রাষ্ট্রের কাছে কবিতার কোনো মূল্য নেই–রাষ্ট্র কোথাও কবির জন্যে কোনো পদ রাখে না, কিন্তু দিশতলা দালান খুবই মূল্যবান; তবে একটি দশতলা দালানের মালিক হওয়ার থেকে অনেক কঠিন অবসরের গান’ লেখা। জীবনানন্দ অবশ্য ওই কবিতাটির বদলে একটি একতলা দালান বানাতে পারলে ট্রামলাইনের পাশে একটু সাবধানে হাঁটতেন। তবে জীবনানন্দ ছাড়া কেউ ওই কবিতাটি লিখতে পারতেন না; দশতলার মালিক অনেকেই হ’তে পারেন, যাদের ঠিক যোগাযোগটি আছে, কিন্তু কোনাে যোগাযোগের ফলেই ওটি লেখা সম্ভব নয়। কে মূল্যবান-জীবনানন্দ না রাষ্ট্রপতি? আমি আনন্দ পাই কল্পনায় এবং চিন্তায়; কল্পনা ও চিন্তায় আমি জীবনের বড়ো অংশ ব্যয় করেছি-আনন্দে। আমি দিশতলা আর পাজেরো করতে পারতাম, ফুলের মালায় নিজের গলদেশও ভ’রে তুলে অমর হতে পারতাম; আমি কি পারতাম না?-কিন্তু ওইসব আমাকে আনন্দ দেয় না, আনন্দ পাই আমি কল্পনা ও চিন্তায়, যাতে সমাজরাষ্ট্রের কোনো দরকার নেই। এই আনন্দ ইন্দ্ৰিয়ের সুখের থেকে অনেক ভিন্ন, উৎকৃষ্টও হয়তো, কিন্তু তা আমি বলতে চাই না, আমার ইন্দ্ৰিয়গুলোকে আমি কখনোই নিন্দিত করতে চাই না। ইন্দ্ৰিয়গুলোকে আমি ভালোবাসি, যেমন ভালোবাসি আমার মগজকে, যা আমি দেখি নি, যার ক্রিয়াকলাপ বুঝি না আমি, যা আমার কাছে কিংবদন্তির মতো।
তবে সব কিছুই নিরর্থক, জগত পরিপূর্ণ নিরর্থকতায়; রবীন্দ্রনাথও নিরর্থক, আইস্টাইনও নিরর্থক; ওই গোলাপও নিরর্থক, ভোরের শিশিরও নিরর্থক; তরুণীর চুম্বনও নিরর্থক, দীর্ঘ সুখকর সঙ্গমও নিরর্থক, রাষ্ট্রপতিও নিরর্থক। কেননা সব কিছুরই পরিণতি বিনাশ। বিস্ময়কর বিশ্ব, রঙিন ফুল বা মানুষ বা বন্যাশুয়াের, সূর্য বা নক্ষত্র, গ্ৰহউপগ্রহ সব কিছুর জন্যেই অপেক্ষা করে আছে তাদের পরিণতিবিনাশ, যার থেকে কোনো উদ্ধার নেই। এ-মহানিরর্থকতায় ভয় পেয়ে কতোগুলো শিশুতোষ রূপকথা তৈরি করতে পারি। আমরা, যেমন তৈরি করেছি। ধর্মের রূপকথা, তৈরি করেছি। স্রষ্টা, পাপ, পুণ্য, স্বৰ্গ আর নরক। এ হচ্ছে তাৎপর্যহীন জীবনকে তা ৎপর্যপূর্ণ করার স্থূলতম প্রয়াস। জীবনের তাৎপর্যহীনতা ভাবুক মানুষকে পাগল ক’রে তুলতে পারে, তাই বিচিত্র ধরনের ভাবুক চেষ্টা করেছে একে বিচিত্ররূপে তল ৎপর্যপূর্ণ ক’রে তুলতে; ধর্ম একে তাৎপর্যপূর্ণ করতে চেয়েছে সবচেয়ে নিকৃষ্টরূপে, এবং একে আরো নিরর্থক ক’রে তুলেছে। এই যে আমি বেঁচে আছি, বেঁচে থেকে সুখ পাচ্ছি, আমি ম’রে যাবাে, এই হাস্যকর নিরর্থকতাকে কীভাবে অর্থপূর্ণ ক’রে তুলতে পারি। আমি? আমার জীবনকে অর্থপূর্ণ ক’রে তােলার কোনাে পূর্বনির্ধারিত উপায় নেই, কোনাে পবিত্র বা অপবিত্র বই বা কােনাে মহাপুরুষ বা প্রবর্তক আমাকে পথ দেখাতে পারেন না। তারা খুঁজেছেন নিজেদের পথ, নিজেদের জীবনকে তাৎপর্যপূর্ণ করার পথ; আমি তাদের পথে চলতে পারি না, আমি খুঁজতে চাই আমার পথ, নিজের জীবনকে তাৎপর্যপূর্ণ করার দায়িত্ব সম্পূর্ণরূপে আমার নিজের। বেশ আগে একটি কবিতা লিখেছিলাম, নাম ‘ব্যাধিকে রূপান্তরিত করছি মুক্তোয়”। কবিতাটির কথা আমার মনে পড়ে; কবিতাটি একবার পড়তে চাই :
একপাশে শূন্যতার খোলা, অন্য পাশে মৃত্যুর ঢাকনা,
পড়ে আছে কালো জলে নিরর্থ ঝিনুক ।
অন্ধ ঝিনুকের মধ্যে অনিচ্ছায় ঢুকে গেছি রক্তমাংসময়
আপাদমস্তক বন্দী ব্যাধিবীজ। তাৎপৰ্য নেই কোনো দিকে–
না জলে না দেয়ালে-তাৎপর্যহীন অভ্যন্তরে ক্রমশ উঠছি বেড়ে
শোণিতপ্লাবিত ব্যাধি। কখনাে হাল্লা ক’রে হাঙ্গরকুমিরসহ
ঠেলে আসে হলদে পুঁজ, ছুটে আসে মরা রক্তের তুফান।
আকস্মিক অগ্নি ঢেলে ধেয়ে আসে কালো বজ্রপাত।
যেহেতু কিছুই নেই করণীয় ব্যাধিরূপে বেড়ে ওঠা ছাড়া,
নিজেকে-ব্যাধিকে—যাদুরসায়নে রূপান্তরিত করছি শিল্পে–
একরাত্তি নিটােল মুক্তোয়!
