আকুইনাসের দ্বিতীয় যুক্তি কার্যকরণবিষয়ক। প্রাকৃতিক জগতে যা কিছু আছে বা ঘটে, তার সব কিছুর পেছনে রয়েছে কোনো-না-কোনো কারণ: কোনো কিছুই কারণহীন নয়; তবে, তার মতে, রয়েছেন এক আদি বা প্রথম কারণ, যা অন্য কোনো কারণের ফল নয়। ওই আদিকারণ হচ্ছেন বিধাতা, যিনি জাগতিক সব কার্যকরণের আদি ও উৎস। তৃতীয় যুক্তিতে তিনি পার্থক্য করেন। অনিবার্য বা প্রয়োজনীয় ও আকস্মিক অস্তিত্বের মধ্যে। তার মতে জগত জুড়ে কতো কিছুই অস্তিত্বশীল হয় ও ধ্বংস হয়; তাদের অস্তিত্ব অনিবার্য নয়, তারা আকস্মিক; কিন্তু রয়েছেন এক সত্তা, যার অস্তিত্ব অনিবার্য, কেননা তিনিই অস্তিত্বশীল করেছেন অন্য অস্তিত্বদের। আমরা দেখি কোনো অস্তিত্বের জন্যে দরকার পূর্ব কারো অস্তিত্ব, তবে তার কাছে অন্তহীন পূর্বচক্র বা পূর্বঅস্তিত্ব গ্রহণযোগ্য নয়; তিনি মনে করেন এক জায়গায় গিয়ে অবশ্যই থামতে হবে। তিনি গিয়ে থামেন বিধাতায়, যিনি সমস্ত অস্তিত্বের কারণ, কিন্তু নিজে কোনো কারণের পরিণতি নন। তিনি আদি, তার থেকে উদ্ভূত অন্যরা। আকুইনাসের চতুর্থ যুক্তি ও মহাজাগতিক যুক্তি; এতে তিনি সমস্ত সদগুণের উৎসরূপে দেখতে পান বিধাতাকে। তার মতে বিভিন্ন আকস্মিক সত্তার মধ্যে যে-সমস্ত গুণ দেখতে পাই, সেগুলো তারা পেয়েছে কোনো পরমসত্তা থেকে, কেননা পরমসত্তার মধ্যে ওই গুণাগুলো আছে পরামরূপে। তাই সমস্ত সদগুণের আছেন এক পরম আধার বা উৎস: তিনি হচ্ছেন বিধাতা।
বিধাতার অস্তিত্ব প্রমাণের জন্যে যে-সব মহাজাগতিক যুক্তি দাঁড় করিয়েছেন আকুইনাস, সেগুলো দাঁড়িয়ে আছে এক মৌল বিশ্বাসের ওপর যে বিশ্বজগতের অস্তিত্বের মূলে অবশ্যই রয়েছেন এক আদিকারণ বা পরম কারণ। বিধাতার অস্তিত্ব প্রমাণ করার জন্যে সবশেষে তিনি দেন মহৎ লক্ষ্যমূলক বা মহাপরিকল্পনামূলক যুক্তি। তার এ-যুক্তি মাতিয়ে রেখেছিলো নানা ধর্মের বিশ্বাসীদের, যার এক শিকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। জগতে, আকুইনাস বিশ্বাস করেন, সব কিছু কাজ ক’রে চলছে সুন্দর বিন্যাস বা সুষমা রক্ষা ক’রে; তারা এক বিশেষ মহৎ উদ্দেশ্যপূরণের জন্যে কাজ ক’রে চলছে এভাবে। তিনি মনে করেন জগতের সুষমা কোনো আকস্মিক ব্যাপার হতে পারে না; নিশ্চয়ই এসবের মূলে রয়েছে এক অলৌকিক মহাশক্তির মহাপরিকল্পনা। জগতে রয়েছে নানা তুচ্ছ বস্তু, যাদের কোনো বুদ্ধি নেই, তারাও পূরণ করছে একই মহৎ লক্ষ্য, যা তাদের কাছে। আশা করা যায় না। তারা কেনো মহৎ লক্ষ্য চরিতাৰ্থ করার জন্যে কাজ করে চলছে? আকুইনাস বলেন এর পেছনে রয়েছেন এক মহাসত্তা, যিনি সব কিছুকে চালাচ্ছেন এক পরম পরিণতির দিকে; ওই মহাসত্তা হচ্ছেন বিধাতা। জগতে সুষমা আর মহৎ লক্ষ্য বা মহাপরিকল্পনা দেখা বিশ্বাসীদের একটি দুরারোগ্য ব্যাধি। বিধাতার মহাপরিকল্পনা সম্পর্কে মনে পড়ছে রাসেলের দুটি স্মরণীয় ব্যাখ্যা :
