পুরাণের একটি প্রধান কল্পনা হচ্ছে স্বৰ্গ ও নরক : মৃত্যুর পর পুণ্যবানদের জন্যে পুরস্কার ও পাপীদের জন্যে শাস্তির এলাকা। মৃত্যুর পর পুণ্যাত্মারা চিরসুখে বাস করবে, জীবনে পুজো করেছে যে-দেবতাদের পাবে তাদের সঙ্গ, এবং পাপীরা উ ৎপীড়িত হবে, এ-ধারণা কিছুটা অগ্রসর প্রায়-সব পুরাণেই পাওয়া যায়। মিশরি, ভারতি, ব্যাবিলনি, ও হিব্রু পুরাণে স্বৰ্গ আর নরক দখল ক’রে আছে বেশ বড়ো স্থান। কিন্তু গ্রিক, রোমীয়, স্কেন্ডিনেভীয় পুরাণে স্বৰ্গনরক নেই, আছে শুধু মৃতদের জন্যে এক বিশেষ স্থান, অন্যলোক-হেডিস। বৌদ্ধদেরও কোনো স্বৰ্গনারক নেই। কেনো একদল মানুষ স্বৰ্গনারক কল্পনা করেছে, আরেকদল করে নি? যারা স্বৰ্গনরক কল্পনা করেছে, তাদের নৈতিকতাবোধ কি উন্নত তাদের থেকে, যারা এমন কল্পনা করে নি? ধর্মীয় প্রচার আজকাল এতো ব্যাপক, এবং স্বৰ্গনরক। এতো বেশি পরিচিত যে অধিকাংশ মানুষই মনে করবে স্বৰ্গনারক যারা কল্পনা করেছে, তারা উন্নত নৈতিকতাবোধসম্পন্ন; আর যারা স্বৰ্গনরক কল্পনা করে নি, তারা নৈতিকতাবোধহীন। গভীরভাবে বিবেচনা করলে বুঝতে পারি স্বৰ্গনরকের কল্পনাকারীরা স্কুল, নিম্ন নৈতিকতাবোধসম্পন্ন; তারা উঠতে পারে নি। পার্থিব কামনাবাসনা, লালসাভীতির ওপরে, পারে নি মৃত্যুর মতো পরম নির্মম সত্যকে মেনে নিতে; তাই তৈরি করেছে মিথ্যে স্বৰ্গনরক। যারা স্বৰ্গনরকের কথা ভাবে নি, ভেবেছে শুধু অনিবার্য পরিণাম মৃত্যুর কথা, মনকে মিথ্যেয় ভোলায় নি, মেনে নিয়েছে সত্যকে, তাদের নৈতিক মান অনেক উন্নত। স্বৰ্গনরক সম্পূর্ণ বাজে কথা। রাসেল বলেছেন :
আমার মনে হয় ক্রাইস্টের নৈতিক চরিত্রে রয়েছে একটি বড়ো ত্রুটি: আর তা হচ্ছে যে তিনি বিশ্বাস করতেন নরকে। আমি মনে করি না যে গভীরভাবে মানবিক কোনো ব্যক্তি চিরশাস্তিতে বিশ্বাস করতে পারেন। সুসমাচারে ক্রাইস্টকে যেভাবে চিত্রিত করা হয়েছে তাতে এটা স্পষ্ট যে তিনি চিরশাস্তিতে বিশ্বাস করতেন। তার কথায় যারা বিশ্বাস করে না তাদের বিরুদ্ধে একটা প্রতিহিংসামূলক ক্ৰোধ ধর্মপ্রচারকদের মধ্যে সব সময়ই দেখা যায়।
টিউটোনিক বা জর্মনরা মনে করতো মৃতরা যায় লোকির কন্যা হেল-এর (Hel, এখনকার Hell) জগতে। হেল শব্দটি এসেছে যে-ধাতু থেকে, তার অর্থ ‘গোপন করা’; তাই হেলের অর্থ ‘গোপন জগত, গোপনবাসের জগত’; অৰ্থাৎ মৃতদের জগত। পরে খ্রিস্টানরা হেলকে ক’রে তোলে শাস্তির জগত-নরক। হেল মূলত শাস্তির জগত বা নরক ছিলো না, ছিলো বেশ সুখকর স্থান; পরে যখন ভাল হাল্লা, বীরদের স্বৰ্গ, ধারণা দেখা দেয়, হেল হয়ে ওঠে। মৃত্যুর পর তাদের বাসস্থান, যারা তরবারির আঘাতে মরে নি। এভাবে টিউটোনিক মৃতরা দুভাগে, মৃত্যুর রীতি অনুসারে, ভাগ হয়ে যায়; যেমন ঘটে মেক্সিকোতো, যেখানে মৃত বীরেরা যায় সূর্যদেবতার প্রাসাদে, যারা মরে বজপাতে বা প্লীহায়, তারা যায় জলদেবতার