অধঃস্থ নরক তোমার জন্য বিচলিত হয়ে তোমার অর্গমনে উপস্থিত হয় তোমােয় সামনে: তোমার জন্যে সচেতন ক’রে তোলে মৃতদের, এমনকি পৃথিবীর সব প্রধানদের; এ সিংহাসন থেকে তুলে এনেছে সব জাতির রাজাদের। তারা সবাই তোমাকে বলে, তুমিও কি দুর্বল হ’লে আমাদের মতো? তুমিও কি হ’লে আমাদের সমান? কবরে নামানো হলো তোমার আড়ম্বর, ও তোমার নেবলযন্ত্রের মধুর বাদ্য; তোমার নিচে পাতা রয়েছে কীট, এবং তোমাকে ঢেকেছে কৃমিরা।
ব্যাবিলনের দাসত্ত্বে থাকার পর ব্যাবিলনি প্রভাবে ইহুদিরা শিওলকে সাধারণ শাস্তির, এবং জেহেন্নাকে দণ্ড ও পীড়নের বিশেষ এলাকায় পরিণত করে।
পুরাণ ও ধর্মের এ-সংক্ষিপ্ত বিবরণ থেকে বোঝা যায়, কোনো ধর্মই কোনো ঈশ্বর পাঠান নি; মানুষই ভুল কল্পনার পর ভুল কল্পনা ক’রে সৃষ্টি করেছে এগুলো। ধর্মের বইগুলো ঋণী মানুষের আদিম পুরাণগুলোর কাছে। মানুষ চিরকাল ব্যাখ্যা করতে চেযেছে নানা প্রপঞ্চ, কল্পনা করেছে বহু কিছু; মানুষ সত্য বলতে চেয়েছে, এবং মিথ্যা বলেছে প্রচুর, এবং মানুষ মিথ্যায় যতো বিশ্বাস করেছে, সত্যে ততো বিশ্বাস করে নি; এখনো করে না। মিথ্যার বিহ্বলকর ও সুখকর শক্তি রয়েছে, যা নেই সত্যের। ধর্মের বইগুলো সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়, যদিও বারবার নিজেদের সত্য বলে দাবি করে, এবং সত্যনিষ্ঠদের ভয় দেখায়। এগুলো প্রতিষ্ঠিত আদিম মানুষের কল্পনা ও পরবর্তদের সুপরিকল্পিত মিথ্যার ওপর। মানুষ কতোটা মিথ্যা বলতে ও বিশ্বাস করতে পারে, তার অসামান্য উদাহরণ জেসাস বা খ্রিস্ট। জেসাস মানুষের শ্রেষ্ঠ কল্পচরিত্র; গত দু-শো বছরের বাইবেলবিজ্ঞানীরা, যাদের অনেকেই ধাৰ্মিক ও পুরোহিত, প্রমাণ করেছেন যে জেসাস নামে কেউ ছিলো না। কিন্তু জেসাস সৃষ্টি হলো কীভাবে, এবং হয়ে উঠলো একটি প্রধান ধর্মের প্রবর্তক? জেসাসকে সৃষ্টি করা, তাকে ঘিরে পুরাণ, ও একটি নতুন ধর্ম বানানোর সমস্ত কৃতিত্ব খ্রিস্টান সুসমাচারপ্রণেতাদের। ক্রাইস্ট এক কিংবদন্তি বা পুরাণ। জেসাসসৃষ্টিকে ব্যাখ্যা করার জন্যে ব্রুনো বাউআব, জে এম রবার্টসন, ভ্যান ডেন বার্গ ভ্যান এইসিংগা, আলবার্ট কালথােফ, গাই ফ্লাউ, প্রোসপার আলফারিক, ডব্লিউ বি স্মিথ, জি এ ওয়েল্স প্রমুখ তৈরি করেছেন একটি তত্ত্ব, যার নাম খ্রিষ্টপুরাণ।
ডেভিড স্ট্রাউস লাইফ অফ জেসাস ক্রিটিক্যািল এক্সামিন্ড-এ (১৮৩৫) বলেছেন গসপেল বা সুসমাচারগুলো জেসাসের ঐতিহাসিক জীবনী নয়; জেসাসের বস্তুনিষ্ঠ জীবনী লেখা সুসমাচার লেখকদের উদ্দেশ্য ছিলো না; তারা চেয়েছিলেন ধর্মীয় পুরাণ লিখে তাদের প্রবর্তিত ধর্মে মানুষদের দীক্ষিত করতে। স্ট্রাউসের মূলকথা হচ্ছে নতুন টেস্টামেন্ট-এর গল্পগুলো সত্য নয়; মিসাইআ বা ত্ৰাতার আগমন সম্পর্কে ইহুদিরা দীর্ঘকাল ধ’রে যে-প্রত্যাশা ক’রে আসছিলো, গল্পগুলো তারই গল্পায়ন। ইহুদিরা বহুকাল ধ’রে প্রত্যাশা ক’রে আসছিলো একজন ত্ৰাতা আসবেন, কিন্ত তিনি আসছিলেন না। তাঁর আগমন সম্পর্কে পুরোনো টেস্টামেন্ট -এ আছে অনেক ভবিষ্যদ্বাণী; সুসমাচার লেখকেরা ওই ভবিষ্যদ্বাণীগুলোকে সাজিয়ে তৈরি ক’রে ফেলেছিলেন জেসাস ক্রাইস্টকে। মিসাইআ শব্দটি এসেছে হিব্রু মশিআহ থেকে, যার অর্থ ‘তৈলাক্ত