কীভাবে সৃষ্টি হয় কবিতা? কী থাকে কবিতায়? কবিতায় কী থাকে, তা খুঁজে খুঁজে বের করা অসম্ভব নয়, মানবিক-অমানবিক সব কিছুই তো থাকে কবিতায়, থাকে ভাষার ইন্দ্রজাল, অপরিসীম কল্পনা; কিন্তু কীভাবে সৃষ্টি হয় কবিতা, তা নিশ্চিতভাবে কেউ বলতে পারি না। কোনো শিল্পকলা সম্পর্কেই ভবিষ্যদ্বাণী সম্ভব নয়; আগে থেকেই একটি মহৎ বা চমৎকার কবিতা লেখার ছক কেউ তৈরি ক’রে দিতে পারে না। কেউ আগে থেকে ব’লে দিতে পারে না। কী বিষয় কীভাবে লিখলে লেখাটি হয়ে উঠবে অসাধারণ কবিতা। কবিতার কাঠামো, তার ছন্দ ও মিল বা অমিল সম্পর্কে কিছুটা শিক্ষা দেয়া সম্ভব, কিন্তু প্রতিটি প্রকৃত কবিতাই অভূতপূর্ব, রচিত হওয়ার আগে তাঁর রচয়িতাও সেটি সম্পর্কে জোর দিয়ে কিছু বলতে পারেন না। কবিতা লেখা হয়ে যাওয়ার পরই শুধু উপলব্ধি বা অনুভব বা বিচার ক’রে দেখা সম্ভব সেটি কবিতা হয়েছে কিনা, বা হয়েছে কতোটা অসাধারণ। বিজ্ঞানের একটি মূলকথা ভবিষ্যদ্বাণী, কোনো সূত্র যদি নির্ভুল হয়, তবে তা সম্ভাব্য ব্যাপারগুলো সম্পর্কে করতে পারে নির্ভুল ভবিষ্যদ্বাণী; শিল্পকলায় এটা অসম্ভব। প্রতিটি শিল্পসৃষ্টিই অনন্য, সৃষ্টি হওয়ার আগে সেটি সম্পর্কে কেউ ধারণা করতে পারে না। বিজ্ঞানের আবিষ্কারগুলো অবধারিত; পূর্ব আবিষ্কারগুলো বিজ্ঞানীদের অবধারিতভাবে পৌঁছে দেয়। পরবর্তী আবিষ্কারগুলোতে। আইনস্টাইনের আবিষ্কারের জন্যে একান্তভাবে আইনস্টাইন জরুরি নন; তিনি ওই তত্ত্ব আবিষ্কার না করলে অবধারিতভাবে অন্য কেউ তা আবিষ্কার করতেন, হয়তো কিছুটা সময় লাগতো; কিন্তু শেক্সপিয়র হ্যামলেট বা রবীন্দ্রনাথ ‘নিরুদ্দেশ যাত্ৰা’ না লিখলে তা চিরকাল অরচিত থেকে যেতো। কোনো শিল্পসৃষ্টিই অবধারিত নয়, প্রতিটি শিল্পসৃষ্টিই ব্যক্তিগত প্ৰতিভার প্রকাশ। ‘নিরুদেশ যাত্ৰা’ কোনো ইঙ্গিত করে না। ভবিষ্যতে অবসরের গান’ রচিত হবে; কিন্তু নিউটনের সূত্রগুলো ইঙ্গিত করে যে একসময় অবধারিতভাবে প্রস্তাবিত হবে আইস্টাইনীয় আপেক্ষিকতত্ত্ব। শিল্পসৃষ্টি সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী সম্ভব নয়, কিন্তু তার চরিত্র ও সৃষ্টিপ্রক্রিয়া অনেকটা ব্যাখ্যা করা সম্ভব। শিল্পভ্রষ্টাদের মধ্যে কবিদেরই রয়েছে প্রবল সমালোচক সত্তা; অন্যরা সাধারণত চুপ থাকেন শিল্পকলায় নিজেদের শাখা সম্পর্কে, কিন্তু কবিরা চিরকালই ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন কবিতা, উদঘাটন করতে চেয়েছেন কবিতার উৎসারণ প্রক্রিয়া। তাই কবিরাই হয়ে উঠেছেন শ্রেষ্ঠ মৌলিক সমালোচক। আধুনিক কালের পশ্চিম ও পুবের প্রধান কবিরাই কবিতা ও সাহিত্যের প্রধান সমালোচক; তাঁরা মূল্যায়ন করেছেন কবিতা, ব্যাখ্যা করেছেন শিল্পকলা, বিশেষ করে, কবিতার সৃষ্টিপ্রক্রিয়া।
কবি কি কবিতার সৃষ্টিপ্রক্রিয়া ব্যাখ্যার শ্রেষ্ঠ পুরুষ? কবিরা তাই দাবি করেন, যেমন দাবি করেছেন অনেকের মতো এজরা পাউন্ড। পাউন্ড বলেছেন :
গাড়ি সম্পর্কে কিছু জানতে চাইলে কি আপনি যাবেন তাঁর কাছে, যিনি গাড়ি তৈরি করেছেনএবং চালিয়েছেন, নাকি যাবেন তার কাছে, যিনি শুধু শুনেছেন গাড়ির কথা?
আর দুজন মানুষ যারা গাড়ি বানিয়েছেন, তাদের মধ্যে আপনি কার কাছে যাবেন, যিনি ভালো গাড়ি বানিয়েছেন তার কাছে, নাকি তার কাছে যিনি বানিয়েছেন জোড়াতালি দেয়া একটা বস্তু?
