মনে পড়ছে কীটসকে, আমার প্রিয় কবিদের একজন, যিনি দর্শন থেকে দূরে ছিলেন, ভয় পেতেন দর্শনকে। মনে পড়ে তার প্রতিবাদ :
Do not all charms fly
At the mere touch of cold philosophy?…
Philosophy will clip an Angel’s Wings.
তিনি ভয় পেতেন দর্শনের নিরাবেগ যৌক্তিক শীতলতাকে-চিন্তা নয়, তাঁর প্রিয় ছিলো ইন্দ্ৰিয়ভারাতুরতা; তবে তার কোনো কোনো উক্তি, যেমন Beauty is truth, truth beauty, নিয়ে নির্বোধ ছদ্মন্দার্শনিক মাতামাতি প্রচুর হয়েছে। উক্তিটি শাশ্বত সত্য প্রকাশ করে না; এটি আকর্ষণীয় এর অভাবিত সুন্দর অতিশয়োক্তির জন্যে, শাশ্বত সত্যের জন্যে নয়, যদিও অনেকে এটিকে শাশ্বত সত্যের প্রকাশ মনে ক’রে সুখ পান। উক্তিটিতে সত্য নয়, পাচ্ছি। তীব্র আবেগে উৎসারিত অবিস্মরণীয় অতিশয়োক্তি, তাই এটি কবিতা; দর্শন কখনোই এমন সুন্দর ও স্মরণীয় নয়। সৌন্দর্য বা সুন্দর সত্য হ’তে পারে, সত্যও হতে পারে সুন্দর; কিন্তু সৌন্দর্য ও সত্যের সমীকরণ কোনো চরম সত্য প্রকাশ করে না। সৌন্দর্যমাত্ৰই সত্য নয়, যেমন সত্যমাত্রই সুন্দর নয়। অনেক সুন্দর হতে পারে শোচনীয় মিথ্যে, যেমন এ-উক্তিটিও সত্য নয়, যদিও সুন্দর; আবার অজস্র সত্য হ’তে পারে বিবমিষাজাগানো অসুন্দর। যারা এর দার্শনিকতায় বিহবল হন, তারা কবিতা উপভোগ করেন না, কবিতায় চান কবিতার বদলে অন্য কিছু।
কীটসকে নেন নি আমাদের রোম্যান্টিকেরা, নিয়েছেন এক আধুনিক: হয়তো জীবনানন্দ হয়ে উঠতেন না জীবনানন্দ যদি না কীটস কবিতা লিখে যেতেন তার একশো বছর আগে। উনিশ শতকের শেষ দশক থেকেই তিনি প্রিয় বাঙলার কবিদের; তাকে দেখা হতো এক গ্রিক দেবতারূপে, যার যন্ত্রণা ছিলো অনন্ত মৃত্যু যাকে গ্রহণ করেছিলো তরুণ বয়সে। তাকে বাঙালি সাধারণত স্মরণ করেছে সেই কবিরূপে, যিনি উচ্চারণ করেছিলেন দুটি অমর উক্তি : Beauty is truth, truth beauty, এবং A thing of beauty is a joy for ever। এ-উক্তি দুটি এক সময় বারবার উদ্ধৃত করতেন সমালোচকেরা, এবং অনেকে যারা হয়তো তাঁর কবি তা কখনো পড়ে নি। উক্তি দুটির মধ্যে প্রথমটিই বেশি প্রিয় ছিলো বাঙালির, কে নন। তারা এতে শুধু সৌন্দর্য পেতো না, সাথে সত্য ও পেতো, যে-সত্যের জন্যে অসত্যমগ্ন বাঙালির কাতরতার শেষ নেই। অর্থাৎ কবিতাটুকু নয়, এর দর্শনঃ কু বেশি প্রিয় ছিলো তাদের; সৌন্দর্যে তাদের চরিত্রহীন হওয়ার ভয় ছিলো, তাই বেশি। ক’রে আঁকড়ে ধ’রে থাকতে চাইতো তারা সত্যকে। রবীন্দ্রনাথের সৌন্দর্যপি নাসার শেষ ছিলো না, তবে তারও ভয় ছিলো সৌন্দর্যকে, সত্য ছাড়া সৌন্দর্যকে তিনি বেশ? ভয় পেতেন, কে জানে কখন সৌন্দর্য আবার কোন রসাতলে ড়ুবোয়। সারাজী বনে পদ্যে ও গদ্যে সত্য ও সৌন্দর্য সম্পর্কে তিনি বহু কথা বলেছেন, কীটসের উন্ন রেকটি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিজের ভেবে ব্যবহার করেছেন বহু বার; কিন্তু যখনই তিনি উদ্ধৃত করেছেন উক্তিটি, তখনই ভুল উদ্ধৃত করেছেন, বা নিজের বিশ্বাস অনুসারে সাজিয়েছেন শব্দগুলোকে। কীটসের Beauty is truth, truth beauty’-কে রবীন্দ্রনাথ সব সময়ই উদ্ধৃত করেছেন Truth is beauty, beauty truth-রূপে। কেনো এমন করেছেন রবীন্দ্ৰনাথ? কীটসের কাছে সৌন্দর্য আগে রবীন্দ্রনাথের কাছে সত্য আগে কেনো? সৌন্দর্যকে প্রধান মনে করতে কি কোনো অপরাধবোধে ভুগতেন রবীন্দ্ৰনাথ?
