ত্রণ করতে চায় অলৌকিক শক্তিদের। যাদু ও ধর্মের মধ্যে বড়ো পার্থক্য এখানেই; যাদু যা করতে চায় নিয়ন্ত্রণ ক’রে ধর্ম তা করতে চায় প্রার্থনা ক’রে। যাদুকর ধর্মের চোখে বিধাতাদ্রোহী, তাই ধৰ্মপ্রবর্তক ও পুরোহিতেরা চিরকালই চেষ্টা করেছে যাদুকরদের নিৰ্মল করতে। এর মূলে ছিলো একটা স্বার্থগত প্রতিযোগিতাও; ধর্মপ্রবর্তক ও পুরোহিত নিজেদের মনে করে বিধাতার সাথে যোগাযোগের মাধ্যম, সেখানে যদি ভাগ বসায় যাদুকর, তাহলে নষ্ট হয় তাদের স্বার্থ। প্যালেস্টাইন অঞ্চলের ধর্মগুলোতে যাদুকরদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড আক্রোশ চোখে পড়ে।
ধর্মবিষয়ক জনপ্রিয় নিম্নমানের বই পেলেই আমি উলটেপালটে দেখি, কেননা এগুলোই তৈরি করে অধিকাংশ বিশ্বাসীর ধর্মবোধ, যারা ধর্মের মূল বইগুলো পড়তে পারে না, যদিও এগুলোর কোনো কোনো অংশ ধর্মের মূল বিশ্বাসবিরোধী। কিছু দিন আগে ‘বাংলাদেশ হুকুমতের ভূতপূর্ব প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট’ মৌলবী মোহাম্মদ শামছুল হুদা বি.এ.বি.এল সাহেবের নেয়ামুল-কোরআন (ত্ৰয়োবিংশ সংস্করণ, ১৯৮৯, রহমানিয়া লাইব্রেরী, ঢাকা) বইটির ১৫১ পৃষ্ঠাটি খুলে আমি চমকে উঠি। এটি একটি জনপ্রিয় ধর্মবিষয়ক বই; বইটিতে আয়াতের সাহায্যে কীভাবে চাকরীচাকরাণী বাধ্য রাখা যায়, নষ্ট চাকুরি ফিরে পাওয়া যায়, যাদু নষ্ট করা যায়, স্বামীকে বশীভূত করা যায়, ধ্বজভঙ্গ ও প্রমেহ রোগ সারানো যায়, গর্ভপাত নিবারণ করা যায়, স্ত্রীলোকের প্রসব কষ্ট দূর করা যায়, স্বপ্নদােষ বন্ধ করা যায়, বিচারকের দয়া আকর্ষণ করা যায়, সঙ্গম শক্তি বাড়ানো যায়, সাপ ও কুকুরের বিষ নষ্ট করা যায়, প্রস্রাব খোলাসা করা যায়, পরীক্ষায় পাশ করা যায়, এমন অজস্র জরুরি বিষয়ে তদবীরের রীতি বর্ণনা করা হয়েছে। এতো উপকারী বই কমই আছে পৃথিবীতে। বইটির ১৫১ পৃষ্ঠাটি আমাকে শিউরে দেয়। এ-পাতায় তিনি বর্ণনা করেছেন দুইজনের মধ্যে শক্রতা ও মতান্তর সৃষ্টি করার তদবীর’। দুজনের মধ্যে শক্ৰতা সৃষ্টির ব্যাপারটি নৈতিকভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় আমার কাছে, কিন্তু ধাৰ্মিকদের কাছে বেশ গ্রহণযোগ্য। লেখক পরামর্শ দিয়েছেন : ‘দুই ব্যক্তির মধ্যে শক্ৰতা ও মতান্তর সৃষ্টি করিতে হইলে এই আয়াত গাছের পাতার উপর লিখিবে :-আরবিতে আয়াতটি লেখা হয়েছে, উৎস নির্দেশ করা হয়েছে; (৬ পারা, সূরা আলমায়েদা, ৬৪ আয়াতের অংশ); অর্থ দেয়া হয়েছে; এবং তাহাদর মধ্যে আমি কিয়ামত পর্যন্ত শক্রতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করিয়াছি।’ লেখক এখানেই থামেন নি; পরামর্শ দিয়েছেন, ‘তৎপর উপরোক্ত আয়াতের নীচে এই নকশা লিখিবো।’ তিনি নকশার ছবিও দিয়েছেন, যাতে আরবিতে চারবার লেখা আছে আল্লাহ’, এবং মাঝখানে নিচ থেকে ওপর দিকে তিনবার লেখা আছে ‘সোহরা’, যার অর্থ হচ্ছে ‘যাদু’। তিনি নকশাটি বর্ণনা করেছেন এভাবে :
নকশার বর্ণনা :- যাদুকরের কুফরী কালামের কিছু কিছু শক্তি বর্তমান আছে, কিন্তু আল্লাহর পাক কালামের শক্তির নিকট ইহাদের শক্তি কিছুই নহে। পূর্বকালে লোকেরা যাদুমন্ত্রের দ্বারা মানুষের মধ্যে শক্রতা সৃষ্টি করিত। এই নকশায় আল্লাহর নামের নীচে ‘সোহর’ (যাদু) শব্দটি দ্বারা প্রতীয়মান করা হয় যে, যাদুমন্ত্র আল্লাহর অসীম শক্তির নিকট অকিঞ্চিৎকর। এই নকশায় উক্ত ভাবের বর্ণনা থাকায় ইহার বরকতে উপরোক্ত ফল লাভ হয়। তৎপর এই নকশার নীচে লিখিবে অমুক ও অমুকের মধ্যে শক্রতা সৃষ্টি হউক। অমুক অমুকের স্থলে দুইজনের নাম লিখিবে এবং ইহা তাবীয় করিয়া পুরাতন দুই কবরের মাধ্যস্থলে পুতিয়া রাখিলে তাঁহাদের মধ্যে শত্রুতা আরম্ভ হইবে। (অন্যায়ভাবে এই আমল করিলে কবীরাহ গোনাহ হইবে)।
ন্যায়সঙ্গতভাবে কীভাবে দুজনের মধ্যে শক্ৰতা সৃষ্টি করা যায়, তা আমি বুঝে উঠতে পারছি না-ধার্মিকদের নৈতিকতা বড়োই বিস্ময়কর; তবে এ-নকশার বর্ণনায় এটা স্পষ্ট যে ধর্ম ও যাদু পরস্পরের বিরোধী। এর আরো গভীর ব্যাখ্যাও সম্ভব, নকশাটি তাই দাবি করছে, তবে তাতে আমি যাচ্ছি না। ধর্ম ও যাদুর বিরোধ অবশ্য ধর্মগুলোর সূচনাকালেই ঘটে নি, ঘটেছে বেশ পরে; আগে পার্থক্য ছিলো না পুরোহিত ও যাদুকরের মধ্যে, একই ব্যক্তি ছিলো পুরোহিত ও যাদুকর। পুরোহিত-যাদুকর একই সাথে পালন করতো ধর্মীয় ও ঐন্দ্রজালিক আচার, একই সাথে সে প্রার্থনাও করতো মন্ত্রও আবৃত্তি করতো, যাতে সে পেতে পারে তার ঈন্সিত ফল। ধর্ম ও ইন্দ্ৰজালের মিশ্রণ সব ধর্মেই দেখা যায়। প্রাচীন ভারত, মিশর, প্যালেস্টাইনে ধর্ম ও যাদু মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিলো। ভারতীয় ধর্মের শ্লোকগুলোকে যে মন্ত্র বলা হয়, তার কারণ হয়তো এগুলো মূলত ছিলো যাদুকরদের অভিচারশ্লোক। আজকাল যাদু বা ইন্দ্ৰজাল তার গৌরব হারিয়েছে, কিন্তু আদিতে ইন্দ্ৰজােলই ছিলো ধর্মের ভিত্তি। যখন কেউ দেবদেবীর কাছে সুযোগসুবিধা চাইতো, তখন দরকার হতো দেবদেবীকে বশীভূত করা; এবং বশ করার জন্যে দরকার হতো বলি, প্রার্থনা, মন্ত্র; অর্থাৎ ইন্দ্ৰজাল।