আনসেলমের যুক্তির ভেতরে একটা মজা আছে—মজাটি হচ্ছে যে আমি দাবি করতে পারি যে বিধাতার স্বরূপ আমি বুঝি না; তবে আমি যদি দাবি করি যে বিধাতা কী জিনিশ তা আমি বুঝি, তখন আর আমি তার অস্তিত্ব অস্বীকার করতে পারি না। তার বিধাতার সংজ্ঞা হচ্ছে বিধাতা এমন সত্তা, যার থেকে মহত্তর আর কিছু উপলব্ধি করা যায় না; আর আমি যদি এ-সংজ্ঞাটি বুঝি তাহলে বিধাতা নেই এটা আর আমি উপলব্ধি করতে পারি না। বিধাতা কি বিরাজ করতে পারেন। বিশেষ স্থানে ও কালে? না, তিনি পারেন না; অর্থাৎ স্থান ও কালের পক্ষে বিধাতাকে ধারণ করা সম্ভব নয়, কেননা তিনি এসবের থেকে মহত্তর। আনসেলমের বিধাতার অস্তিত্বাচক যুক্তি যতোটা যুক্তি তার চেয়ে অনেক বেশি ধাঁধা; তাই তার প্রমাণ নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়ে গিয়েছিলো শুরুতেই। তিনি যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন বিধাতার অস্তিত্ব। শুধু যুক্তি দিয়েই যদি আমরা কোনো কিছুর অস্তিত্ব প্রমাণ করতে পারি, তাহলে আমরা এমন অনেক কিছু আছে ব’লে প্রমাণ করতে পারি, যা আসলে নেই। কোনো কিছু কল্পনা করা আর তার অস্তিত্বের মধ্যে রয়েছে মৌল পার্থক্য। মানুষ অস্তিত্বহীন অনেক কিছুই কল্পনা করতে পারে, কিন্তু তাতে তা অস্তিত্ত্বশীল হয়ে ওঠে না। আমি কল্পনা করতে পারি যে আমাদের পরিচারিকাটির চারটি লাল ডানা আছে, রবীন্দ্রনাথ কল্পনা করেছেন যে, ওই মহামানব আসে, কিন্তু তাতে চার ডানার পরিচারিকা ও মহামানব অস্তিত্বশীল হয়ে ওঠে না। সত্য বস্তু আর তার ভাবনা এক নয়।
টমাস আকুইনাস, উপাধিপ্রাপ্ত সন্ত, ছিলেন রোমীয় ক্যাথলিক গির্জার দর্শনগুরু ও ধর্মতাত্ত্বিক: তিনি আরিস্ততলের দর্শনের সাথে মিলিয়েছিলেন খ্রিস্টধর্মকে। ধর্মতাত্ত্বিকদের দায়িত্ব তাদের ধর্মের বিশ্বাসগুলো প্রতিষ্ঠিত করা, এবং প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে অজস্র অপযুক্তি উদ্ভাবন। আকুইনাস তাই করেছিলেন দার্শনিকের বেশে। তার দায়িত্ব ছিলো বিধাতার অস্তিত্ব প্রমাণ, তাই নানা যুক্তি তিনি বের করেছিলেন। কিন্তু ধর্মতত্ত্ব কি দর্শন? এটা ভাবিয়েছিলো আকুইনাসকে। তিনি স্বীকার ক’রে নিয়েছিলেন যে দর্শন ও ধর্মতত্ত্বের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে: দার্শনিক সত্য উদঘাটন করেন যুক্তির মাধ্যমে, আর ধর্মতাত্ত্বিক শুধু যুক্তিতেই সীমাবদ্ধ থাকেন না, তিনি মেনে নেন প্রত্যাদেশকে, বিধাতার প্রেরিত বাণীকে, এবং তার ধর্মের বিশ্বাসগুলো। তাঁকে শুধু যুক্তিই সাহায্য করে না, তাকে সাহায্য করার জন্যে রয়েছেন ধর্মপ্রবর্তক, রয়েছে ধর্মগ্রন্থ। তার রয়েছে মহান অভিভাবক। তার মতে কিছু কিছু সত্য সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাদেশের অন্তর্ভুক্ত; যেমন খ্রিস্টধর্মের ত্রিত্ব বা পিতা-পুত্র-পবিত্র আত্মার ব্যাপারটি। এ-ব্যাপারটিকে যুক্তি দিয়ে দেখানো যেতে পারে যে এটা অযৌক্তিক নয়, তবে যুক্তি