ডব্লিউ এইচ আডেন
এটা বিস্ময়কর যে দু-লিঙ্গেরই অসংখ্য তরুণতরুণীকে যখন প্রশ্ন করা হয় যে তারা জীবনে কী হ’তে চায়, তখন তারা আমি উকিল, সরাইখানাচালক, কৃষক হ’তে চাই’র মতো কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন উত্তর যেমন দেয় না, তেমনি দেয় না। ‘আমি অভিযাত্রী, গাড়িদৌড়বিদ, ধর্মপ্রচারক, যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি হ’তে চাই’র মতো রোম্যান্টিক উত্তরও। বিস্ময়করভাবে বিপুলসংখ্যক বলে ‘আমি লেখক হ’তে চাই, এবং লেখা বলতে তারা সৃষ্টিশীল লেখা বুঝিয়ে থাকে। এমনকি যদি তারা বলে ‘আমি সাংবাদিক হ’তে চাই, তখন তারা একথা বলে এ-মোহ থেকে যেনো এ-পেশায় থেকেও তারা সৃষ্টি করতে পারবে; যদি তাদের আসল বাসনা হয় টাকা করা, তবে তারা বেছে নেবে বিজ্ঞাপনের মতো অতিবৈতনিক উপসাহিত্যিক কাজ। এ-সম্ভাব্য লেখকদের বড়ো অংশেরই কোনো লক্ষণীয় সাহিত্যপ্রতিভা নেই। এটা বিস্ময়কর ব্যাপার নয়; কোনো পেশার জন্যেই লক্ষণীয় প্রতিভা খুব সুলভ নয়। যা বিস্ময়কর, তা হচ্ছে কোনো পেশার জন্যেই লক্ষণীয় কোনো প্রতিভা ছাড়াও এতো বেশি সংখ্যক তরুণতরুণী লেখাকেই সমাধান ব’লে মনে করে। কেউ কেউ হয়তো আশা করবেন যে তাদের হয়তো চিকিৎসা বা প্রকৌশল বা অন্য কিছুর প্রতিভা রয়েছে, তবে আসলে তা ঠিক নয়। আমাদের যুগে, যদি কোনো তরুণ প্রতিভাহীন হয় তাহলেই সে মনে করে যে তার রয়েছে লেখার প্রতিভা।
কবিদের জন্যে আমার দিবাস্বপ্নের মহাবিদ্যালয়ের পাঠক্রম হবে নিম্নরূপ :
১) ইংরেজি ছাড়াও কমপক্ষে একটি ধ্রুপদী ভাষা, গ্রিক বা হিব্রু, এবং দুটি আধুনিক ভাষা শিখতে হবে।
২) এসব ভাষায় লেখা কবিতার হাজার হাজার পংক্তি কণ্ঠস্থ করতে হবে।
৩) পাঠাগারে সাহিত্য সমালোচনামূলক কোনো বই থাকবে না, এবং ছাত্রদের একমাত্র সমালোচনামূলক অনুশীলনী হবে প্যারোডি লেখা।
৪) সব ছাত্রকে ছন্দ, অলঙ্কার ও তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের পাঠ নিতে হবে, এবং প্রতিটি ছাত্রকে গণিত, প্রাকৃতিক ইতিহাস, ভূতত্ত্ব, খনিবিদ্যা, প্রত্নতত্ত্ব, পুরাণ, প্রার্থনাবিদ্যা, পাকপ্ৰণালি প্রভৃতি পাঠের মধ্য থেকে তিনটি পাঠ নিতে হবে।
৫) প্রতিটি ছাত্রকে একটি গৃহপালিত পশু পালতে হবে এবং একটি বাগান রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। কবিকে শুধু কবি হিশেবে নিজেকে শিক্ষিত করলেই চলবে না; সে কীভাবে জীবিকা অর্জন করবে সে-কথাও তাকে ভাবতে হবে। উৎকৃষ্টতম হচ্ছে সে এমন একটি পেশা নেবে যাতে তাকে কোনোভাবেই শব্দ ব্যবহার করতে না হয়।
