বিষাদগ্ৰস্ত যে-সন্তরা নিজেদের বিরত রাখতেন ইন্দ্ৰিয়ের সমস্ত সুখ থেকে, বাস করতেন। মরুভূমির জনহীনতায়, বর্জন করতেন মাংস ও মদ্য ও নারীসাহচর্য, তারা অবশ্য সব ধরনের সুখ থেকে নিজেদের বিরত রাখতেন না। মনের সুখকে বিবেচনা করা হতো দেহের সুখের থেকে অনেক উৎকৃষ্ট, আর মনের সুখের মধ্যে উচ্চস্থানে ছিলো চিরশাস্তি সম্পর্কে নিরন্তর চিন্তাভাবনা, যা দেয়া হবে সৰ্বেশ্বরবাদী ও নাস্তিকদের।
রাসেল বলতে চান যে প্রচণ্ড বিধাতা বিকৃত মনোব্যাধিগ্রস্ত কামঙ্গুধার্ত সন্তদের কল্পনা। ইন্দ্ৰিয়সুখ থেকে বঞ্চিত মানুষ সুস্থ হ’তে পারে না; তাই ‘বিধাতার মুক্তোখচিত’ সন্তরা নিজেদের অপরিতৃপ্ত কামের ক্ষতিপূরণের জন্যে কল্পনা ক’রে চলতেন প্রচণ্ড নরক। তাদের অতৃপ্ত কাম জ্বলে উঠেছে প্রচণ্ড নরকরূপে।
বিধাতাকল্পনায় হিংস্রতার পর বড়ো ক’রে তোলা হয়েছে তাঁর স্তুতিপ্রিয়তা। সব ধর্মেই বিধাতার প্রিয় স্তাবকতা, স্তুতি; তিনি পছন্দ করেন নিরর্থক বন্দনা: প্রহরে প্রহরে তার বন্দনা করতে হয়, নইলে তিনি সুখী হন না। তাকে স্তুতি করার জন্যে রচিত হয়েছে মানবভাষার বিপুল বাক্যসম্ভার। ওই স্তাবকতা বা বন্দনার শ্লোকগুলো খুব উৎকৃষ্ট নয়; নারীর উদ্দেশে এগুলোর থেকে অনেক বেশি উৎকৃষ্ট শ্লোক লিখেছে পুরুষ। আদি বাইবেল-এই দেখতে পাই অজস্র ঈশ্বরস্তুতির থেকে অনেক উৎকৃষ্ট ও অবিস্মরণীয় শলোমনের পরমগীতি, যাতে বন্দনা করা হয়েছে দায়িতাকে। মহাজগতের মতো অনন্ত অসীমের স্রষ্টা যিনি, তিনি কী ক’রে উপভোগ করতে পারেন তুচ্ছ মানুষের তুচ্ছ স্তাবকতা, তুচ্ছ স্তুতি: কী ক’রে তিনি সুখী হ’তে পারেন। এই সব তুচ্ছ কানাকড়িতে? সামারসেট মম সামিং আপ বইটিতে তার এক পুরোহিত বন্ধুর কথা বলেছেন, যিনি তার ভাষণ থেকে বাদ দিয়েছিলেন বিধাতার সমস্ত স্তুতি। মম বিস্মিত হয়ে জানতে চান কেনো বিধাতাকে একবারও প্রশংসা করা হলো না? পুরোহিত বন্ধু বলেন মহান বিধাতা তুচ্ছ ভূস্বামীর মতো স্তাবকতা পছন্দ করতে পারেন না ব’লেই তার বিশ্বাস, তাই তিনি কখনো বিধাতার স্তুতি করেন না। তবে বিভিন্ন ধর্মে বিধাতাকে পরিণত করা হয়েছে এক ক্রুদ্ধ হিংস্র। স্তাবকতাপ্রিয় ভূস্বামীতে। আমরা কি এমন মানুষ কল্পনা করতে পারি, যে পছন্দ করে দিনরাত বন্দনা বা স্তুতি বা স্তাব কত? নিরন্তর নিরর্থক স্তাবকতায় যেখানে অন্তঃসারশূন্য মানুষও ক্লান্তি ও ঘেন্না বোধ করবে, সেখানে কী ক’রে তা সহ্য ও উপভোগ করেন বিধাতা? বিশ্বাসীরা বিধাতার ওপর মহত্ত্ব আরোপ করতে গিয়ে, তাকে বিশাল ক’রে সৃষ্টি করতে গিয়ে তাকে ক’রে