প্রথা ও ধর্মকে সবচেয়ে শাণিতভাবে আক্রমণ করেছেন বাট্র্যান্ড রাসেল (১৮৭২-১৯৭০)। সভ্যতায়. ধর্মের কিছুটা দান রয়েছে—তিনি স্বীকার করেন; তবে তাঁর কাছে ধর্ম হচ্ছে ভয় থেকে উৎপন্ন রোগ এবং মানবজাতির শোচনীয় দুর্দশার উৎস।’ তিনি নিজেকে নাস্তিক না ব’লে বলতেন সন্দেহবাদী; এবং প্রচার করতেন গোত্ৰমুক্ত মানবতাবাদ। তিনি চাইতেন মানুষ হবে আত্মবিশ্বাসী, যাপন করবে: নিজের জীবন, ভয় পাবে না চিরশাস্তির, লোভে পড়বে না কোনো পারলৌকিক পুরস্কারের। তিনি কেনো আমি খ্রিস্টান নাই নামে একটি বই লিখেই ছেড়ে দেন প্রথা থেকে পাওয়া ধর্ম। ওই ধর্মের বিরুদ্ধে তার বড়ো আপত্তি হচ্ছে নরক। তিনি বলেছেন, ‘ক্রাইস্টের নৈতিক চরিত্রে রয়েছে এক গুরুত্বপূর্ণ ত্রুটি, তা হচ্ছে তিনি বিশ্বাস করতেন নরকে।’ তিনি জেসাসের থেকে মহৎ মনে করেন। সক্রেটিসকে, আবার সক্রেটিসের মহত্ত্বেও তার সন্দেহ ছিলো: সক্রেটিসের হেমলক পানকে তিনি মহৎ মনে করেন না, কেননা সক্রেটিস বিশ্বাস করতেন স্বর্গে তিনি থাকবেন। দেবতাদের সাথে। তিনি মনে করেন প্রথাগত ধর্মবিশ্বাসগুলো লোপ পাবে। তিনি দেখিয়েছেন সব ধর্মই একটি শক্তির ওপর আরোপ করে বিপুল সম্মান, যে মানুষের প্রতি অনীহ; মানুষ যাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। তার মতে বিধাতায় বিশ্বাস খর্ব করে মানুষের স্বাধীনতা। ধর্ম, তার মতে, উপকারের থেকে অপকার করেছে অনেক বেশি; কেননা ধর্ম দাঁড়িয়ে আছে। অপরীক্ষিত অভিজ্ঞতার ওপর, এবং ধর্ম বুদ্ধির শত্রু। আমরা আরো মুক্ত হবো, আমাদের সমস্যাগুলো সমাধান করতে পারবো নিজেরাই, যদি আমরা নিজেদের মুক্ত করতে পারি বিধাতায় বিশ্বাস থেকে, এবং বিশ্বাস আনতে পারি মানুষের বিজ্ঞানসন্মত বুদ্ধিতে। তখন মুক্ত হবো মোহ থেকে, নিজেদের আর প্রবোধ দেবো না; দাঁড়াবো সম্পূর্ণরূপে নিজেদের পায়ের ওপর, নিজেরাই হবো নিজেদের জীবন ও মৃত্যুর অভিভাবক। মেনে নেবো যে জীবন তা ৎপর্যহীন, তবে তাৎপর্যহীন জীবনকে আমরা তাৎপর্যপূর্ণ ক’রে তুলতে পারি নিজেদের সৃষ্টিশীলতা দিয়ে।
একদেবতা বা বিধাতা কল্পনার আগে এসেছিলো যে দীর্ঘ এক যাদু বা ইন্দ্ৰজালের কাল, সব ধর্মের ভেতরে যা আজো সংগোপনে পবিত্র বিশ্বাস ও আচরণ রূপে টিকে আছে, আমি একটু সেকালে যেতে চাই। বাঙলায় যাদু ও যাদুকর সম্পর্কিত শব্দের সংখ্যা প্রচুর : ইন্দ্রজাল, যাদু, ভোজবাজি, ভেলকি, ভানুমতীর খেল, কুহক, সম্মোহন, তুকতাক, বাণমারা, মায়া, গুণাকরা, মন্ত্র, মন্ত্রকরা, বশীকরণ, শাম্বরী; এবং আদি বাঙলা সাহিত্য ভ’রে আছে যাদুটোনায়। আমার ছেলেবেলায়ও গ্রামে আমরা বাস করতাম যাদুটোনা, ভূতপ্ৰেত, আর বিধাতার অনন্ত ভয়ের মধ্যে। আদিম সমাজে দেখা দিয়েছিলো যাদুকর বা ঐন্দ্রজালিকেরা, তাদের উদ্দেশ্য ছিলো অলৌকিক শক্তি দেখিয়ে সমাজে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করা, এমনকি রাজা হওয়া। যাদুকরের