আদিখ্রিস্টানরা জেসাসের মুখে অনেক কথা বসিয়েছে, ওসব কথা জেসাস কখনো বলেন নি; কেননা তিনি কখনো ছিলেন না। ওই কথাগুলো জেসাসের কথা নয়, ওগুলো খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের অভিজ্ঞতা, বিশ্বাস, এবং আশার প্রকাশ। তারা যা দেখছিলো, যা বিশ্বাস করছিলো, যে-প্রত্যাশ পোষণ করছিলো, তাই তারা ব্যক্তি করেছে জেসাসের কাজে ও উক্তিতে। ইহুদিবা বহুকাল আশায় অ্যাশায় ছিলো যে ত্ৰাতা আসবেন, মুক্তি ঘটবে তাদের; আর প্রত্যেক প্রজন্মই মনে করেছে তাদের সময়েই আসবেন মুক্তিদাতা, পালিত হবে প্রাচীন প্রতিশ্রুতি। প্রথম দিকের খ্রিস্টানরা পুরোনো বাইবেল থেকে জানতো যে ত্রাতার আগমনের আগে পৃথিবীতে ফিরে আসবে এলিজা। যখন তারা মনে কয়ে যে ব্যাপটিস্ট জনই হচ্ছে পৃথিবীতে-ফিরে-আসা এলিজা, তখন তারা বিশ্বাস করে যে ত্রাতার আগমনের আর দেরি নেই; এবং তৈরি ক’রে ফেলে জেসাসকে, যে জনকে ড্রাকে এলিজা নামে। জেসাসের জন্মেখ ব্যাপারটিকে তারা পরিণত করে এক অলৌকিক ঘটনায়। পুরুষ সংসৰ্গহীন কুমারী মাতার গর্ভে সন্তান জন্ম অসম্ভব হ’লেও তা কল্পনা করা অসম্ভব নয়; ওই সময়ে গ্রিক আর রোমসাম্রাজ্য ভ’রেই প্রচলিত ছিলো কুমারী মাতার গর্ভে সন্তান জন্মের কিংবদন্তি। গ্রিক পুরাণে কুমারী ডানার গর্ভে জন্ম নেয়। পারসেউস, তার মা ডান। গর্ভবতী হয় স্বর্ণব ঋণের ফলে; আবার কুমারী নানা গর্ভবতী হয় ডালিম খেয়ে, এবং জন্ম দেয় ভুক্তিসকে। তখন অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিও-পিথাগোরাস, প্রতো, আলেকজান্ডার, অগাস্টাস-কুমারী মাতার গর্ভে বা দেবতাদের হস্তক্ষেপে জন্ম নিয়েছেন বলে বিশ্বাস করা হতো। তন্ত্ৰাদিখ্রিস্টানরাও যখন জেসাসকে সৃষ্টি করে, তার ঐশ্বরিকতা প্রমাণ করার জন্যে তাঁকে জন্ম দেয় কুমারী মায়ের গর্ভে। অনেকে মনে করেন কুমারী মাতার কিংবদন্তিটি জন্মেছে পুরানো বাইবেলের ত্রাতার জন্মসংক্রান্ত ভবিষ্যদ্বাণীর একটি শব্দ ভুল বোঝার ফলে। পুরোনো বাইবেলে (যিশাইয়া, ৭:১৪} একটি ভবিষ্যদ্বাণী আছে :
তাই প্ৰভু তোমাদের এক চিহ্ন দেবেন। দেখো এক কন্যা গর্ভবতী হয়ে পুত্র জন্ম দেবে, ও তার নাম ইম্মানুয়েল রাখবে।
