এজরা পাউন্ড
তাই হচ্ছে ‘চিত্রকল্প’ যা বিশেষ মুহুর্তে তুরিত উপস্থিত করে এক মনন ও আবেগগত গূঢ়েষা। আমি ‘গূঢ়েষ’ শব্দটি ব্যবহার করছি হার্ট প্রমুখ নতুনতর মনোবিজ্ঞানীদের পারিভাষিক অর্থে, যদিও প্রয়োগের সময় আমরা পুরোপুরি একমত নাও হতে পারি।
এমন ‘গূঢ়েষা’র উপস্থাপন তাৎক্ষণিকভাবে সৃষ্টি করে এক আকস্মিক মুক্তির অভিভাব; সময় সীমা ও স্থান সীমার সেই অভিভাব; সেই আকস্মিক বিকাশের অভিভাব, যার অভিজ্ঞতা আমরা লাভ করি শ্রেষ্ঠতম শিল্পকলারাশির মুখোমুখি।
বহুখণ্ড রচনাবলির থেকে সারাজীবনে একটি চিত্রকল্প উপহার দেয়াও উত্তম।…
যারা নিজেরা কোনো গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ লেখে নি তাদের সমালোচনায় কান দিয়ে না। গ্রিক কবি ও নাট্যকারীদের লেখা, ও ছন্দ বিশ্লেষের জন্যে গ্রিসীয়-রোমীয় ব্যাকরণবিদদের বানানো তত্ত্বের মধ্যে যে গড়ামিল রয়েছে তার কথা ভেবে দেখো।
এমন কোনো অনাবশ্যক শব্দ, বিশেষণ ব্যবহার কোরো না যা কোনো কিছু প্রকাশ করে না। ‘শান্তির অস্পষ্ট এলাকা’র মতো উক্তি ব্যবহার কোরো না। এটা চিত্ৰকল্পকে ভোতা ক’রে ফেলে। এটা মূর্ত বস্তুর সাথে মিশিয়ে দেয় বিমূর্তকে। লেখক যখন বুঝতে পারে না যে স্বাভাবিক বস্তুই সব সময় উপযুক্ত প্রতীক, তখনই হয় এর উৎপত্তি।
বিমূর্তকরণ থেকে বিরত থাকো। উৎকৃষ্ট গদ্যে যা বলা হয়ে গেছে নিম্নমানের পদ্যে তা আবার বোলো না। এটা কখনো মনে কোরো না যে উৎকৃষ্ট গদ্যের অবর্ণনীয় শিল্পকলাকে এড়িয়ে তোমার রচনাকে পংক্তির পরিমাপে কেটে তুমি প্রতারণা করতে পারবে কোনো বুদ্ধিমান ব্যক্তিকে।
আজ বিশেষজ্ঞ যাতে ক্লান্তি বোধ করে আগামীকাল জনগণ তাতে ক্লান্তি বোধ করবে। কখনো মনে কোরো না যে কাব্যকলা কোনোভাবেই সঙ্গীতকলার থেকে সহজ, বা ভেবো না যে একজন পিয়ানোশিক্ষক সাধারণত যতোটা সময় সঙ্গীতকলা চর্চায় ব্যয় করে অন্তত ততোটা প্ৰয়াস কাব্যকলা চর্চায় ব্যয় করার আগে তুমি কোনো বিশেষজ্ঞকে খুশি করতে পারবে। যতোটা পারো মহৎ শিল্পীদের দ্বারা প্রভাবিত হও, তবে তোমার ঋণ সরাসরি স্বীকার, বা গোপন করার মতো শোভনতা থাকা দরকার।
‘প্রভাবিত’ হওয়া বলতে তোমার প্রিয় এক বা একাধিক কবির রচনা থেকে বিশেষ ধরনের অলঙ্কারধর্মী শব্দাবলি ঝেঁটিয়ে নিয়ে আসাকে বোঝে না।
কোনো অলঙ্কারই ব্যবহার কোরো না বা ভালো অলঙ্কার ব্যবহার কোরো।
টি এস এলিঅট
ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারের, একমাত্র রূপ যদি হয় আমাদের অব্যবহিত পূর্ব প্রজন্মের সাফল্যের কৌশলগুলো অন্ধ বা ভীরুভাবে অনুসরণ করা, তাহলে ‘ঐতিহ্য’কে সুস্পষ্টভাবে নিরুৎসাহিত করতে হবে। আমরা এমন অনেক সরল স্রোতকে বালুকায় হারিয়ে যেতে দেখেছি; আর অভিনবত্ব পুনরাবৃত্তির থেকে উৎকৃষ্ট। ঐতিহ্য আরো ব্যাপক তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার। এটা উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া যায় না, এবং আপনি যদি এটা চান তবে আপনাকে তা অর্জন করতে হবে কঠোর শ্রমে। প্রথমত এর রয়েছে ইতিহাসবোধ, যা আমরা অপরিহার্য ব’লে গণ্য করতে পারি। তার জন্যে যিনি পচিশ বছর বয়স্ক হওয়ার পরও কবিতা লিখতে চান: এবং ইতিহাসবোধের অন্তর্ভুক্ত শুধু অতীতের অতীতত্ত্ব নয়, বরং তার উপস্থিতির বোধ; ইতিহাসবোধ কাউকে শুধু তার নিজের প্রজন্মকে অস্থিতে ধারণ ক’রে লিখতে বাধ্য করে না, বরং তার মধ্যে সৃষ্টি করে এমন অনুভূতি যে হোমার থেকে শুরু ক’রে সমগ্র ইউরোপের সাহিত্য এবং তার মধ্যে তার নিজের দেশের সাহিত্যের যেনো রয়েছে এক যুগপৎ অস্তিত্ব এবং তা সৃষ্টি করে এক যুগপৎ শৃঙ্খলা। এ-ইতিহাসবোধ, যা হচ্ছে শাশ্বতের বোধ ও সমকালের বোধ, এবং একইসাথে শাশ্বত ও সমকালের বোধ, লেখককে করে। এতিহ্যমণ্ডিত। একই সাথে এটাই লেখককে তীব্রভাবে সচেতন করে কালপ্রবাহে তার নিজের স্থান সম্পর্কে, তার সমকালীনতু সম্পর্কে।
কোনো কবির, কোনো শিল্পের শিল্পীরই, একলা সম্পূর্ণ অর্থ নেই। তার তাৎপৰ্য, তার মূল্যায়ন হচ্ছে মৃত কবি ও শিল্পীদের সাথে তার সম্পর্কের মূল্যায়ন। আপনি তাকে একলা মূল্যায়ন করতে পারেন না; প্রতিতুলনা ও তুলনার জন্যে তাকে মৃতদের মধ্যে বসাতে হবে। আমি একে শুধু এতিহাসিক সমালোচনা ব’লে মনে করি না, একে মনে করি নান্দনিক সমালোচনার একটি সূত্ৰ ব’লে।
যা ঘটে তা হচ্ছে শিল্পীর আপনি সত্তা ধারাবাহিকভাবে বিসর্জন, কেননা তিনি বিশেষ মুহুর্তে এমন জিনিশের প্রতি সমৰ্পিত যা অধিকতর মূল্যবান। শিল্পীর ক্রমাগ্রসারণ হচ্ছে ধারাবাহিক আত্মোৎসৰ্গীকরণ, ব্যক্তিসত্তার ধারাবাহিক নির্বাপণ।