তুলেছে নিজেদের মতোই ক্ষুদ্ৰ ও মহত্ত্বহীন। বিধাতা যদি সত্যিই বন্দনা চাইতেন, তাহলে তিনি শূন্য রাখতেন না। মহাজগতকে; শুধু একটি ছোটো গ্রহে মানুষ সৃষ্টি করতেন না; মহাজগত ভ’রেই সৃষ্টি করতেন মানুষ, শুনতেন তাদের উচ্চকণ্ঠ বন্দনা। মানুষের বন্দনায় তাঁর কী দরকার? তিনি নক্ষত্রদের দিয়ে বন্দনা করাতে পারতেন, বন্দনা করাতে পারতেন। নক্ষত্রপুঞ্জ দিয়ে। মহাজগতে সূর্য এক তুচ্ছ তারা, পৃথিবী এক তুচ্ছ গ্রহ, মানুষ এক তুচ্ছ প্রাণী। মহাজগতের স্রষ্টা এতো তুচ্ছকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর স্তুতির জন্যে? এটা যুক্তিসঙ্গত নয়। বিধাতাকল্পনা করতে গিয়ে মানুষ বিধাতাকে নিজের মতোই তুচ্ছ আর ক্ষুদ্ৰ ক’রে তুলেছে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে তিনি কি আদৌ আছেন, বা তারা কি সত্যিই আছেন? থাকলে কার কল্পনারটি আছেন? ইহুদির? খ্রিস্টানের? মুসলমানের? হিন্দুর? না কি আছেন সকলেরই কল্পনার বিধাতা? না কি তিনি সুধীন্দ্রনাথের আরণ্যিক নির্বোধের ভ্রান্ত দুঃস্বপন? তিনি আছেন কি নেই, এটা ইহুদি বা মুসলমান তাত্ত্বিকদের বিবেচনার কোনো বিষয় হয় নি, তারা ধ’রে নিয়েছেন তিনি আছেন। তাকে প্রমাণ করার কোনো দরকার নেই। তাদের প্রশ্নহীনতা একদিকে ভালোই, কেননা বিধাতাকে প্রমাণ করতে যাওয়া পণ্ডশ্ৰম। বই বলেছে তিনি আছেন, তাই তিনি আছেন। তারা বিধাতার উক্তি দিয়েই প্রমাণ করেন যে তিনি আছেন। তবে খ্রিস্টান কোনো কোনো সন্ত প্রমাণ করতে চেয়েছেন বিধাতা আছেন। কিন্তু বিধাতা কি প্রমাণের বস্তু, তিনি কি দর্শনের বিষয়? পদার্থবিজ্ঞান বা জ্যোতির্বিজ্ঞানের সাহায্যে কি প্রমাণ করতে হবে বিধাতাকে, বা আবিষ্কার করতে হবে তাকে? খ্রিস্টীয় কোনো কোনো সন্ত প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন খ্রিস্টীয় বিধাতাকে; যেমন সন্ত আনসেলম (১০৩৩-১১০৯), টমাস আকুইনাস (১২২৫-১২৭৪); সন্দেহ জাগিয়ে তুলেছিলেন কেউ কেউ, যেমন, ডেভিড হিউম (১৭১১-১৭৭৬); এবং বিধাতাকে বাতিল ক’রে দিয়েছিলেন, তাঁর মৃত্যুর সংবাদ জানিয়েছিলেন নিটুশে (১৮৪৪-১৯০০)।
আনসেলম বিশ্বাসী ছিলেন, এবং ছিলেন ক্যান্টারবেরির মহাপুরোহিত; এবং তিনি অসম্ভবকে সম্ভব ক’রে তুলতে চেয়েছিলেন মাত্র একটি যুক্তি দিয়ে। বিধাতার অস্তিত্ব প্রমাণের জন্যে তিনি বের করতে চেষ্টা করেছিলেন মাত্র একটি যুক্তি, যেটি নিজেই প্রমাণ করবে নিজেকে, যেটিকে প্রমাণের জন্যে দরকার হবে না। আর কোনো যুক্তি; আর ওই যুক্তিটিই প্রমাণ করবে। যে বিধাতা সত্যিই