প্রাচীন ভারতিরা বিশ্বসৃষ্টি সম্পর্কে নিরবধি বুনেছে কল্পনার জাল। ঋগ্বেদ-এর ঋষিরা কল্পনা করতে গিয়ে বিহ্বল হয়েছেন, দেখেছেন মহাশূন্যতা। তাঁরা বলেছেন, শুরুতে অসত্তাও ছিলো না, সত্তাও ছিলো না, ছিলো শুধু আঁধারে আবৃত জলরাশি। তারপর সেখানে জাগে কর্ম বা বাসনা। ঋগ্বেদ বলেছে :
অস্তি ছিলো না, নাস্তিও ছিলো না, বায়ু ছিলো না, দূরে আকাশও ছিলো না; কে ছিলো সব কিছু আবৃত ক’রে? কার ওপর নির্ভর করে ছিলো সব কিছু? অতল জলের ভেতরে? তখন মৃত্যু ছিলো না, অমৃত্যুও ছিলো না, ছিলো না রাত্রি ও দিনের বদল; শুধু একজনই নিশ্বাস নিচ্ছিলো ধীরে, তার বাইরে ছিলো না। আর কিছু। কে জানে কখন উদ্ভূত হয়েছিলো এই মহাসৃষ্টি? তখন কোনো দেবতার জন্ম হয় নি, তাই কে প্রকাশ করতে পারে। এ-সত্য? কখন জন্মেছে। এ-জগত, আর তা স্বৰ্গীয় না। অন্য কোনো হাতের রচিত, তা বলতে পারে শুধু স্বর্গে বিরাজমান এর প্রভু, যদি সম্ভব হয় তার পক্ষে।
ঋগ্বেদ-এর ঋষির অনিশ্চয়তাবোধে তৃপ্ত হয় নি যাযাবর আর্যরা, তারা আরো নিশ্চিত হ’তে চেয়েছে, এবং ঋগ্বেদ-এর পুরুষসক্ত-এ বলা হয়েছে :
পুরুষের রয়েছে সহস্র মস্তক, সহস্ৰ চোখ, সহস্ৰ পদ। পৃথিবীর সব দিক জুড়ে দশ আঙুলের সমান ভূমিতে তিনি বিরাজ করেন। পুরুষ নিজেই সমগ্র বিশ্ব, যা ছিলো, এবং যা হবে।
তারা আরো বলেছে যে দেবতারা খণ্ডিত করে পুরুষকে; তার মুখ থেকে জন্মে ব্ৰাহ্মণ, বাহু থেকে রাজন্য, উরু থেকে বৈশ্য, পা থেকে শূদ্র; তার মন থেকে জন্মে প্রভাত, চোখ থেকে সূর্য, মুখ থেকে ইন্দ্র আর অগ্নি ইত্যাদি, অর্থাৎ রাশিরাশি বাজে কথা। সপ্তপথ ব্রাহ্মণ-এ পাওয়া যায় যে ভু’ উচ্চারণ ক’রে প্রজাপতি সৃষ্টি করে পৃথিবী, ভুবহু’ উচ্চারণ ক’রে বায়ু, ‘স্বহ’ উচ্চারণ ক’রে আকাশ; ভু’ ব’লে প্রজাপতি সৃষ্টি করে ব্ৰাহ্মণ, ভুবহ’ বলে ক্ষত্র ইত্যাদি। তৈক্তিরিয়া ব্রাহ্মণ-এ আছে ব্ৰহ্মা সৃষ্টি করেছে বিশ্ব, তারপর কী কী সৃষ্টি করেছে, তারও বর্ণনা আছে। হিন্দুদের পুরাণগুলোতে পাওয়া যায় সৃষ্টিপ্রক্রিয়ার বিস্তৃত বিবরণ। যেমন, বিষ্ণুপুরাণ-এর মতে ব্ৰহ্মা আদিতে ছিলো পুরুষ বা চৈতন্য এবং কালরূপে, তারপর তাতে যুক্ত হয় আরো দুটি রূপ; এবং ব্ৰহ্মার চারটি সত্তা-প্রধান উপাদান, পুরুষ, ব্যক্ত বা দৃশ্যমান বস্তু, ও কালই বিশ্বসৃষ্টি, রক্ষা ও ধ্বংসের কারণ। এর সবই হচ্ছে কল্পনার দীর্ঘ জালবিস্তার।
ব্যাবিলনের সৃষ্টিতত্ত্বে আদিম দেবতা দুটি-আপ সু ও তিয়াওয়াথ। তাদের পর সৃষ্টি হয় কয়েকটি নতুন দেবতা—আনু. এন-লিল, ও ইআ। তাদের আচরণ পছন্দ হয় না। আপসু এবং তিয়াওয়াথের, তারা শাস্তি দিতে চায় নতুন দেবতাদের; কিন্তু পরাভূত হয় নতুন দেবতাদের কাছে। তিয়াওয়াথ দানব সৃষ্টি ক’রে নতুন দেবতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যায়; কিন্তু নিহত হয় মেরোডাকের সাথে যুদ্ধে। তাকে দু-ভাগে কাটা হয়; তার দেহের একভাগ দিয়ে মেরোডাক সৃষ্টি করে আকাশ। মেরোডাক ভাগ করে ওপর আর নিচের জল, বাসস্থান তৈরি করে দেবতাদের; সৃষ্টি করে চাঁদ তারাসূর্য নির্দেশ করে কক্ষপথ। এক সময় তার শিরশ্ৰেছদ করা হয়, তার অস্থি আর রক্তে সৃষ্টি হয় মানুষ। এ হচ্ছে চমৎকার আদিম কল্পনা।