দিয়ে এদের সত্যতা প্রমাণ অসম্ভব। ধর্মে রয়েছে আরো কিছু সত্য, যা প্রমাণ করা সম্ভব যুক্তি দিয়ে; এবং রয়েছে আরো একগুচ্ছ সত্য, যা দর্শন ও ধর্মতত্ত্ব উভয়েরই সীমার মধ্যে পড়ে—যেমন বিধাতার অস্তিত্ব। বিধাতা নিজেই জানিয়ে দিয়েছেন তিনি আছেন, তাই তিনি আছেন; তবে যুক্তির সাহায্যেও প্রমাণ করা যায় যে তিনি আছেন। ভেতরে ভেতরে তিনি বিশ্বাস করেন যে দর্শন ধর্মতত্ত্বের থেকে অনেক উৎকৃষ্ট জ্ঞান; তবু যেহেতু তিনি ধর্মতাত্ত্বিক, তার মনে হয় যে দর্শন একলা মানুষের সব প্রয়োজন মেটাতে পারে না। যুক্তির সাথে দরকার প্রত্যাদেশ ও বিশ্বাস। রাসেল বলেছেন আকুইনাসের মধ্যে দার্শনিকের স্বভাব রয়েছে খুবই কম; কেননা তিনি যুক্তির পর যুক্তি দিয়ে সত্যে পৌঁছেন না; তিনি এমন কোনো অনুসন্ধানে ব্যাপৃত নন, যার ফল আগে থেকে জানা অসম্ভব। আকুইনাস আগে থেকেই জানেন তার ফলটি কী, তিনি পৌঁছবেন কোন সত্যে। তার সত্য আগে থেকেই প্রচারিত হয়ে আছে ক্যাথলিক ধর্মবিশ্বাসে; আকুইনাসের কাজ হচ্ছে নানা যুক্তি অবতরণা ক’রে তা প্রমাণ করা। রাসেল বলেছেন আকুইনাস যা করেছেন, তা দর্শন নয়, ওকালতি।
আকুইনাস বিধাতার অস্তিত্ব প্রমাণের চেষ্টা করেন। পাঁচটি উপায়ে। তাঁর উপায়। বা যুক্তিগুলো শুরু হয় বাস্তব জগতে, শেষ হয় গিয়ে অবাস্তবে। তিনি শুরু করেন। আমাদের পরিচিত গতি বা পরিবর্তন নিয়ে; এবং অনুসরণ করেন আরিস্ততালকে যে কোনো বস্তু চলতে বা গতিশীল হ’তে পারে না, যদি না তার থাকে গতিশীল হওয়ার শক্তি। তাঁর প্রথম যুক্তিটিই ভুল। আরিস্ততলের অনুসরণে তিনি বলেন কোনো কিছুর গতিশীল হওয়ার গুণ থাকলেও সে গতিশীল হ’তে পারে না। যদি না সত্যিকার কোনো কিছু তাকে গতিশীল না করে। তার, ও আরিস্ততলের, মতে কোনো কিছুই নিজে গতিশীল হ’তে পারে না; অন্য কিছু তাকে গতিশীল করে। মনে করতে পারি, যে একটি গতিশীল বস্তু অন্য একটি বস্তুকে করে গতিশীল, তাকে গতিশীল করে অন্য একটি বস্তু; অর্থাৎ এটা চলতে থাকে অন্তহীন রূপে। কিন্তু আকুইনাসের কাছে চালকের পর চালক, অন্তহীন চালক অকল্পনীয়; তিনি মনে করেন যে চালক অন্তহীন নয়, রয়েছেন। একজন আদিচালক, যিনি নিজে চলেন না, অন্যদের চালান। তিনি অচল চালক বা অনড় চালক। তিনি বিধাতা। খুবই হাস্যকর, অযৌক্তিক, এবং বাঙলায় যাকে বলে-কষ্টকল্পিত, যুক্তি। তাঁর চিন্তায় সব কিছুই অপর এক সত্তার ওপর নির্ভরশীল, কিন্তু সে-সত্তাটি অন্য কারো ওপর নির্ভরশীল নন, তিনি আচল চালক; তিনি আদি বা প্রথম, অর্থাৎ বিধাতা। তবে তিনি শুধু আরিস্তাতলীয় যুক্তির ওপরই নির্ভর করেন না, নির্ভর করেন। খ্রিস্টধর্মীয় বিশ্বাসের ওপরও যে বিশ্ব চিরকাল ধ’রে অস্তিত্বশীল নয়, এক সময় ছিলো যখন বিশ্ব ছিলো না। আরিস্তাতল যেমন এক আচল চালক প্রস্তাব করেছিলেন তার বিশ্বযন্ত্রকে সচল রাখার জন্যে, আকুইনাসও তাই করেন;-আরিস্ততলের বিশ্বকাঠামো ধার ক’রে আরিস্তাতলীয় আচল চালকের সাহায্যে তিনি চালান সমস্ত সচল বস্তুকে।