ঝিনুক ও মুক্তোর রূপকে জীবনের তাৎপর্যশূন্যতার মর্মান্তিক সৌন্দর্য উপস্থাপন করতে চেয়েছিলাম কবিতাটিতে। মুক্তো সুন্দর, প্রিয়, মূল্যবান; কিন্তু ঝিনুকের জন্যে তা ব্যাধি, ঝিনুক তার ব্যাধিকে এমন রূপ দেয় যা মানুষের কাছে মুক্তো। এই মহাজগত এক বিশাল ঝিনুক, যার দুটি ঢাকনার একটি শূন্যতা, অন্যটি মৃত্যু; কোথাও কোনো তাৎপর্য নেই; ওই ঝিনুকের মধ্যে রোগবীজাণুর মতো ঢুকে গেছি। আমি। আমরা সবাই। আমি কী করতে পারি ওই নিরর্থক শূন্যতায়? পারি শুধু ব্যাধিরূপে বেড়ে উঠতে, ব্যাধিতে বিশ্ব ভ’রে দিতে; কিন্তু আমি তা করছি না, ব্যাধিকে ঝিনুকের ব্যাধির মতো রূপান্তরিত করছি শিল্পকলায়। এ হচ্ছে চূড়ান্ত অর্থহীনতাকে অর্থপূর্ণ করার এক সুন্দর ব্যৰ্থ করুণ প্রয়াস।
এ-প্ৰয়াস সুন্দর, কিন্তু ব্যর্থ; এতে কি তাৎপর্যমণ্ডিত হয়ে ওঠে। জীবন? মনে পড়ে আলবেয়ার কামু ও তার অ্যাবসার্ড বা নিরর্থকতাকে। আমি পুরাণ থেকে অনেক দূরে, পৌরাণিক উপাখ্যান ও চরিত্রগুলো আমার ভেতর ঢেকে না, পুরাণ আমার কাছে আদিম বিশ্বাস মনে হয় ব’লেই হয়তো, কিন্তু কামু বেছে নিয়েছিলেন গ্রিসীয় পুরাণের সিসিফাসকে। রাজা সিসিফাস মানুষ, নিয়তিদণ্ডিত, কিন্তু সে নিয়তিকে মানতে রাজি হয় নি, দাঁড়াতে চেয়েছে মুৰ্থ বর্বর অন্ধ অসুন্দর নিয়তির মুখোমুখি। স্বৈরাচারী দেবতাদের কাছে আত্মসমৰ্পণ করতে সে চায় নি; কিন্তু দেবতারা নিষ্ঠুর শক্তিধর প্রতিশোধস্পৃহ, তারা সিসিফাসকে বাধ্য করে একটি বিশাল পাথরখণ্ডকে ঠেলে ঠেলে পাহাড়ের চুড়োয় উঠোতে, কিন্তু উঠোনোর পরেই ওই পাথর গড়িয়ে পড়ে পাহাড়ের পাদদেশে, আবার সেটি ঠেলে ঠেলে উঠোতে হয় সিসিফাসকে। অনন্তকাল ধ’রে সে এই নিরর্থক পীড়াদায়ক দণ্ডে দণ্ডিত। একই ক্লান্তিকর কাজ সে ক’রে চলে চিরকাল, তার জীবন একই নিরর্থক পুনরাবৃত্তির সমষ্টি। আমরা এই নিরর্থক পুনরাবৃত্তি থেকে একটুও এগােই নি, কামু বলেছেন, আমাদের জীবন একই রোববারের পর সোমবার, সোমবারের পর মঙ্গলবার, মঙ্গলবারের পর বুধবারের, একই নিরর্থকতার পুনরাবৃত্তি। এই নিরর্থকতার মুখোমুখি কীভাবে দাঁড়াতে পারি? কামুর মতে একটিই সত্যিকার দার্শনিক সমস্যা রয়েছে, তা হচ্ছে আত্মহত্যা। জীবনের এই মহানিরর্থকতায় মানুষ একটি কাজই করতে পারে, তা হচ্ছে আত্মহত্যা। জীবন কি যাপন করার উপযুক্ত? বেঁচে থাকার কি কোনো মানে হয়? কোনো অর্থ কি আছে ‘নিরুদ্দেশ যাত্ৰা” লেখার, বা মহাকাশে নভোযান পাঠানোর, বা নারীর নগ্ন স্তনে চুম্বনের, বা জন্মদানের?