মানুষ উৎপাদন করেছিলো অজস্র দেবতা। এক সময় তারা আকাশমণ্ডল ভরে ফেলেছিলো দেবতায়; এবং তাদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিলো নানা বিভাগের দায়িত্ব। কাউকে দেয়া হয়েছিলো অগ্নিবিভাগের দায়িত্ত্ব, সে অগ্নিদেবতা; কাউকে জলবিভাগের দায়িত্ব, সে জলদেবতা; এভাবে দেখা দিয়েছিলো বায়ুদেবতা, বজদেবতা, মাটির দেবতা, মদের দেবতা, শস্যের দেবতা, এবং শিল্পকলা, শিক্ষা, ধন ও আরো অসংখ্য বিভাগের দেবতা। ঋগ্ধেদন্-এর ঋষিরা তৈরি করেছিলো ৩৩টি দেবতা;-১১টি পৃথিবীতে, ১১টি অন্তরীক্ষে, ১১টি স্বর্গে তারপর বিভিন্ন বস্তুর অধিপতি হিশেবে কল্পনা করেছিলো ৩৩ কোটি দেবতা। তারা এসব দেবতা সৃষ্টি করেছিলো দেবতার জন্যে দেবতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে নয়, নিজেদের কল্যাণের জন্যেই। তারা চারপাশের সব কিছুকে নিজেদের কল্যাণের জন্যে ব্যবহার করতো, এবং বিশ্বাস করতো। ওই সব কিছুরই দেবতা রয়েছে, তাই দেবতাদের পুজো করলে দেবতারা তাদের জীবনকে সম্পদে ভ’রে দেবে। দেবতাদের সাথে তাদের থাকতো একটি চুক্তি, চুক্তিটি হচ্ছে দেবতারা তাদের অন্ন দেবে, বিনিময়ে তারা দেবে দেবতাদের অর্ঘ্য। তাদের কয়েকটি দেবতার কথা বিবেচনা করা যেতে পারে। আজ আমরা জানি সূর্যই পার্থিব সব কিছুর উৎস; আদিম মানুষেরাও সূর্যকেই মনে করতো জীবনের উৎস বলে। তবে তারা আজকের মতো জানতো না, তারা জানতো তাদের মতো ক’রে। সব দেশের পুরাণেই দেবমণ্ডলির মধ্যে সূর্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করে আছে। সর্বাত্মাবাদীরা মনে করতো মানুষের মতোই সূর্যের আছে প্রাণ ও ইচ্ছাশক্তি, তাই সে চলতে পারে। বৈদিকরা সূর্যশ্রেণীতে সৃষ্টি করেছিলো বহু দেবতা : আদিত্য, মিত্র, বরুণ, পূষা, ভগ, অশ্বিনীকুমার, সবিতা প্রভৃতি। গ্রিকরা দুটি সূর্যদেবতা সৃষ্টি করেছিলো, একটি অ্যাপোলো, আরেকটি সূর্য নিজে, যার নাম হেলিওস। অ্যাপোলো তিমিরবিনাশী দেবতা, যে সোনালি তীরের আঘাতে হত্যা করে রাত্রির সাপ পাইথনকে, এবং তার এক কাজ হচ্ছে সভ্যতার বিকাশ ঘটানো। পৃথিবী জুড়েই পাওয়া যায় সূর্যদেবতা-ইন্দ্র, ক্যাডমাস, হোরাস প্রভৃতি, এবং তাদের উদ্ভবের উপাখ্যানের মধ্যেও মিল রয়েছে। সূর্যদেবতার মতো বজদেবতাও পাওয়া যায় পৃথিবী ভীরে। আদিম মানুষ সৃষ্টি করেছিলো অজস্র দেবতা, যাদের এখন আর আমরা, হিন্দুরা ছাড়া, দেবতা মনে করি না; এবং বিশ্বাস করি না দেবতায়।