আধুনিকদের আগে কীটসের সবচেয়ে বড়ো অনুরাগী ছিলেন, রবীন্দ্রনাথ নয়, মোহিতলাল মজুমদার-রক্ষণশীল কবি ও সমালোচক। তাঁর ‘পান্থ’ কবিতায় ‘সত্যেরে চাহি না। তবু সুন্দরের করি আরাধনা’ প’ড়ে বুঝি কতোটা আলোড়িত আর পীড়িত ছিলেন তিনি Beauty is truth. truth beauty দিয়ে। তিনি নিজের ছদ্মনামও রেখেছিলেন সত্যসুন্দর দাস, যখন আধুনিক সাহিত্যকে প্রবলভাবে রোখার তার সাধ হয়েছিলো। শুধু কবিতা নয়, কীটসের কাব্যতত্ত্বের তিনি ছিলেন অনুরাগী। তবে জীবনানন্দই একমাত্র বাঙালি কবি, যিনি কীটস থেকে নিয়েছিলেন সৃষ্টিশীলতার সাথে, লিখেছিলেন একরাশ ইন্দ্ৰিয়-ও প্রকৃতি- ও রূপ-ভারাতুর কবিতা। সব কবিতা নয়, জীবনানন্দ ঋণ নিয়েছিলেন দুটি কবিতা— ‘Ode to a Nightingale’ এবং ‘Ode to Autumn’ থেকে; তবে প্রথমটির প্রভাবই বেশি তাঁর ওপর। ‘মৃত্যুরে বন্ধুর মতো ডেকেছি তো-প্রিয়ার মতন’, ‘মৃত্যুরে ডেকেছি আমি প্রিয়ের অনেক নাম ধরে’ এসেছে কীটসের ‘I have been half in love with easeful death./Call’d him soft names in many a mused rhyme’ থেকে। ‘শরীরের অবসাদ-হৃদয়ের জুর ভুলে যেতে’, ‘অলস মাছির শব্দে ভরে থাকে সকালের বিষণ্ণ সময়’, ‘মাছির গানের মতো অনেক অলস শব্দ হয়/ সকালবেলার রৌদ্রে’, ‘অনেক মাটির তলে যেই মদ ঢাকা ছিল তুলে লব তার শীতলতা’ প্রভৃতি জন্মেছে কীটসের ‘The weariness. the fever, and the fret’. The murmurous haunt of flies on Summer eves’, ‘O, for a draught of Vintage that hath been/Cool’d a long age in the deep-delved earth’ প্রভৃতি থেকে। কীটসের ’emperor and clown’ থেকে জন্মেছে ‘আমাদের পাড়াগাঁর সেই সব ভাঁড়—/যুবরাজ রাজাদের হাড়ে আজ তাহাদের হাড়’, ‘Dance, and Proveneal song, and sunburnt mirth’ থেকে জন্মেছে ‘হাতে হাত ধরে ধরে গোল হয়ে ঘুরে ঘুরে ঘুরে/কার্তিকের মিঠা রোদে আমাদের মুখ যাবে পুড়ে’। জীবনানন্দের হাজার বছর ধ’রে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে হয়তো অনুপ্রাণিত হয়েছিলো কীটসের ‘Much have I travell’d in the realms of gold,/ And many goodly States and kingdoms Seen’ দিয়ে। কীটস আছেন বাঙলা কবিতার অন্তরেও।