স্বৰ্গে, আর সাধারণেরা পচে মিকটল্যানের মৃত্যুগুহায়। টিউটোনিকদের ভালহাল্লা এক চমৎকার স্বৰ্গ; সেখানে মৃত বীরেরা দেবতাদের সাথে ভোজে আর দ্বন্দ্বে যাপন করে সময়। তবে এ-স্বর্গটি তৈরি একটি গাছের গুড়ির চারদিক ঘিরে। ওই গাছের পাতায় চ’রে বেড়ায় ইকথিরমির নামে এক হরিণ, আর হিডব্ৰুন নামে এক ছাগল, যাদের বঁটি থেকে অনিঃশেষ ঝরে সুরার ধারা, যা পান ক’রে বীরেরা মেটায় তৃষ্ণা। তবে ওই স্বর্গে তোরণের সংখ্যা মাত্র পাঁচশো চল্লিশটি, যা দিয়ে একবারে ঢুকতে পারে মাত্র আটশো যোদ্ধা। বীরদের জন্যে একটি বিশেষ স্বৰ্গ কেনো? বোঝা যায় এটি সেনাগোত্রের কল্পিত স্বৰ্গ; তারা শুধু পৃথিবীতে ঐশ্বর্ষে থেকেই তৃপ্তি পায় নি, মৃত্যুর পরও নিজেদের জন্যে একটি স্বৰ্গ তৈরি করেছে।
এসিরীয় বা ব্যাবিলনি পুরাণে মৃতরা থাকে শূন্যতা ও ঘোরে পরিপূর্ণ এক এলাকায়, যেখান থেকে কোনো প্রত্যাবর্তন নেই। কাদা আর ধুলো তার অধিবাসীদের খাদ্য, অন্ধকার উত্তরাধিকার। সেটি এমন গৃহ, যাতে নেই কোনো প্রস্থানপথ। ওই গৃহের প্রবেশপথে থাকে এক প্রহরী, যে প্রবেশকারীর থেকে গ্ৰহণ করে গৃহরানীর জন্যে অর্ঘ্য; এবং ভাগ্যহত প্রবেশকারীর ওপর ছড়িয়ে দেয় মন্ত্রজাল, একের পর এক সাতটি তোরণের ভেতর দিয়ে নিয়ে যায় তাকে, এবং হরণ করে তার পার্থিব সব অধিকার। এ-মৃত্যুলোকের রানীর নাম আল্লাতু, যে বসে রত্নখচিত সিংহাসনে। আল্লাতু প্ৰবেশকারীকে শাস্তি দিতে পারে, এবং পারে ক্ষমা করতে। এ-পুরাণে মৃত্যুলোক ও জীবনলোকের মধ্যে প্রবাহিত হয় একটি নদী, মৃত্যুর নদী;-এর কোনো আকার নেই, এটি পূর্ণ অসহ্য শীত ও বিষােদাচ্ছন্ন অন্ধকারে। এখানে অশরীরী আত্মারা নিরন্তর খুঁজতে থাকে বেরেনোর পথ। এ-মৃত্যুলোকে আছে একটি বিচারবিভাগও। ওই বিচারালয়ের দিকে যাওয়ার পথ পূর্ণ সব ধরনের বিপদ ও বিভীষিকায়, তবে মৃতদের অবশ্যই যেতে হয় ওই পথ দিয়ে। এ-মৃত্যুলোকে পুণ্যাত্মাদের জন্যেও আছে একটি এলাকা; বিচারের পর যারা পুণ্যাত্মা ব’লে বিবেচিত হয়, তারা বাস করে সেখানে। প্রশান্ত রুপোলি আকাশের নিচে, স্বচ্ছসলিলা নদীর তীরে, সেখানে বাস করে পুণ্যবান প্রাচীন প্রেরিতপুরুষেরা।
ইহুদিদের নরকের নাম জেহেনা, যার থেকে এসেছে মুসলমানদের জাহান্নাম। জেহেন্নায় পাপীদের দেয়া হয় শারীরিক ও আত্মিক দু-ধরনেরই শাস্তি। এখানে চিরশাস্তির মধ্যে থাকে অন্য জাতির মানুষেরা; অবিশ্বাসী ইহুদিরাও থাকে, তবে এটা তাদের জন্যে পাপমোচনের এলাকা; পাপমুক্তির পর তারাও যায় স্বর্গে। শিওল নামেও আছে একটি ইহুদি মৃত্যুলোক, যেটি একান্তভাবেই হিব্রু বা ইহুদি। হিব্রুরা জেহেন্না ধারণাটি ধার করেছিলো আক্কাদীয় জি-উমুনা থেকে। শিওল মৃত্যুর পর পুণ্যবান ও পাপী উভয়েরই বাসস্থান; গ্রিক হেডিসের মতো জীবন যেখানে ছায়াচ্ছন্ন ও অশরীরী। ফিশাইয়াতে (১৪, ৯-১১) আছে :