দেবতাদের কাল শেষ হয়ে আসতে থাকে; বহুদেবতাবাদের পর, তিন-চার হাজার বছর আগে, মানুষ এগোয় একদেবতাবাদ বা একেশ্বরবাদের দিকে; তবে মানুষ কখনোই সম্পূর্ণরূপে একেশ্বরবাদী হয়ে ওঠে নি। একদেবতাবাদীদের ধর্মীয় ক্রিয়াকলাপে, প্রচ্ছন ও স্পষ্টভাবে, বহুদেবতার মুখ দেখা যায়। ঈশ্বর বা বিধাতা বললে দেবতার থেকে মহান কিছু বোঝায় ব’লে অনেকের মনে হয়; কিন্তু ঈশ্বর বা বিধাতাও দেবতাই। এতে যা ঘটে তা হচ্ছে বহুদেবতাকে সরিয়ে একটি দেবতার প্রতিষ্ঠা। বহুদেবতাবাদ থেকে নানা প্রক্রিয়ায় দেখা দেয় একদেবতাবাদ। মানুষই সৃষ্টি করেছিলো বহুদেবতা, আবার মানুষই সৃষ্টি করে একদেবতা; এতে দেবতাদের কোনো ভূমিকা নেই। কখনো বহুদেবতার মধ্যে একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে একটি বিশেষ দেবতা, কেননা সেটি বিজয়ী জাতির দেবতা; সে নিজে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে নি, তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে বিজয়ী জাতি; কখনো পুরোহিতেরা বহুদেবতা পছন্দ করে নি, অন্য সব দেবতাকে বাদ দিয়ে প্রধান ক’রে তুলেছে একটিকে; কখনো ভক্তরা ছোটো দেবতাদের শক্তি কমিয়ে শক্তিশালী ও জনপ্রিয় ক’রে তুলেছে বিশেষ একটি দেবতাকে; কখনো দৃঢ়প্রতিজ্ঞ কেউ এসে একাধিক দেবতার মধ্য থেকে একটিকে ঈশ্বর বা বিধাতা ব’লে ঘোষণা ক’রে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে তার প্রেরিতপুরুষরূপে; কখনো দেশের রাজবংশটি প্রধান ক’রে তুলেছে একটি দেবতাকে। এতে দেবতাটির কোনো কৃতিত্ব নেই; সব কৃতিত্ব মানুষের। একদেবতাবাদ ও বহুদেবতাবাদের মধ্যে কোনোটি উৎকৃষ্ট বা নিকৃষ্ট নয়, যদিও এখন একদেবতাবাদকেই উৎকৃষ্ট ব’লে প্রচার করা হয়। ভাষার খেলাও কাজ করে এখানে। একদেবতাবাদকে বলা হয় একেশ্বরবাদ, তবে দেবতা ও ঈশ্বর মূলত একই জিনিশ। ইংরেজিতে শুরুতে বড়ো অক্ষর দিয়ে লেখা হয় ঐমঢ; দেবতাদের বেলা লেখা হয় ছোটো অক্ষরে থমঢ়; এটা ভাষার খেলা। এমন কোনো মানদণ্ড নেই, যা দিয়ে একটিকে উৎকৃষ্ট ও অন্যটিকে নিকৃষ্ট প্রমাণ করা যায়। দুটিই সমান আদিম কল্পনা। তবে বহুদেবতাবাদ অনেকটা নিরীহ, ওই দেবতারা সারাক্ষণ মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করার ও শাস্তি দেয়ার জন্যে উত্তেজিত থাকে না; কিন্তু একদেবতাবাদের দেবতা বা বিধাতা প্ৰচণ্ড নিয়ন্ত্রণবাদী, হিংস্র, ও বিদ্বেষপরায়ণ। একদেবতাবাদের দেবতার থাকে স্বৈরাচারী প্রবণতা; সে নিজের বন্ধ্যা নিঃসঙ্গতায় বিরাজ করে মহাজাগতিক একনায়করূপে। নিঃসঙ্গ একদেবতা ভালোবাসা চায় না . ভক্তদের; সে চায় তার ভয়ে ভক্তরা কাপবে থরথর করে, ভক্তরা হবে তার দাস।