এ-নৈর্ব্যক্তিকীকরণ প্রক্রিয়া ও তার সাথে ঐতিহ্যের সম্পর্কের ব্যাপারটি একটু ব্যাখ্যা করা দরকার। এ-নৈর্ব্যক্তিকীকরণ প্রক্রিয়ায়ই বলা যেতে পারে, শিল্পকলা বিজ্ঞানের অবস্থার দিকে এগিয়ে চলে। আমি তাই, ইঙ্গিত পূর্ণ সাদৃশ্যরূপে, আমন্ত্রণ জানাই সে-ক্রিয়া বিবেচনা করার জন্যে যা ঘটে যখন এক টুকরো প্ল্যাটিনাম ঢুকিয়ে দেয়া হয় অম্লজান ও সালফার ডাইঅক্সাইডপূর্ণ আধারে।… সাদৃশ্যটি ছিলো বিক্রিয়াসংগঠকের। পূর্বোল্লিখিত গ্যাস দুটি যখন মেশানো হয়। প্ল্যাটিনাম সূত্রের উপস্থিতিতে, তখন সেটি উৎপাদন করে সালফিউরাস অ্যাসিড। শুধু প্ল্যাটিনামের উপস্থিতিতেই ঘটে এ-মিশ্রণী; তবে এ-নবগঠিত অ্যাসিডে প্ল্যাটিনামের কোনো চিহ্নও থাকে না, এবং প্ল্যাটিনাম টুকরোটি থাকে অস্পৃষ্ট : এটা থাকে নিস্ক্রিয়, নিরপেক্ষ, এবং অপরিবর্তিত। কবির মন প্ল্যাটিনামের টুকরো। এটা লোকটির নিজের অভিজ্ঞতার ওপর আংশিক বা একচেটি ক্রিয়া করতে পারে; তবে, শিল্পী যতো বিশুদ্ধ হবেন ততোই সম্পূর্ণভাবে তার ভেতর বিচ্ছিন্নতা ঘটবে সে-লোকটির যে ফলভোগ করে আর সে-মনের যে সৃষ্টি করে; ততোই বিশুদ্ধভাবে মন। পরিপাক ও পরিবর্তিত রূপ দেবে সংরাগকে, যা তার উপাদান।
তাঁর ব্যক্তিগত আবেগ, যে-আবেগ জেগেছে তার জীবনের বিশেষ বিশেষ ঘটনার ফলে, তার জন্যে কোনোভাবেই কবি উল্লেখযোগ্য বা আকর্ষণীয় নন। তার বিশেষ আবেগ হ’তে পারে সরল, বা আকাড়া, বা একঘেয়ে। তাঁর কবিতার আবেগ হবে অত্যন্ত জটিল বস্তু, তবে তাতে থাকবে না সে-সব মানুষের আবেগের জটিলতা যাদের জীবনে রয়েছে খুবই জটিল বা অস্বাভাবিক আবেগ। আসলে কবিতায় বান্তিকগ্ৰস্ততার এক ভ্ৰান্তি হচ্ছে যে তা নতুন মানবিক আবেগ প্রকাশের খোজে থাকে; এবং ভুল জায়গায় অভিনবত্ব খোজ ক’রে আবিষ্কার করে বিকৃতিকে। নতুন আবেগ খোজা কবির কাজ নয়, তার কােজ সাধারণ আবেগগুলো ব্যবহার করা, এবং তাকে কবিতায় পরিণত করতে গিয়ে এমন অনুভূতি প্রকাশ করতে হবে যা আসলেই আবেগ নয়। যে-আবেগের অভিজ্ঞতা তার নেই, আর যে-আবেগ তার পরিচিত দু-ই তার কাজে লাগে। ফলত, আমাদের অবশ্যই বিশ্বাস করতে হবে যে ‘আবেগের প্রশান্ত পুনশ্চয়ন’ একটি অযথাযথ সূত্র।
শিল্পকলার আবেগ নৈর্ব্যক্তিক।
কবিতায়, সাধারণ অর্থে, ‘অর্থ’-এর প্রধান ভূমিকা হচ্ছে (আবারও আমি বিশেষ ধরনের কবিতার কথাই বলছি, সব ধরনের নয়) পাঠকের একটি অভ্যাসকে তৃপ্ত করা, তার মনকে বিনোদিত ও শান্ত রাখা, যখন কবিতা তার ভেতরে কাজ ক’রে যায় : অনেকটা তেমনভাবে যেমন কাল্পনিক চোর গৃহ-কুকুরের জন্যে রাখে এক টুকরো চমৎকার মাংস।