ডাইল্যান টমাস
শুরুতে আমি কবিতা লিখতে চেয়েছি, কেননা আমি শব্দের প্রেমে পড়েছিলাম। আমার জানা প্রথম কবিতা হচ্ছে ছেলেভোলানো ছড়া, এবং ওগুলো আমি নিজে পড়তে শেখার আগে আমি শুধু সেগুলোর শব্দগুলোকে ভালোবেসেছি, শুধু শব্দগুলোকে। সেগুলোর অর্থ কী, সেগুলো কিসের প্রতীক, তা ছিলো গৌণ ব্যাপার।…আমি যতোই পড়তে থাকি, তার সবটা অবশ্য পদ্য ছিলো না, শব্দের প্রকৃত জীবনের প্রতি আমার ভালোবাসা বাড়তে থাকে, এক সময় আমি বুঝতে পারি। আমাকে সব সময় থাকতে হবে তাদের নিয়ে ও তাদের মধ্যে। আমি জানতাম আমি হবো শব্দের লেখক, আর কিছু নয়। আমার কাছে প্রথম ব্যাপার ছিলো তাদের ধ্বনি ও অর্থ অনুভব করা ও জানা; ওই শব্দ দিয়ে আমি কী করতে যাচ্ছি, কী কাজে তাদের আমি লাগাতে যাচ্ছি, তাদের দিয়ে আমি কী বলতে যাচ্ছি, তা ছিলো পরের ব্যাপার।
একদিন যারা কবি হবে, তারা যে-কবিতার স্বাদ প্রথম পায়, তা চিরজীবী দাগ কাটে তাদের মনে; যেমন ডাইল্যান টমাসের মনে ও কবিতায় সব সময়ই ছিলো ছেলেভোলানো ছড়ার দাগ। পড়তে শেখার পর তারা পাঠ্যপুস্তকে প্রথম পরিচিত হয় এমন কবিতার সাথে, যার শিরোনামের নিচে বা ওপরে থাকে কবির নাম। পাঠ্যপুস্তক তাদের কবিতার সাথে ঘনিষ্ঠ ক’রে তোলে, সৃষ্টি করতে থাকে বুকের ভেতরে নতুন ধরনের আবেগ, স্বপ্ন দেখাতে থাকে, যে-স্বপ্ন দেখতে হয় জেগে জেগে। কিন্তু পাঠ্যপুস্তক রক্ষণশীল, তাতে চিরকালের ও সমকালের শ্রেষ্ঠ কবিতার উপস্থিতি অত্যন্ত শোচনীয়, খারাপ ও অকবিদের কবিতাই থাকে বেশি; এবং উচ্চতর শ্রেণীতে যাওয়ার পরও সমকালের শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলোকে খুঁজে পাওয়া যায় না পাঠ্যপুস্তকে। আমাদের অঞ্চলে পাঠ্যপুস্তক ধ’রে রাখে সরকারি রুচি, ও ওই সময়ের কিছু নিকৃষ্ট মানুষের কাব্যবোধ, যারা পদ্য বুঝলেও কখনো কবিতা দ্বারা আলোড়িত হয় না। এলিঅট যে বলেছিলেন উৎকৃষ্ট কবিতা বোঝার অনেক আগেই সংক্রামিত হয়, এটা সত্য নয় তাদের বেলা; তাই পাঠ্যপুস্তক সম্ভাব্য কবিদের উপকারে আসে না। কোনো বিশেষ সময়ে সে-ই সম্ভাব্য কবি, যে তার কবিতা লেখা শুরুর কালের আধিপত্যশীল কবিতাকে অস্বীকার করে, খোজে। নতুন কবিতা। শুরুতেই কেউ নতুন সিঁড়িতে পা রাখতে পারে না, প্রচলিত সিঁড়িতে পা রেখেই পা বাড়াতে হয়। অন্য ও নিজস্ব সিড়ির দিকে। কবিকে তৈরি করে নিতে হয় নিজের কাব্যতত্ত্ব। দশকে দশকে জন্ম নেয় না প্রধান কবি, মহৎ কবি জন্ম নেয়া অনেকটা শতাব্দীর ঘটনা। প্রধান কবি জন্ম নেয়া শুধু প্ৰতিভার নয়, কালেরও আনুকূল্যের ব্যাপার; কবিতার একটি আধিপত্যশীল ধারা যখন নিস্ফল হয়ে আসে, তখনই আসে নতুন ধারা ও প্রধান কবি বা কবিদের কাল।