লক্ষ্য ছিলো প্রাকৃতিক শক্তিকে বশ করা, কিন্তু তারা প্রকৃতির শক্তির স্বরূপ বুঝতে পারে নি, তাকে বশ করতে পারে নি; কিন্তু সম্মোহিত করতে পেরেছে মানুষকে। যাদু ও বিজ্ঞানের মূল লক্ষ্য একই, কিন্তু যাদু ভুল পথে গিয়ে হয়ে উঠেছে বিজ্ঞানের অবৈধ বোন-যেমন বলেছেন জেমস ফ্রেজার। ধর্মের মূলকথা হচ্ছে একাধিক/এক অলৌকিক শক্তিতে বিশ্বাস, যারা/যে মানুষের থেকে উন্নততর, এবং চালনা ও নিয়ন্ত্রণ করে প্রকৃতি ও মানুষের জীবন। ওই শক্তিতে বিশ্বাস তাত্ত্বিক ব্যাপার, তবে শুধু তত্ত্বেই ধর্মের চলে না; তার একটি প্রয়োগগত। দিকও থাকতে হয়। প্রয়োগগত ব্যাপারটি হচ্ছে ওই শক্তিগুলোকে পরিতৃপ্ত করা দরকার; শুধু আদিম নয়, আধুনিক সব ধর্মেই রয়েছে অলৌকিক শক্তিগুলোকে তৃপ্ত করার নানা রীতি। কিন্তু যদি বিশ্বাস করি যে রয়েছে অলৌকিক শক্তি, যারা নিয়ন্ত্রণ করে জগত, আর আমরা যদি তাদের কাছে চাই সুযোগসুবিধা, তার অর্থ দাঁড়ায় প্রাকৃতিক নিয়ম শিথিল করা সম্ভব; প্রার্থনা ক’রে বা পশুবলি দিয়ে ওই শক্তিদের সাহায্যে বদলে দিতে পারি প্রাকৃতিক নিয়ম। অলৌকিক শক্তিদের কাছে মানুষের অধিকাংশ প্রার্থনাই স্কুল; বাইবেল থেকে দুটি উদাহরণ দিচ্ছি :
হে সদাপ্ৰভু, আমার ঈশ্বর, আমি তোমার শরণ লইয়াছি;
আমার সকল তাড়নাকারী হইতে আমাকে নিস্তার কর, আমাকে উদ্ধার কর।
পাছে [শত্রু] সিংহের ন্যায় আমার প্রাণ বিদীর্ণ করে,
খণ্ড খণ্ড করে, যখন উদ্ধারকারী কেহ নাই।…
হে সদাপ্রভু, ক্রোধভরে উত্থান কর,
আমার বৈরীদের কোপের প্রতিকূলে উঠ [গীতসংহিতা ৭]
আমার শক্রগণের হইতে, আমার তাড়নাকারিগণ হইতে, আমাকে উদ্ধার কর।
দুষ্টগণ লজ্জিত হউক, পাতালে নীরব হউক।
সেই মিথ্যাবাদী ওষ্ঠাধর সকল বোবা হউক,
যাহারা ধাৰ্ম্মিকের বিপক্ষে দৰ্পকথা কহে,
অহঙ্কার ও তুচ্ছ জ্ঞান সহকারে কহে। [গীতসংহিতা ৩১]
প্রার্থনায় অবশ্য কখনোই কাজ হয় না, নির্বোধেরা শুধু একটু সাময়িক শান্তি পায়। প্রার্থনা সম্বন্ধে বাৰ্ট্যান্ড রাসেলের কথা শোনার মতো :
প্রার্থনা বা বিনয়ের সাহায্যে আপনি নিজের ইচ্ছেমতো কিছুই বদল করতে পারেন না, কিন্তু পারেন প্রাকৃতিক নিয়ম সম্বন্ধে জ্ঞানলাভ করে। এভাবে আপনি যে-শক্তি অর্জন করেন, তা প্রার্থনার-সাহায্যে-অর্জন-করা-যায়-ব’লে-বিশ্বাস-করা শক্তির থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী ও অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য; কেননা আপনি জানেন না। স্বর্গে আপনার প্রার্থনা সদয়তার সাথে বিবেচিত হবে কি না। তাছাড়া প্রার্থনার রয়েছে বিশেষ সীমা; খুব বেশি চাওয়া অধাৰ্মিকতা ব’লে বিবেচিত হবে। কিন্তু বিজ্ঞানের শক্তির কোনো সীমা নেই। আমাদের বলা হয়েছে বিশ্বাস পর্বত স্থানান্তরিত করতে পারে, কিন্তু কেউ তা বিশ্বাস করে না; এখন আমাদের বলা হয় আণবিক বোমা পর্বত স্থানান্তরিত করতে পারে, এবং সবাই তা বিশ্বাস করে।