প্রচলিত ধর্মগুলো সম্পূর্ণ পৃথক ধৰ্ম নয়; এগুলোর একটির সাথে আরেকটির নানা মিল রয়েছে। অনেক সময় এক বা একাধিক ধর্ম থেকে জন্মেছে আরো এক বা একাধিক ধর্ম। তবে প্রতিটি ধর্মই নিজেকে সম্পূর্ণ নতুন ব’লে দাবি করে, যেনো এইমাত্র বিধাতা সেটি তৈরি করে পাঠিয়েছেন। ভারতীয় ধর্মগুলোর মধ্যে মিল অত্যন্ত স্পষ্ট; একটি মূল ধর্ম থেকেই ভারতে দেখা দিয়েছে। পরবর্তী ধর্মগুলো। মধ্যপ্রাচ্যেও তাই হয়েছে; কানান বা প্যালেস্টাইন হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের ধর্মগুলোর মাতৃভূমি। প্যালেস্টাইনের মানুষ নানা কিংবদিন্ত থেকে সৃষ্টি করেছিলো ইহুদিধর্ম; তার থেকে উদ্ভূত হয় খ্রিস্টধর্ম; এবং ইহুদি-খ্রিস্ট ও মক্কায় প্রচলিত পৌত্তলিক আরবদের ধর্ম থেকে বিকশিত হয় ইসলাম। ইসলামের ধর্মগ্রন্থে বিধাতার প্রেরিত ধৰ্মরূপে ইহুদি ও খ্রিস্টধর্ম স্বীকৃত; এবং এ-গ্রন্থে রয়েছে বহু উপাখ্যান, যেগুলোর উৎস পুরোনো ও নতুন বাইবেল। আদম-হাওয়ার উপাখ্যানটি স্বীকার করে তিনটি ধৰ্মই। এ-উপাখ্যানটি প্রথম তৈরি করেছিলো হিব্রুরা, ও অন্তর্ভুক্ত করেছিলো পুরোনো বাইবেলে। এটা প্যালেস্টাইনের পুরোনো লোককাহিনী বা পুরাণে প্রচলিত ছিলো; এমনকি তারা কল্পনা করেছিলো তিনটি হাওয়ার, যাদের শেষটি তিনটি ধর্মগ্রন্থে স্থান পেয়ে নিন্দিত ও বিখ্যাত। ইসলাম ধর্মে শুধু আদম-হাওয়াই নয়, পাওয়া যায় পুরোনো বাইবেলের আরো বহু চরিত্র; যেমন, হারুন (অ্যারোন), ইব্রাহিম (আব্রাহাম), হাবিল (আবেল), কাবিল (কেইন), দাউদ (ডেভিড), ইলিয়াস (এলিয়াস), জিব্রিাল (গ্যাব্রিয়েল), ইয়াজুজ (গগ), ইসহাক (আইজাক), ইসমাইল (ইসমায়েল), ইউনুস (জোনাহ), ইউসুফ (জোসেফ), মাজুজ (ম্যাগোগ), নুহ (নোআহ), ফিরাউন (ফারাও); এবং পাওয়া যায় বাইবেলের বহু গল্প : বিশ্বসৃষ্টি, আদমের স্বৰ্গচ্যুতি, কেইন ও আবেল, আব্রাহামের নিজের পুত্রকে উৎসর্গ করার উদ্যোগ, নুহের নীেকো, ইউসুফের মিশরগমন, ইউনুস ও মাছ, ফেরাউন, সলোমনের বিচার, শেবার রানী ও আরো নানা কাহিনী। ইসলামের বিধাতার নামটিও নতুন নয়, নামটি আরবে আগে থেকেই প্রচলিত ছিলো; মুসলমানরা অবশ্য দাবি করে নামটি সৃষ্টির শুরু থেকেই আছে। এ-দাবির ওপর কোনো কথা নেই। নামটির বহু উদাহরণ পাওয়া যায় ওই সময়ের আরবদের ব্যক্তিনামে; যেমন, আবদুল্লা-আল্লার দাস। ইসলামপূর্ব মক্কায় পূজিত হতো তিনটি দেবী-দেবতা নয়,-আল-লাত, মানত, ও আল-উজ্জা। আল-উজা