[ক] আমি বুঝতে পারি না প্রকৃতির কোথায় পাওয়া যায় ‘সৌন্দর্য ও সুষমা’। সারা পশুরাজ্য জুড়ে পশুরা একে অন্যকে শিকার করে নৃশংসভাবে। তাদের অধিকাংশই অন্য পশুদের দ্বারা নিষ্ঠুরভাবে নিহত হয় বা ক্ষুধায় ধীরে ধীরে মারা যায়। আমি ফিতাক্রিমির মধ্যে কোনো মহৎ সৌন্দর্য ও সুষমা দেখতে পাই না। এটা বলবেন না যে এটিকে আমাদের পাপের শান্তি ভোগ করার জন্যে পাঠানো হয়েছে। আমার মনে হয় ‘সৌন্দৰ্য আর ‘সুষমা’র ধারণা এসেছে নক্ষত্ৰখচিত আকাশের সৌন্দৰ্য-সুষমার বোধ থেকে। তবে মনে রাখা দরকার যে নক্ষত্রগুলো যখন-তখন বিস্ফোরিত হচ্ছে, আর তাদের চারপাশকে পরিণত করছে ঘোলাটে কুয়াশায়।
[খ] বিবর্তনবাদ ফ্যাশন হয়ে ওঠার পর থেকে মানুষের ওপর মহত্ত্ব আরোপ নিয়েছে এক নতুন রূপ। আমাদের বলা হয় যে বিবর্তনের পেছনে কাজ করছে এক মহৎ লক্ষ্য : লাখ লাখ বছর ধ’রে যখন ছিলো শুধু আঠালো কাদা, বা ট্রিলোবাইট, যুগ যুগ ধ’রে যেখানে ছিলো ডাইনোসর আর দানবিক উদ্ভিদ, মৌমাছি আর বন্য ফুল, তার মধ্য দিয়ে বিধাতা প্রস্তুত করছিলেন এই মহাপরিণতি। পরিশেষে তিনি তৈরি করেছেন মানুষ, যার মধ্যে রয়েছে নিরো ও কালিগুলা, হিটলার ও মুসোলিনির মতো প্রজাতি, যাদের অসামান্য মহিমা এই দীর্ঘ যন্ত্রণাদায়ক প্রক্রিয়ার ন্যায্যতা প্রতিপাদন করে। বিধাতার পরম পরিকল্পনার পরিণতির এই খোড়া ও নপুংসক ব্যাখ্যায় মুগ্ধ হওয়ার থেকে আমি চিরশাস্তিকেও অনেক কম অবিশ্বাস্য ও কম হাস্যকর মনে করি।
সমাজ ও রাষ্ট্রের দিকে তাকালেই চোখে পড়ে ঘটছে এমন সব আশ্ৰীল ঘটনা, যা কোনো মহাপরিকল্পনার ফল নয়। একটি দূৰ্বত্ত একনায়ক দেখা দিয়েছে, এটা কোন মহাপরিকল্পনার অংশ? দেশ জুড়ে অনাহার, বন্যা, মহামারী? এটা কোন মহাপরিকল্পনার অংশ? ধৰ্ষিত হচ্ছে নারীরা, গর্ভবতী হয়ে পড়ছে পরিচারিকারী: এটা কোন মহাপরিকল্পনার অংশ? প্রকৃতির নিয়মগুলো চলে প্রকৃতির স্বভাব অনুসারে, কোনো মহাপরিকল্পনা অনুসারে নয়। আকুইনাস পাঁচটি যুক্তি বের ক’রে প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন বিধাতা আছেন; কিন্তু তার দুর্ভাগ্য ধাৰ্মিকেরা মানে না। তাঁর আবিষ্কৃত বিধাতাকে। তাদের মতে, যেমন পাস্কাল দাবি করেছেন, ‘দার্শনিকের বিধাতা’ আর ‘আব্ৰাহাম, আইজাক ও জ্যাকবের বিধাতা’ এক জিনিশ নয়। ধার্মিকেরা যুক্তি দিয়ে বোঝে না বিধাতাকে, তারা অন্ধ অযৌক্তিক মানুষ; তারা বিশ্বাস করে, তাদের ধর্মের বিধান অনুসারে, বিশেষ বিধাতায়। তাই বিভিন্ন ধর্মের বিধাতা বিভিন্ন, বিভিন্ন ধর্মের মানুষ একই বিধাতায় বিশ্বাস করে না; কিন্তু দার্শনিক যুক্তিতে আবিষ্কৃত হয় যে-বিধাতা—যদি আন্দীে আবিষ্কৃত হয়, তা এক অভিন্ন ভাবনা। বিধাতা আছেন এবং তিনি বাণী বা প্রত্যাদেশ পাঠিয়েছেন বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে, এটা অনেকেই বিশ্বাস করে না; ডেভিড হিউমও এটা বিশ্বাস করেন নি। প্রতিটি ধর্ম দাঁড়িয়ে আছে অলৌকিক অবিশ্বাস্য প্রত্যাদেশের ওপর। প্রত্যাদেশ প্রাকৃতিক নিয়মের বিরোধী; প্রত্যাদেশে বিশ্বাস করতে হ’লে অস্বীকার করতে হয় প্রাকৃতিক নিয়মকে। যে-সব অলৌকিক ঘটনা ঘটেছে ব’লে মনে করা হয়, হিউমের মতে সেগুলো ওই ব্যক্তিদের বোঝার ভুল মাত্র। তার মতে ধর্ম ও যুক্তি পরস্পরবিরোধী; ধর্ম দাঁড়িয়ে আছে অযৌক্তিক ভিত্তির ওপর।