কবিতার বয়স কয়েক হাজার বছর, তবে কবিতা সম্পর্কে আমরা আজো নিশ্চিত নই, হয়তো কখনোই নিশ্চিত হবো না। কবিতা সম্পর্কে নানা বাজে কথা চলে এখানে, চলে পৃথিবী জুড়েই, এগুলোর একটি হচ্ছে দর্শন; বলা হয় কবির থাকতে হবে নিজস্ব দর্শন, কবিতায় থাকতে হবে দর্শন। কবিকে কি হ’তে হবে দার্শনিক? দর্শনের কাছে কি আমরা দাবি করবো যে দর্শনে থাকতে হবে কবিতা, দার্শনিককে হ’তে হবে কবি? কবিতায় নানা চিন্তা থাকবে, আছে। শুরু থেকেই, চিন্তা কবিতায় কবিতা হয়ে আসবে, যেমন এলিঅট অতিশয়োক্তি করেছেন যে চিন্তা কবিতায় গোলাপের সুগন্ধের মতো আসবে; কিন্তু কবিতায় দর্শন থাকবে, এটা দর্শন ও কবিতা সম্পর্কে খুবই ভুল ধারণা। যারা এটায় বিশ্বাস করেন, তারা ভেতরে ভেতরে কবিতার প্রতিপক্ষ তারা কবিতা উপভোগ করেন না, কবিতাকে কবিতার জন্যে মূল্যবান মনে করেন না, এমনকি সন্দেহ পোষণ করেন। কবিতা সম্পর্কে কবিতার সৌন্দর্য তাদের তৃপ্তি দেয় না। তাই তারা মূল্যবান কিছু চান, তাদের কাছে মূল্যবান হচ্ছে ‘দর্শন’। কবিতা ও দর্শনের সম্পর্ক নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেছেন জর্জ বোয়াস; তিনি খোলাখুলি বলেছেন কবিতায় যে-চিন্তা বা দর্শন মেলে। অধিকাংশ সময়ই তা অত্যন্ত পচা ও ভুল; ষোলো বছরের বেশি বয়স্ক কেউ কবিতায় কী বলা হচ্ছে তার জন্যে কবিতা পড়ে না। এলি আট বলেছেন দান্তে বা শেক্সপিয়র কেউই প্রকৃত অর্থে যাকে চিন্তা বলে, তেমন চিন্তা করেন নি। যেসব কবিতায় গুরুত্বপূর্ণ দর্শন রয়েছে, রবীন্দ্রনাথের কবিতাই ধরা যাক, সেগুলো খুঁজলে কী পাই আমরা? সেগুলোতে পাই জীবন, মৃত্যু, জীবনের তাৎপৰ্য, সৃষ্টির উদ্দেশ্য প্রভৃতি সম্পর্কে কতকগুলো খুবই তুচ্ছ পুরোনো কথা। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় দর্শন খুঁজলে কী পাই? তার ভালো কবিতাগুলোতে দর্শন পাই না, সেগুলো স্বাভাবিকভাবেই এতো ভালো যে দর্শনের কোনো দরকার পড়ে না সেগুলোর, তার খারাপ কবিতাগুলোতেই পাই তথাকথিত দর্শন। কী পাই সেগুলোতে? পাই কতকগুলো পুরোনো প্রশ্ন আর পুরোনো উত্তর বা নিরুত্তরতা। রবীন্দ্রনাথেরই একটি কবিতা একটু বিচার করতে পারি, যেটি তাঁর ভাবুক ভক্তদের খুবই ভাবিত করে, গভীর দর্শন কবিতাটিতে লুকিয়ে আছে ভেবে তারা কবিতাটির মুখোমুখি ভয়ে ভয়ে দাঁড়ান। কবিতাটির নাম প্রথম দিনের সূর্য (শেষ লেখা), লিখেছিলেন মৃত্যুর তিন দিন আগে :