ছিলো চান্দ্রদেবী, মক্কার মহাদেবী; তার ভক্তদের নাম হতো আবদুল উজ্জা (আবু লাহাবের আসল নাম)-উজ্জার দাস। তার আরেকটি নামও ছিলো। ইসলামপূর্ব আরব ছিলো মাতৃপ্রধান, ইসলামে ঘটে। পিতৃতন্ত্রের উত্থান; ধর্মে যেমন পরাজিত হয় দেবীরা, তেমনি সমাজে পরাজিত হয় মাতারা, জয়ী হয় পিতারা। ইসলামে হিলাল বা বঁকা চাদকে পবিত্ৰ মনে করার বিশেষ কারণ রয়েছে। ইসলাম আগের আরবকে অন্ধকারের কাল বলে নিন্দিত করলেও ওই আরব অতোটা অন্ধকারে ছিলো না; চিরকালই বিজয়ীরা পরাজিতদের নামে কুৎসা রটায়। ইসলামপূর্ব আরব থেকে ইসলাম নিয়েছে বহু কিছু : পুরুষের বহুবিবাহ (আরবে নারীদের বহুবিবাহও প্রচলিত ছিলো), দাসপ্রথা, সহজ বিবাহবিচ্ছেদ (আরবে নারীরা সহজে বিবাহবিচ্ছেদ করতে পারতো, ইসলামে বিবাহবিচ্ছেদ সহজ হয়ে ওঠে। পুরুষের জন্যে), সামাজিক নানা বিধি, খৎনা ইত্যাদি। ইসলাম অপৌত্তলিক; কিন্তু এর তলদেশে আরব পৌত্তলিকতার ফন্ধুত্ৰোত সম্পূর্ণ শুকিয়ে যায় নি। তীর্থযাত্রা, পশুবলি, উপবাস প্রায় সব ধর্মেই রয়েছে; ইসলামেও আছে। হজ ও কোরবানির মূল ব্যাপার নিয়ে আলোচনা থেকে বিরত থাকছি। আরব কবি আল-মারি (৯৭৩-১০৫৭) লিখেছেন, ‘দশ দিক থেকে মানুষ আসে পাথর ছুড়তে আর চুমো খেতে। কী অদ্ভুত কথা তারা বলে! মানুষ কি অন্ধ হয়ে যাচ্ছে, দেখতে পাচ্ছে না সত্য?’ জালালউদ্দিন রুমি লিখেছেন, ‘আমি পথ খুঁজি, তবে কাবা বা উপাসনালয়ের পথ নয়, প্রথমটিতে আমি দেখি একদল পৌত্তলিককে আর দ্বিতীয়টিতে একদল আত্মপূজারীকে। খলিফা উমর কাবার কালোপাথরকে উদ্দেশ ক’রে বলেছিলেন, ‘যদি না। আমি দেখতাম মহানবি তোমাকে চুমো খাচ্ছেন, আমি নিজে তোমাকে চুমো খেতাম না।’
ইসলামে পশু উৎসর্গকে জড়িত করা হয়। হিব্রু নবি আব্রাহামের নিজের পুত্ৰ ইসমায়েলকে উৎসর্গ করার উপাখ্যানের সাথে। পশু উৎসর্গ অত্যন্ত পুরোনো পৌত্তলিক যজ্ঞ। মানুষ যখন যাযাবর ছিলো, শিকারই যখন ছিলো জীবিকা, তখন তারা দেবতাকে তুষ্ট করব জন্যে পশু বলি দিতে শুরু করে। বাইবেলের আবেল ও কেইনের উপাখ্যানে এটা দেখতে পাওয়া যায়। আদিপুস্তক-এ আছে: হাওয়ার গর্ভে প্রথম জন্মে কেইন, পরে আবেল। আবেল ছিলো মেষপালক, এবং কেইন চাষী। চাষী কেইন ঈশ্বরের উদ্দেশে উৎসর্গ করে তার জমির শস্য, আবেল উৎসর্গ করে পশু। ঈশ্বর আবেলের উৎসর্গ, পশু, গ্ৰহণ করে; কিন্তু কেইনের উৎসর্গ, শস্য, গ্ৰহণ করেন না। এর ফলেই ঘটে প্রথম নর ও ভ্রাতৃহত্যা;-কেইন হত্যা