পুরোনো বাইবেল-এ আছে হিব্রুসৃষ্টিতত্ত্ব। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কেননা পৃথিবীর তিনটি প্রধান ধর্ম বিশ্বাস করে এ-সৃষ্টিতত্ত্বে; অর্থাৎ পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ মানে এবং বিভ্রান্ত হয় এটি দিয়ে। বাইবেলের সৃষ্টিতত্ত্ব মৌলিক নয়, এর অনেকখানি ধার করা হয়েছে ব্যাবিলনি সৃষ্টিতত্ত্ব থেকে; এবং এর নানা মিল রয়েছে হিন্দুসৃষ্টিতত্ত্বের সাথেও। আদিপুস্তক-এর জগৎ-সৃষ্টির বিবরণ’-এ বলা হয়েছে : ‘পৃথিবী ঘোর ও শূন্য ছিল, এবং অন্ধকার জলধির উপরে ছিল, আর ঈশ্বরের আত্মা জলের উপরে অবস্থিতি করিতেছিলেন।… পরে ঈশ্বর কহিলেন, জলের মধ্যে বিতান হউক, ও জলকে দুই ভাগে পৃথক করুক। ঈশ্বর এইভাবে বিতান করিয়া বিতানের উধ্বস্থিত জল হইতে বিতানের অধঃস্থিত জল পৃথক করিলেন; তাহাতে সেইরূপ হইল। পরে ঈশ্বর বিতানের নাম আকাশমণ্ডল রাখিলেন।’ বাইবেলের ঈশ্বর আদিম জলরাশিকে মঞ্চের সাহায্যে দু-ভাগ করে, যার ওপর স্থাপন করে গগনমণ্ডল। ব্যাবিলনি সৃষ্টিতত্ত্বের তিয়াওয়াথের লাশ দু-ভাগ করার সাথে মিল আছে। এর। বাইবেলে আছে, ‘পরে ঈশ্বর কহিলেন, দীপ্তি হউক; তাহাতে দীপ্তি হইল।’ ব্যাবিলনি সৃষ্টিতত্ত্বে নেই। এ-আলোবিকাশের কথা, তবে ব্যাবিলনি ঈশ্বর মেরোডাক নিজেই আলোর দেবতা।
ইরানি বা জুরথুস্ত্রি সৃষ্টিতত্ত্বে আহুর মাজদা বা ওরমুজদ স্রষ্টা ও শুভশক্তি। সে সৃষ্টি করেছে সব কিছু। সে অবশ্য বিশ্বের জন্যে বেশি দিন আয়ুধার্য করে নি, করেছে বারো হাজার বছর। এটা আজকাল হাস্যকর মনে হয়, কেননা আজ আমরা অনন্ত মহাকালের ধারণা করতে পারি; আদিম মানুষের কোনো অসীম অনন্ততার বোধ ছিলো না; তখন বারো হাজার বছরই ছিলো মহাকাল, আর হয়তো পাঁচশো মাইলই ছিলো অনন্ত অসীম। ইরানি সৃষ্টিতত্ত্বে ছিলো একটি শয়তানও, যার নাম আহরিমান। আহরিমান আগে ওরমুজাদের কথা জানতো না, একদিন ওরমুজাদের শরীর থেকে বিছুরিত জ্যোতি দেখে সে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। তিন হাজার বছরে ওরমুজদ সৃষ্টি করে বিশ্ব, সূর্যচন্দ্রনক্ষত্র, উদ্ভিদ, প্রাণী, ও মানুষ। তবে আহরিমান ওরমুজুদের প্রতিটি শুভ সৃষ্টির বিরুদ্ধে অশুভ সৃষ্টির অভিযান চালিয়ে যেতে থাকে; সে হয় অশুভর। ঈশ্বর। তিন হাজার বছর ধরে চলে শুভ-অশুভর যুদ্ধ; তবে জুরথুস্ত্রের জন্মের সাথে জয়ী হয় শুভশক্তি। ইরানি সৃষ্টিতত্ত্বে শুভ-অশুভর বিরোধ খুব বড়ো ব্যাপার, যা নেই হিন্দু সৃষ্টিতত্ত্বে; কিন্তু প্রবলভাবে রয়েছে হিব্রু আর আরব সৃষ্টিতত্ত্বে। তাদের গোপন চিন্তায় ঈশ্বর একটি নয়, দুটি; একটি শুভর, আরেকটি অশুভর।