প্রথম দিনের সূর্য
প্রশ্ন করেছিল
সত্তার নূতন আবির্ভাবে–
কে তুমি?
মেলে নি উত্তর।
বৎসর বৎসর চলে গেল।
দিবসের শেষ সূর্য
শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল
পশ্চিমসাগরতীরে
নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়–
কে তুমি?
পেল না উত্তর।।
কবিতাটির ‘প্রথম দিনের সূৰ্য’, ‘প্রশ্ন’, ‘সত্তার নূতন আবির্ভাব’, ‘কে তুমি’, ‘শেষ প্রশ্ন’, ‘মেলে নি উত্তর’, ‘পেল না উত্তর’ এগুলোকে বড়ো দার্শনিক জিজ্ঞাসা ব’লে মনে করেন ভাবুকেরা, এবং এগুলোর মধ্যে পরম উত্তরও লুকিয়ে আছে ভেবে তারা মুগ্ধ হন। কবিতাটি ভালো ক’রে পড়লে বুঝি এটি এক সুন্দর ধাঁধা:- ধাঁধার মতোই প্রথম বুঝতে একটু কষ্ট হয়, এবং ধাঁধার মতোই বুঝে ফেলার পর মনে হয় তুচ্ছ। ধাঁধার শুরু প্রথম দিনের সূর্য পদটিতেই। ‘প্রথম দিনের সূর্য পদটি শুরুতেই পাঠককে একটু চমকে দেয়, মনে হয় রবীন্দ্রনাথ সম্ভবত সূর্যের জন্মের পর সূর্যের প্রথম দিনের কথা বলছেন, যে-সূর্য জন্মেই নিজেকে প্রশ্ন করেছিলো, ‘কে তুমি?’ এর ভেতরে অবশ্য সূর্যের উৎপত্তি সম্পর্কে একটি ভুল ধারণা লুকিয়ে আছে: মনে হয় মহজগতের সব কিছু ছিলো আগে থেকেই, হঠাৎ দার্শনিক সূর্য জন্ম নিয়ে নিজের সম্পর্কে তুললো এক দার্শনিক প্রশ্ন। বৈজ্ঞানিকভাবে প্রথম দিনের সূর্য ব’লে কিছু নেই। রবীন্দ্রনাথের এক স্বভাব ছিলো পরিচিতের অপরিচিতীকরণ ও রহস্যীকরণ। ‘সত্তা’ শব্দটি সে-কাজই করছে: যদি তিনি স্পষ্ট ব’লে দিতেন এই সত্তা কোনো রহস্যমণ্ডিত বস্তু নয়, সত্তা বলতে তিনি নিজেকেই বোঝাচ্ছেন, ‘সত্তার শব্দের বদলে ব্যবহার করতেন যদি আমার সর্বনামটি, তাহলে ধাঁধা কেটে যেতো। কবিতাটির সারকথা হচ্ছে জন্মের মুহুর্তে সূর্য তাকে প্রশ্ন করেছিলো ‘কে তুমি’, আর মৃত্যুর আগেও সূর্য একই প্রশ্ন করছে তাকে, কিন্তু কোনো প্রশ্নেরই উত্তর পাওয়া যায় নি। তিনি জানেন না। তিনি কে। কবিতাটি দর্শন নয়, একটি ছোট্ট ধাঁধা, এমন প্রশ্ন মানুষ সহস্রবার করেছে। কবিতাটি দর্শন নয়, তাতে ক্ষতি নেই, কিন্তু দুঃখ হচ্ছে কবিতাও নয়। এটি এর থেকে অনেক ভালো কবিতা ‘আমাদের ছোট নদী’ বা তালগাছ’। তরুণ যৌবনে যেদিন তার প্রাণের ভেতরে পশেছিলো রবির কর, তখন উৎসারিত হয়েছিলো নিৰ্ব্বর, কবিতার ঝর্নধারা; কিন্তু মৃত্যুর আগের স্নান সূর্য জন্ম দিলো কবিতা নয়, ধাঁধা। দর্শন ও ছেলেমানুষের মধ্যে ব্যবধান লোপ পেয়ে যায়। কখনো কখনো, যার পরিচয় পাই শেষ সপ্তক-এর নবম কবিতাটির এ-স্তবকে :
এই অপরিণত অপ্রকাশিত আমি,
এ কার জন্যে, এ কিসের জন্যে।
যা নিয়ে এল। কত সূচনা, কত ব্যঞ্জনা,
বহু বেদনায় বাধা হতে চলল। যার ভাষা,
পৌঁছল না। যা বাণীতে,
তার ধ্বংস হবে অকস্মাৎ নিরর্থকতার অতলে,
সইবে না। সৃষ্টির এই ছেলেমানুষি।