করে ভাই আবেলকে। প্যালেস্টাইনের ঈশ্বর চাষী পছন্দ করেন না, তাঁর পছন্দ শিকারী, কেননা তিনি মূলত যাযাবরের বিধাতা। আরবসমাজ ছিলো গোত্রবদ্ধ, প্রত্যেক গোত্রের ছিলো নিজস্ব দেবদেবী; বেদুইনরাও বিশেষ বিশেষ স্থানে দেবদেবীদের পুজো করতো। ওই দেবদেবীদের প্রতীক ছিলো বিভিন্ন পাথর। ওই পাথরগুলো কখনো হতো মূর্তি, কখনো বিশাল পাথরখণ্ড। আস সাফা ও আল-মারওয়া পাহাড় দুটির নাম বোঝায় পাথর। আরবরা সৌভাগ্যলাভের জন্যে এ-দু-পাহাড়ে ছোটাছুটি ক’রে ছুতো ও চুমো খেতে দুই পাহাড়ে স্থাপিত ইসাফ ও নাইলার দুটি মূর্তি। দ্বিতীয় শতকের শেষ দিকে আলেকজান্দ্ৰিয়ার ক্লেমেন্ট লিখেছেন, ‘আরবরা পাথর পুজো করে; ওই শতকেই ম্যাক্সিমাস টাইরিউস লিখেছেন, ‘আমি জানি না। আরবরা পুজো করে কোন দেবতার, যাকে তারা রূপায়িত করে একটি চতুর্ভুজ পাথররাপে।’ মুসলমানরা তীর্থে গিয়ে চুমো খায় একটি কালোপাথরকে। এটি এক সময় নির্দেশ করতো উর্বরতা। মুসলমানরা বিশ্বাস করে এটি পড়েছে স্বৰ্গ থেকে। বিশ্বাসটি একেবারে ভুল নয়, যদিও ব্যাখ্যাটি ভুল; স্বৰ্গ থেকে না পড়লেও এটি পড়েছে আকাশ থেকেই; এটি একটি উল্কাপিণ্ড। আকাশে কি পাথর আছে? আছে। মঙ্গল ও বৃহস্পতির কক্ষপথের মাঝখানে ঘুরছে কিছু গ্রহাণু; এগুলোকে ভুলবশত অ্যাস্টিরয়িড বলা হ’লেও এগুলো তারা নয়, এগুলো অতিশয় ছোটো ছোটো গ্রহ। ১৮০১ অব্দের জানুয়ারি মাসের এক তারিখে প্রথম গ্রহাণুটি আবিষ্কার করেন। ইতালীয় সন্ন্যাসী পিয়াসসি। গ্রহাণুটির নাম সিরিস। তারপর দু-হাজারেরও বেশি। গ্রহাণু আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলোর কক্ষপথ বেশ গোলমেলে, এবং কখনো কখনো কোনোটির সাথে অন্য কোনোটির সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষের ফলে যে-টুকরোগুলো পৃথিবীর জলবায়ুতে প্রবেশ করে, সেগুলোকে বলা হয় উদ্ধা। তবে শুধু উল্কা নয়, পুরো কোনো গ্রহাণুও এসে আঘাত করতে পারে পৃথিবীকে, এবং সেটা সৃষ্টি করতে পারে একটা বড়ো বিপর্যয়। বিজ্ঞানীরা এখন গ্রহাণুর সম্ভাব্য আঘাত নিয়ে নানা গবেষণা করছেন। ওই কালোপাথরটি একটি উল্কাপিণ্ড; তবে এখন যেটিকে চুমো খাওয়া হয়, সেটি হয়তো আসল পাথরটি নয়। চতুর্থ হিজরি শতকে কারম্যাশিয়ানরা (Qarmatian) আসল ট নিয়ে গিয়েছিলো, ফেরত দিয়েছিলো অনেক বছর পরে। অনেকের ধারণা তারা আসলটি ফেরত দেয় নি। কালোপাথরটির পাশেই আছে আরেকটি লালবর্ণের পাথর, যার নাম হুবাল।