আছেন। খুবই অসাধারণ তাঁর অভিলাষ। দু-দুটি বাইবেল ও আরো অজস্র গীতা আর সংহিতা যা প্রমাণ করতে পারছে না, আনসেলম এক স্বপ্রমাণিত যুক্তির সাহায্যেই প্রমাণ করবেন তাকে। তার যুক্তিকে বলা হয় অস্তিত্বস্বরূপযুক্তি; কেননা এতে কোনো বাইরের প্রমাণ দরকার হয় না, এ-যুক্তি শুরু ও সমাপ্ত হয় বিধাতার স্বরূপ দিয়ে। তবে তাঁর যুক্তি বিশ্বাসীর বাজে যুক্তি। আনসেলমের যুক্তি হচ্ছে বিধাতার প্রকৃতি বা স্বরূপ ভালোভাবে বিচার করলে এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে বিধাতা অবশ্যই আছেন। তিনি বিধাতার সংজ্ঞা দেন : বিধাতা এমন সত্তা, যার থেকে মহত্তর আর কিছু উপলব্ধি করা যায় না। বিধাতাকে দেখা যায় না, আমরা চাইলেই তাকে দেখতে পাই না; কারণ তিনি জাগতিক সব কিছু থেকে ভিন্ন। কিন্তু তিনি কেমন? আমরা যারা সাধারণ, তারা তার প্রমাণ পেতে চাই; কিন্তু আনসেলমের মতো অসাধারণের প্রমাণ চান না, চিন্তাভাবনাই যথেষ্ট তাদের জন্যে; এবং আনসেলম বিধাতার স্বরূপ সম্পর্কে ভাবনা চিন্তা ক’রেই সিদ্ধান্তে পৌঁছেন যে অবশ্যই বিধাতা আছেন। শুধু ভাবনা ক’রেই কি আমরা কোনো কিছুর অস্তিত্ব প্রমাণ করতে পারি? আমরা তো অনেক কিছুই ভাবি, কল্পনা করি, যা ছিলো না, নেই, এবং থাকবে না। আমাদের ভাবনার ফলে কি সে-সব জিনিশ সত্য হয়ে ওঠে? ভাবনায় অস্তিত্বশীল বিধাতা বলতে কী বোঝায়? আমরা বুঝি যে তিনি কারো কারো ভাবনায় আছেন, তাদের মনে তিনি অস্তিত্বশীল; কিন্তু বাস্তবে বা মহাজগতে তিনি কোথাও নেই। এর উত্তরে কী বলেন আনসেলম? তিনি যা বলেন, তা খুবই হাস্যকর বাজেকথা। বিধাতা সত্যিই আছেন, এটা প্রমাণ করেন। তিনি এ-যুক্তি দিয়ে যে বিধাতা নেই একথা আমরা কল্পনাও করতে পারি না, তাই বিধাতা আছেন। রাসেলের একটি প্রবন্ধ রয়েছে ‘অ্যান আউটলাইন অফ ইন্টেলেকচুয়াল রাবিশ’-‘বুদ্ধিবৃত্তিক আবর্জনার রূপরেখা’ নামে; আনসেলমের যুক্তিকেও বলতে পারি বুদ্ধিজাত আবর্জনা। আনসেলম বলেন, বিধাতা এমন সত্তা, যার থেকে মহত্তর আর কিছু উপলব্ধি করা যায় না, তাই বিধাতা শুধু উপলব্ধিতেই থাকতে পারেন না; তাই তিনি আছেন বাস্তবেও। তার মতে বিধাতা ছাড়া আর সব কিছুকেই আমরা নেই ব’লে বোব করতে পারি, কিন্তু বিধাতার সংজ্ঞা-বিধাতা এমন সত্তা, যার থেকে মহত্তর আর কিছু উপলব্ধি করা যায় না-অৰ্থপূর্ণ হয় না। যদি বিধাতা না থাকেন। তাই তার মতে যারা বিধাতার স্বরূপ উপলব্ধি করে তাদের পক্ষে বিধাতা নেই এটা উপলব্ধি করা অসম্ভব। খুবই বাজে যুক্তি, বিশ্বাসীরা সাধারণত দিয়ে থাকেন। এ-ধরনের যুক্তিই।