এর কাতরতাটুকু দাগ কাটে, তাও খুব বেশি নয়; কিন্তু এর দর্শনটুকু সম্পূর্ণ ছেলেমানুষি। রবীন্দ্রনাথের দুর্মর সমস্যা তিনি বিশ্বাস করেন বিশ্বজগতের মহৎ উদ্দেশ্যে, যার কোনো উদ্দেশ্য নেই। রবীন্দ্রনাথ ‘নিরর্থকতা’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন কবিতাটিতে, যেটি আমি আগের দু-পরিচ্ছেদে বারবার ব্যবহার করেছি, বলেছি। সব কিছুই নিরর্থক, জীবনের কোনো মহৎ উদ্দেশ্য নেই। কিন্তু নিরর্থকতাকে মেনে নিয়েই দাঁড়াতে হবে নিরর্থকতার বিরুদ্ধে, ঝিনুকের ব্যাধিকেই রূপান্তরিত করতে হবে মুক্তোয়। ভাববাদী রবীন্দ্রনাথ ওই নিরর্থকতাকে মেনে নিতে পারেন নি, যেমন শিশু মেনে নিতে পারে না পিতামাতার মৃত্যু। ‘সইবে না সৃষ্টির এই ছেলেমানুষ’-এটা অসহায়ের শেষ হাহাকার-দর্শন নয়। আমরা তো তাকেই ব্যবহার করতে পারি। উদাহরণ হিশেবে:-রবীন্দ্রনাথ, যিনি মানবপ্রজাতির এক শ্রেষ্ঠরূপ, তিনি কেনো ম’রে যান, এবং তখনও পৃথিবীতে বেঁচে থাকে তুচ্ছ পতঙ্গ, পশু, বর্বর মানুষ? তখন কীভাবে সহ্য করা হয় সৃষ্টির ছেলেমানুষি? তার বিশ্বাস ছিলো মরুপথে যে-নদী ধারা হারায়, আর না ফুটতে ঝ’রে পড়ে যে-ফুল, তারাও হারায় না; কোনো মহৎ উদ্দেশ্যকে সফল ক’রে তোলে। বিশ্বাস বা দর্শন হিশেবে এটা পুরোপুরি ভুল বা হাস্যকর, যদিও তাঁর কবিতাটি অসাধারণ। দর্শন বাজে হয়েও কবিতা অসাধারণ হতে পারে, আর গুরুগম্ভীর দারুণ দর্শনসম্পন্ন হয়েও কবিতা হ’তে পারে শোচনীয়রূপে নিকৃষ্ট।
বাজে দৰ্শন কোনো দর্শন নয়, যদিও বাজে দার্শনিকতার অভাব নেই; কিন্তু খারাপ কবিতাও কবিতা-খারাপ কবিতা। দর্শনের লক্ষ্য ব্যাখ্যা করা, নানা দুরূহ সমস্যা সমাধান করা: কবিতার লক্ষ্য তা নয়। দর্শনের লক্ষ্য একটি, কবিতার লক্ষ্য অনেক: দর্শনের লক্ষ্য বিরহস্যীকরণ, আর কবিতা ক’রে থাকে রহস্যীকরণ। দার্শনিক নিজেকে প্রকাশ করার জন্যে দর্শন চর্চা করেন না: সাহিত্যে, কবিতায়, শিল্পীর আত্মপ্রকাশই বড়ো ব্যাপার। দর্শন কঠোরভাবে নৈর্ব্যক্তিক; কবি অধিকাংশ সময়ই ব্যক্তিক। কবিতা হচ্ছে শিল্পকলা, দর্শন তা নয়; কখনো কখনো কোনো কোনো দার্শনিক রচনা শিল্পকলা হয়ে উঠতে পারে, তবে দার্শনিক রচনার লক্ষ্য শিল্পকলা হওয়া নয়। কবিতার বড়ো কাজ আবেগ জাগানো, ইন্দ্ৰিয়গুলোকে স্বাদে গন্ধে ঘাণে ভ’রে তোলা, দর্শনের কাজ তা নয়; কবিতা যদি আমাদের কোনো ইন্দ্রিয়কে অভিভূত না করে, আবেগ না জাগায়, তাহলে তা কবিতাই হয়ে ওঠে না। শিল্পকলার, কবিতার, সাথে কামের রয়েছে একটি গভীর সম্পর্ক, কোনো কিছুই উ ৎকৃষ্ট শিল্পকলা হয়ে ওঠে না। যদি না তার ভেতরে বয়ে চলে কামের উজ্জ্বল ধারা। কবিরা নানা দর্শনে যুগে যুগে অনুরাগ বোধ করেছেন, প্রভাবিত হয়েছেন নানা দর্শন দিয়ে, কিন্তু কবিতায় তারা দর্শন প্রকাশ করেছেন খুবই কম। কবিতায় দর্শন থাকে ততোখানি যতোখানি থাকে চুম্বনে।