কীটসের ‘Ode to a Nightingale’-এর কোনো বাঙলা অনুবাদ আমি দেখি নি। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত এক সময় জনপ্রিয় ছিলেন, কিন্তু রোম্যান্টিক ছিলেন না; বাছবিচার না ক’রে তিনি যান্ত্রিকভাবে অনুবাদ করেছিলেন বিশ্বের কবিতা, যেগুলো অনুবাদ হিশেবে ব্যৰ্থ। ওগুলোর নাম দিয়েছিলেন তিনি তীর্থ-সলিল। তাতে পাই কীটসের দুটি কবিতার অনুবাদ : ‘দুখ-শব্বরী মাঘে’ ও ‘নিষ্ঠুরা সুন্দরী’। প্রথমটি অনুবাদ ‘In drear-nighted December’-এর, এবং দ্বিতীয়টি La Belle Danie Sout Merci-র একটি ব্যালাডের অনুবাদ। দুটিই বেশ খারাপ অনুবাদ; এবং আমি দুঃখ পাই যে তিনি কীটসের কোনো ঔডের অনুবাদ করেন নি; এবং সুখী বোধ করি যে তিনি কীটসের কোনো ঔডের অনুবাদ করেন নি।
আঠারো বছর বয়সে, পাঠ্যকবিতা হিশেবে, প্রথম পড়েছিলাম ‘Ode to a Nightingale’, যিনি পড়িয়েছিলেন, পুরোপুরি নষ্ট ক’রে দিয়েছিলেন তিনি কবিতাটি, কিন্তু কবিতাটি আমার ভেতরে ভেঙে ভেঙে ঢুকেছিলো; আমি কিছু বুঝেছিলাম, অনেক বুঝি নি, কিন্তু এর সুর আর রূপ আমাকে মথিত করেছিলো, যেমন করে আজো। বহু বার কবিতাটি অনুবাদের কথা ভেবেছি আমি, কিন্তু এর রূপ ও আবেগ, এবং শব্দের গুঞ্জন অনুবাদ অসাধ্য মনে হয়েছে। বাঙলায় কিছুতেই ধরা পড়ে না ‘My heart aches, and a drowsy numbness pains/My sense’-এর যন্ত্রণা, বিবশতা, ও গুঞ্জন; ধরা পড়ে না ‘Fade far away, dissolve. and quite forget/What thou among the leaves hast never known/The weariness. the fever, and the fret’-এর করুণা বিষণ্ণ নঃশব্দ হাহাকার; অনুদিত হ’তে চায় না ‘The murmurous haunt of flies on summer eves’-এর ধ্বনিগুঞ্জনাময় রূপভারাতুরতা। ইংরেজিতে যা সরল গভীর সেই ‘I have been half in love with easeful death’, ও ‘Thou wast not born for death, immortal bird’-এর সরল গভীরতা টিকে থাকে না অনুবাদে। কবিতাটি পুরোপুরি কবিতা, এর কোনো দর্শন নেই। কবিতাটি অনুবাদের চেষ্টা করছি।
নাইটিংগেলের প্রতি
জন কীটস
১
আমার হৃদয় ব্যথা করছে, আর নিদ্ৰাতুর এক বিবশতা পীড়ন করছে
আমার ইন্দ্ৰিয়গুলোকে, যেনো আমি পান করেছি হেমলক,
কিংবা সেবন করেছি কোনো অসহ্য আফিম
এক মুহুর্ত আগে, আর ভুলে গেছি সব :
এমন নয় যে আমি ঈর্ষা করছি তোমার সুখকে,
বরং তোমার সুখে আমি অতিশয় সুখী,-
আর তুমি, লঘু-ডানা অরণ্যের পরী,
সবুজ বিচের মধ্যে
কোনো সুরমুখরিত স্থলে, আর অসংখ্য ছায়ার তলে,
সহজিয়া পূর্ণ কণ্ঠে গেয়ে যাচ্ছে গ্ৰীষ্মের সঙ্গীত।
২
আহা, এক ঢোক মদের জন্যে! গভীর মাটির তলে
বহুকাল ঢাকা থেকে যেই মন্দ হয়েছে শীতল,
দেহে যার পুষ্প আর গেয়ো সবুজের স্বাদ,
নাচ, আর প্রোভোসীয় গান, আর রোদে পোড়ার উল্লাস!