ব্যক্তি’; এ-শব্দটি গ্রিকে হয় খ্রিস্টোস, যার থেকে এসেছে ইংরেজি ক্রাইস্ট, এবং বাঙলা খ্রিস্ট। রাজা এবং পুরোহিতদের শরীরে, তাদের কর্ম শুরুর সময়, তেলমাখানোর রীতি ছিলো ইহুদিদের; তাই তাদের বলা হতো মশিআহ; পরে এর অর্থ হয় ‘ত্ৰাতা’। ইহুদিরা অবশ্য প্রত্যাশা করছিলো রাজকীয় ত্রাতার, কিন্তু সুসমচারলেখকেরা রাজকীয় ত্রাতাকে বাদ দিয়ে সৃষ্টি করেন আধ্যাত্মিক রাজা, যে বলে, ‘অনুতপ্ত হও, কেননা স্বর্গের রাজত্ব আসন্ন, এবং সময় হয়ে গেছে, এবং ঈশ্বরের রাজত্ব আসন্ন; অনুতপ্ত হও, এবং সুসমাচারে বিশ্বাস করো।’ ঈশ্বর কোনো ত্ৰাতা পাঠান নি, কোনো ত্ৰাতা আসেন নি, ক্রাইস্ট সুসমাচার লেখকদের সৃষ্টি। তাঁরা পুরোনো টেস্টমেন্ট থেকে জানতেন ত্ৰাতা আসবেন; এ-বইতে বিশদভাবেই ব’লে দেয়া হয়েছে ত্ৰাতা কীভাবে আসবেন, কার গর্ভে জন্ম নেবেন, কী করবেন, কী বলবেন। এসব অবলম্বন ক’রে তারা জেসাসকে তৈরি করেন; ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে তাকে জন্ম দেন, তাকে দিয়ে কাজ করান, এবং তাকে দিয়ে কথা বলান। সুসমাচারগুলো উপন্যাসের থেকে সত্য নয়, জেসাসও সত্য নন উপন্যাসের নায়কের থেকে।
পুরোনো টেস্টামেন্ট ভ’রেই রয়েছে। নবিরা, এর পাতায় পাতায় নবি পাওয়া যায়; যেমন ওই অঞ্চলের পথে পথে নবি পাওয়া যেতো। ওই নবিদের অনেকেই ছিলো শস্ত জ্যোতিষ। ইংরেজি প্রফোঁট শব্দটি এসেছে একটি গ্রিক শব্দ থেকে, যার অর্থ ‘যে অন্যের হয়ে কথা বলে’। শব্দটি হিব্রুতে হচ্ছে নাবি, বা নাভি। মোজেস বা মুসা। তোতলা ছিলেন, ঠিক মতো কথা বলতে পারতেন না; জিহোভার ডাকে সাড়া দিয়ে নবি হওয়ার ইচ্ছেও তার ছিলো না, অনিচ্ছায়ই তিনি নবি হয়েছিলেন। জিহোভা তাঁকে বলেছে, আমি তোমাকে ফারাওদের ঈশ্বর করছি, আর তোমার ভাই আরোন (অর্থাৎ হারুন) হবে তোমার নবি।’ নবি শব্দটি এসেছে নাবু থেকে, যার অর্থ ‘ডাকা, ঘোষণা করা’। তাই ‘নবি’র অর্থ হ’তে পারে ‘ঘোষণাকারী, আহবানকারী’, বা হ’তে পারে ‘যাকে আহবান করা হয়েছে।’ বাইবেলে দু-অর্থেই শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। বাইবেলে জিহোভা বলেছে, ‘আমি তোমার পিতার ঈশ্বর, আব্রাহামের ঈশ্বর, আইজাকের ঈশ্বর, এবং জ্যাকবের ঈশ্বর…এসো, আমি তোমাকে ফারাওদের কাছে পাঠাবো যাতে তুমি আমার মানব, ইসরাইলের পুত্রদের, মিশর থেকে উদ্ধার ক’রে আনতে পারো।’ শব্দটির আরেক অর্থ পাঠানো, তাই নবি হচ্ছে প্রেরিতপুরুষ। সুসমাচারলেখকেরা পুরোনো বাইবেলের নবিদের উপাখ্যান ভালো ক’রেই জানতেন। বাউআর বলেছেন, তারা পুরোনো বাইবেলের নবিদের আদলে তৈরি করেছিলেন জেসাসকে, যিনি কখনো ছিলেন না। প্রথম শতকে ইহুদি আর গ্রিক-রোমীয় চিন্তাভাবনা থেকে উদ্ভব ঘটেছিলো খ্রিস্টধর্মের। সে-সময়ের অনেকে দাবি করেছেন যে জেসাসকে তৈরি করা হয়েছে তাই আনার অ্যাপোলোনিয়াসের আদলে। অ্যাপোলোনিয়াস ছিলেন একজন নবপিথাগোরীয় শিক্ষক, যিনি জন্ম নিয়েছিলেন খ্রিস্টীয় শতকের কিছু আগে, যিনি ভ্ৰাম্যমাণ কৃচ্ছতাপূর্ণ জীবন যাপন করতেন, নিজেকে দাবি করতেন অলৌকিক শক্তির অধিকারী ব’লে, এবং নিরো ও ডোমিতিয়ানের রাজত্বকালে বাস করতেন নিয়ত মৃত্যুভীতির মধ্যে। তাঁর অনুসারীরা তাকে বলতো ঈশ্বরের পুত্র।