আদিম মানুষ সৃষ্টি করেছিলো অজস্র পুরাণ। তারা যে-প্ৰপঞ্চেরই মুখোমুখি হয়েছে, তার সম্পর্কেই উপাখ্যান তৈরি করেছে-সত্য বের করতে পারে নি; এবং এমন অনেক কিছু সম্পর্কে উপাখ্যান তৈরি করেছে, যার মুখোমুখি তারা কখনো হয় নি; তাই তার সত্য আবিষ্কারের কথাই ওঠে না। তারা তৈরি করেছে বিশ্ব ও মানুষ সৃষ্টির পুরাণ, বন্যার পুরাণ, স্বর্গের পুরাণ, নরকের পুরাণ, অগ্নির পুরাণ ও আরো অজস্র পুরাণ। সব পুরাণেই ব্যাখ্যা করা হয়েছে বিশ্বসৃষ্টিতত্ত্ব; এবং এখনকার প্রচলিত ধর্মগুলো বিশ্বসৃষ্টির তত্ত্ব ধার করেছে বিভিন্ন পুরাণ থেকে। পুরাণের বিশ্বসৃষ্টিতত্ত্ব যেহেতু ভুল বা অবৈজ্ঞানিক, তাই পৃথিবীর ধর্মগুলোর বিশ্বসৃষ্টিতত্ত্বও ভুল এবং অবৈজ্ঞানিক। আদিম মানুষের কাছে জল ছিলো এক মহাব্যাপার; তাই সৃষ্টিপুরাণগুলোতে সাধারণত পাওয়া যায় জলের এক মহাজগত, যার ভেতরে উদ্ভূত হয় স্বয়ম্ভু স্রষ্টা, এবং কোনো শব্দ উচ্চারণ করে, বা ইচ্ছাশক্তিতে, বা শারীরিক শ্রমে সৃষ্টি করে জগত বা পৃথিবী। সাধারণত সে অতল জলের পাতাল থেকে উদ্ধার করে পৃথিবীকে। ব্যাবিলনিরা মনে করতো বেল বা মেরোডাক স্বর্গ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছে তিয়াওয়াথের শরীরের দু-টুকরো দিয়ে; পারসি জুরথুস্ত্রিরা বিশ্বাস করতো আহুর মাজদা বা ওরমুজদ হচ্ছে স্রষ্টা; গ্রিকরা বিশ্বাস করতো ইউরেনাস আর গ্যাআর মিলনে জন্মেছে সব কিছু; হিন্দুরা মনে করে বরাহ অবতাররূপে ব্ৰহ্মা জলের অতল থেকে দীতে গেথে উদ্ধার করে পৃথিবীকে, এবং শুরু করে সৃষ্টির কাজ; জাপানিরা মনে করে ইজানাগি আর ইজানামির মিলনে সৃষ্টি হয়েছে জগত: পেরুর ইনকাসরা বিশ্বাস করতো আতাগুজু সৃষ্টি করেছে সব কিছু। মানুষ সৃষ্টির পুরাণে সাধারণত পাওয়া যায় যে এক অলৌকিক সত্তা মানুষ সৃষ্টি করেছে। কাদা বা ধুলো থেকে। সে অনেক সময় মানুষকে ভিজিয়ে নেয় নিজের রক্তে বা ঘামে, এবং তার ভেতর সঞ্চার করে প্রাণ বা নিশ্বাস। গ্রিকরা বিশ্বাস করতো প্রমেথিউস সৃষ্টি করেছে নরনারী; হিন্দুরা মনে করে ব্ৰহ্মা বা প্রজাপতি সৃষ্টি করেছে মানুষ; ব্রাজিলের আদিবাসীরা মনে করে অধোলোক থেকে মানুষ এসেছে; মধ্য আমেরিকার কিচেরা মনে করে মানুষ সৃষ্টি হয়েছে। হলদে আর শাদা ভুট্টা থেকে। এর সবগুলোই সম্পূর্ণ ভুল।