খ্রিস্টানরা এখানে দেখতে পায় ত্ৰাতার আবির্ভাবের ভবিষ্যদ্বাণী। তারা ঐশ্বরিক উন্মাদনায় ভুল অনুবাদ করে ‘কন্যা’ শব্দটির। পুরোনো বাইবেলে আছে হালমাহ, যার অর্থ ‘তরুণী’, বাঙলায় বাইবেল অনুবাদকেরা যার অর্থ করেন ‘কন্যা’। হিব্রুতে বেথুলা হচ্ছে ‘কুমারী’। খ্রিস্টান ধর্মপ্রবর্তকেরা গ্রিকে হালিমাহর অনুবাদ করেন। পার্থেনোস অর্থাৎ কুমারী। তাই ত্ৰাতার যেখানে জন্ম নেয়ার কথা ছিলো তরুণী মায়ের গর্ভে, সেখানে খ্রিস্টানরা তাকে জন্ম দেয় কুমারী মায়ের গর্ভে। জেসাস এক কিংবদন্তি; সত্য নন, কিন্তু সত্য বলে পূজিত। ধর্ম এমনই সব সত্যের সমষ্টি।
জেসাসের গল্প বলেছেন শুধু সুসমাচারলেখকেরা, সে-সময়ের আর কেউ বলেন নি। প্রথম শতকে রোমসাম্রাজ্যে অন্তত ষাটজন ঐতিহাসিক লিখছিলেন ইতিহাস, তারা কেউ জেসাসের কথা লেখেন নি। জেসাস ঐতিহাসিক ব্যক্তি হ’লে তাদের কেউ না কেউ জেসাসের উল্লেখ করতেন; কিন্তু উল্লেখ করেন নি, কেননা তারা ইতিহাস লিখছিলেন, কিংবদন্তি তৈরি করছিলেন না। এখন এটা স্বীকৃত যে সুসমাচারগুলো,-মাথি, মার্ক লুক, যোহন-যেগুলো ভিত্তি ক’রে গড়ে উঠেছে। খ্রিস্টধর্ম-জেসাসের শিষ্যদের লেখা নয়; সুসমাচারপ্রণেতারা জেসাসকে দেখেন নি। সুসমাচারগুলো লেখা হয়েছিলো জেসাসের কথিত ক্রুশকাঠে প্ৰাণ দেয়ার চল্লিশ। থেকে আশি বছর পরে, লিখেছিলেন নামপরিচয়হীন লেখকেরা। এগুলোর মধ্যে মথি, মার্ক, লুকের বিষয় একই; ভাষাও অনেকটা এক। সম্ভবত মার্কই সবচেয়ে পুরোনো, আর অন্যগুলো এটির নকল। তাই এগুলোতে যে-কাহিনী ও কথা আছে, তা কোনো বাস্তব মানুষের নয়। ঐতিহাসিক বই নয়। এগুলো; এগুলো সুসমাচারপ্রণেতাদের বিশ্বাস অনুসারে লেখা জেসাসপুরাণ।
খ্রিস্টধর্মের প্রবর্তকেরা পুরোনো বাইবেলের শূন্য ভবিষ্যদ্বাণী ও নিজেদের ভুল বিশ্বাস অনুসারে সৃষ্টি করেছিলেন এক ত্রাতাকে; কিন্তু মিথ্যায় তাদের আত্মা সম্ভবত শান্তি পায় নি, তাই নতুন বাইবেল ভ’রেই পাওয়া যায় জেসাসের দ্বিতীয় আগমনের প্রত্যাশা। ইয়েটস খ্রিস্টানদের এ-প্রত্যাশার বেদনা মর্মেমর্মে বোধ করে, বিশশতকে, একটি কবিতা লিখেছেন ‘দ্বিতীয় আগমন’ নামে, যাতে জেসাস নয়, একটি নরমুণ্ডধারী বিকট পশু বেথলেহেমের দিকে এগোয় জন্ম নেয়ার জন্যে। নতুন অর্থাৎ খ্রিস্টানদের বাইবেল ভ’রেই ছড়ানো ‘জেসাস শিগগিরই আসবেন’, ‘জেসাসের আগমন আসন্ন ধরনের প্রত্যাশা; কিন্তু জেসাস প্রথমবার আসেন নি, দ্বিতীয়বারও আসেন নি, কখনো আসবেন না। মথির মতে জেসাস বলেছেন, ‘সত্যি, আমি তোমাদের বলছি, এই প্রজন্মের কাল কেটে যাওয়ার আগেই ঘটবে এসব ঘটনা।’ আশার পর আশা আর বহু ভবিষ্যদ্বাণী ব্যর্থ হয়ে গেছে, জেসাস আসেন নি। তাহলে কি জেসাসের কথা সত্য নয়? সুসমাচারলেখকেরা অদম্য, তারা ঈম্বরের বাণীকে মিথ্যে হ’তে দিতে পারেন না; তাই তারা ব্যাখ্যা করেন যে ঈশ্বরের সময় মানুষের সময়ের মতো নয়। তারা বলেন, ঈশ্বরের ‘একদিন সহস্ৰ বছরের সমান, এবং সহস্ৰ বছর একদিনের সমান।’ বলা যে হয়েছে ‘শিগগির’; প্রশ্ন হচ্ছে কতোটা শিগগির’ হচ্ছে ‘শিগগির’? কেনো বিলম্ব হচ্ছে? ঈশ্বরের একদিন সহস্ৰ বছর আর সহস্ৰ বছর একদিন, এ-হিশেবে খুব উৎসাহব্যঞ্জক নয় মানুষের জন্যে; মানুষ আশাবাদী, কিন্তু তারা আশায় আশায় অসুস্থ হয়ে পড়ে, এবং সহস্ৰ বছর বাঁচে না। বার্মিকরা মত বদলাতে খুবই অভ্যস্ত, তারা নতুন নতুন ব্যাখ্যা দিতে লজ্জা পান না; এবং ঈশ্বরের বাণী থেকে সব সময়ই সুবিধামতো তাৎপর্য বের করতে পারেন। তাই পরে ‘জেসাস শিগগিরই আসবেন’ থেকে শিগগির’ বাদ দেয়া হয়; বলা হয় ‘জেসাস আসবেন।’ দ্বিতীয় আর তৃতীয় শতকের খ্রিস্টান পুরোহিতেরা মনে করতেন জেসাস শিগগিরই এসে হাজার বছরের জন্যে স্থাপন করবেন তার সাম্রাজ্য। কিন্তু তার দেখা নেই। কনস্ট্যান্টিন (২৮৮-৩৩৭) যখন খ্রিস্টধর্মকে স্বীকৃতি দেয়, তখন এক পাদ্রি জেসাসের সহস্র বছরের শাসনের এক রূপক ব্যাখ্যা দেন। তার মতে এ-স্বীকৃতিই জেসাসের রাজত্বের শুরু; এর সমাপ্তি ঘটবে জেসাসের পুনরাগমে। খ্রিস্টানরা জেসাসের ফিরে আসার আশা তখন হাজার বছরের জন্যে স্থগিত ক’রে দেয়, কিন্তু ১০০০ অব্দের কাছাকাছি এসে খুব উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। ক্রাইস্ট ফেরেন নি; তাই ব্যর্থ প্রত্যাশার বেদনা থেকে জন্ম নেয় আরেক নতুন আশা। কনস্ট্যান্টিন ৩১২ অব্দে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলো, তারা ওই বছরটিকে সহস্রকের সূচনা ধ’রে ১৩১২র দিকে ক্রাইস্টের পুনরাগমনের প্রত্যাশায় থাকে। তারপরও ক্রাইস্ট আসেন না; সময় আসে, আর চলে যায়; তখন আবার দিতে হয় জোড়াতালি। ষোলোশতকের খ্রিস্টান সংস্কারকেরা পোপতন্ত্রকে, রোমীয় ক্যাথলিক গির্জার স্তরক্রমকে, শনাক্ত করে শয়তান ব’লে। তারা বলে যে তারা বাস করছে পবিত্ৰ সহস্রকের পরে, যখন পোপাতন্ত্ররূপী শয়তান ছাড়া পেয়ে ক’রে চলছে অবাধ শয়তানি। আরেকদল শার্লোেমনের রাজত্বের সূচনাকে (৮০০ অব্দ) ধরে পবিত্র সহস্রকের শুরু হিশেবে, এবং অপেক্ষায় থাকে ক্রাইস্টের। তারা চিরকাল আশা করতে থাকবে, কিন্তু ক্রাইস্ট ফিরবেন না; কেননা তিনি কখনো ছিলেন না, আসেন নি।