আহা, উষ্ণ দক্ষিণভরা একটি পেয়ালার জন্যে,
পরিপূর্ণ খাটি, রক্তাভ হিপ্পোক্রেনে,
এবং রক্তবর্ণরাঙা মুখ;
এবং তোমার সঙ্গে মিলিয়ে যেতে বনের আধারে :
৩
মিলিয়ে যেতুম দূরে, গলতাম, এবং যেতম ভুলে
যা তুমি পত্রপল্লবের মধ্যে কখনো জানো নি,
ক্লান্তি, জ্বর, এবং যন্ত্রণা
এখানে, যেখানে মানুষেরা বসে শোনে একে অন্যের আর্তনাদ;
যেখানে পক্ষাঘাতগ্রস্তের মাথায় কাপে গুটিকয়, বিষণ্ণ অবশিষ্ট শাদা চুল,
যেখানে বিবৰ্ণ হয় যুবকেরা, আর প্রেতের মতোন কৃশ হয়ে মারা যায়:
যেখানে ভাবতে গেলেই ভরে উঠতে হয় দুঃখে।
এবং সীসাভারী চোখের হতাশায়,
যেখানে সৌন্দর্য রক্ষা করতে পারে না তার দু্যুতিময় চোখ,
অথবা আজকের প্ৰেম ক্ষয় হয় আগামীকাল আসার আগেই।
৪
দূরে! আরো দূরে! কেননা তোমার কাছে উড়ে যাবো। আমি,
তবে বাক্কাস ও তার চিতাদের রথে চ’ড়ে নয়,
যদিও অবোধ মগজ কিংকর্তব্যবিমূঢ় ও বিবশ :
এর মাঝেই তোমার সঙ্গে আমি! সুকোমল এই রাত,
এবং দৈবাৎ চন্দ্ররানী উপবিষ্ট তার সিংহাসনে,
তাকে ঘিরে আছে তার সব তারার পরীরা;
কিন্তু এখানে কোনো আলো নেই,
শুধু সেইটুকু ছাড়া যেটুকু আকাশ থেকে বাতাসে উড়াল দিয়ে
শ্যামল আধার। আর শ্যাওলার আকাবাকা পথ বেয়ে এখানে এসেছে।
৫
দেখতে পাচ্ছি না। আমি আমার পায়ের কাছে ফুটেছে কী ফুল,
বা কোন কোমল গন্ধ ঝুলে আছে শাখায় শাখায়,
তবে, সুবাসিত অন্ধকারে, অনুমান করি প্রত্যেক মধুকে
যা দিয়ে এই কুসুমের মাস ভরে দেয়
ঘাস, ঝোপ, আর বুনো ফলের গাছকে;
শুভ্ৰ হথর্ন, আর বন্যগোলাপ;
পাতার আড়ালে দ্রুত বিবৰ্ণ ভাইওলেটরাশি;
আর মধ্য-মের জ্যেষ্ঠ সন্তান,
শিশিরের মদে পূর্ণ আসন্ন কস্তুরিগোলাপ,
গ্ৰীষ্মের সন্ধ্যায় মৌমাছির গুঞ্জরণমুখর আবাস।
৬
অন্ধকারতলে আমি শুনি; কেননা অজস্রবার
জড়িয়ে পড়েছি আমি সহজ মৃত্যুর আধোপ্রেমে
প্রিয় নাম ধ’রে তাকে কতোবার ডেকেছি। কবিতার পংক্তিতে,
আমার নিঃশব্দ নিশ্বাস বাতাসে মিলিয়ে দেয়ার জন্যে;
যে-কোনো সময়ের থেকে এখন মৃত্যুকে মনে হচ্ছে বেশি বরণীয়,
ব্যথাহীন থেমে যাওয়া এই মধ্যরাতে,
যখন তোমার আত্মা ঢেলে দিচ্ছে তুমি
এরকম তুরীয় আবেগে!
তারপরও গেয়ে যাবে তুমি, এবং আমার কানে সাড়া জাগবে না–
তুমি গাইবে প্রার্থনাসঙ্গীত আমি মিশে যাবো। তখন মাটিতে।
৭
মৃত্যুর জন্যে তোমার জন্ম হয় নি, মৃত্যুহীন পাখি!
কোনো ক্ষুধার্তা প্রজন্ম ধ্বংস করতে পারবে না তোমাকে;
যে-সুর শুনছি। আমি ক্ষয়িষ্ণু এ-রাতে সে-সুরই
সুপ্রাচীন কালে শুনেছিলো সম্রাট ও ভাড়েরা :
হয়তো এ-একই গান ঢুকেছিলো
রুথের বিষণ্ণ হৃদয়ে, যখন, স্বদেশকাতর,
অশ্রুভারাতুর সে দাঁড়িয়েছিলো বিদেশি জমিতে;
একই গানে বারবার
মুগ্ধ হয়েছে ভয়ঙ্কর সমুদ্রের ফেনপুঞ্জের দিকে খোলা
যাদুবাতায়ণ, পরিত্যক্ত পরীদের দেশে।