প্রশ্নের ভেতরেই রয়ে গেছে উত্তরটি যে আমরা ভালো গাড়ি প্রস্তুতকারকের কাছেই যাবো, যেমন যাবো ভালো কবিতা লেখকের কাছে। কিন্তু অসুবিধা রয়েছে গাড়ি ও কবিতাকে এক ক’রে দেখার; তার মধ্যে প্রধানটি হচ্ছে গাড়ি উৎপাদিত হয় প্রস্তুতকারকের সুনিশ্চিত পূর্বপরিকল্পনা অনুসারে, তাঁর সুনিশ্চিত পরিকল্পনার বাস্তররূপ তার যানটি। প্রস্তুতকারককে আগে থেকেই জানতে হয় তিনি কী করতে যাচ্ছেন; কোন প্রস্তুতকারকই একটু একটু ক’রে তৈরি ও সংশোধন ও তৈরি ক’রে শেষে দেখেন না। তিনি কী তৈরি করলেন। তৈরি করার পর তিনি দেখেন না তার উৎপাদিত বস্তুটি গাড়ি হলো কিনা? কবিতা গাড়ির মতো উৎপাদিত হয় না, রচিত হওয়ার পর বিবেচিত হয় তা কবিতা হয়েছে কি হয় নি। তাই গাড়ি হচ্ছে উ ৎপাদন, কবিতা হচ্ছে সৃষ্টি। ভালো গাড়ি-উৎপাদক গাড়ি উৎপাদিত হওয়ার আগেই চমৎকারভাবে বুঝিয়ে দিতে পারেন তাঁর গাড়ির ক্রিয়াকলাপ, উপযোগিতা, ও অন্যান্য সব কিছু; কিন্তু কবিতা সৃষ্টির সমস্যা হচ্ছে ভালো বা মহৎ কবিও তাঁর কবিতার সব কিছু বুঝিয়ে দিতে পারেন না, নিজেও বোঝেন না; কেননা কবিতার মধ্যে রহস্যের ভাগ অনেক বেশি। গাড়িতে কোনো রহস্য নেই, কবিতা ভ’রেই রয়েছে রহস্য। অনেক ভালো কবি যেভাবে কবিতা লিখতে চান বা অন্যদের লেখার পরামর্শ দেন, নিজেরা সেভাবে লেখেন না, বা পারেন না; তাই ভালো কবিও সব সময় নির্ভরযোগ্য নন। তবে কবির, ভালো বা প্রধান কবির, কবিতাবিষয়ক কথা মূল্যবান; তা জানিয়ে দেয় তাদের কবিতার সৃষ্টিপ্রক্রিয়া, অন্যদের বা সব কবিতার নয়, তাঁদের কবিতার।
কোনো কবি যখন ব্যাখ্যা করেন। কবিতার সৃষ্টিপ্রক্রিয়া, তখন কবিতা বলতে তিনি কোনো বিমূর্ত শাশ্বত বিশ্বজনীন ব্যাপার বোঝেন না, বোঝেন নিজের কবিতা। তিনি বলেন নিজের কবিতা সৃষ্টির প্রক্রিয়ার কথা, যেভাবে তিনি নিজে কবিতা সৃষ্টি করেন বা করতে চান, তা বোঝার চেষ্টা করেন তিনি ওই ব্যাখ্যায়, তবে সব সময় বুঝে ওঠেন না। ওঅর্ডসওঅৰ্থ বলেন ও অর্ডসওঅৰ্থ নিজে কীভাবে কবিতা লেখেন বা লেখার কথা ভাবেন, রবীন্দ্রনাথও বলেন নিজেরই কথা; কীভাবে অন্যরা লেখেন বা ভবিষ্যৎ কবিরা লিখবেন, সেকথা বলেন না, যদিও আমরা কখনো কখনো মনে করি কবিতা লিখতে হবে ওই মহৎদের পরামর্শ অনুসারে। শিল্পকলা এমন এলাকা যেখানে, শুধু নিজের অন্তরের পরামর্শ ছাড়া, কারো পরামর্শই গ্রহণযোগ্য নয়; মহৎ কবির পরামর্শও নিরর্থক গৌণ কবির কাছে। কবিতায় রবীন্দ্রনাথ শুধু পরামর্শ দিতে পারেন রবীন্দ্রনাথকে, এলিঅট পারেন। এলি আটকে; আর কাউকে নয়। শিল্পকলায় অন্যের পরামর্শ গ্রহণ হচ্ছে আত্মহত্যা। তবে অন্যের পরামর্শ গ্রহণযোগ্য না হ’লেও শোনার মতো, অন্যের অভিজ্ঞতা সাহায্য করতে পারে নিজের শিল্পকলার পথ তৈরিতে। কবিরা নিজেদের কবিতা সৃষ্টির প্রক্রিয়া বলে যা রটনা করেন পদ্যে বা গদ্যে, তা তারা যে সব সময় মানেন বা মেনে চলতে পারেন, তা নয়; কারণ সৃষ্টি আর সৃষ্টিপ্রক্রিয়া ব্যাখ্যা ভিন্ন ব্যাপার। শিল্পসৃষ্টিতে অসচেতন প্রক্রিয়ার ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কবি জানেন না কখন কোন শব্দ বা চিত্ৰকল্প এসে জুড়ে বসবে তার পংক্তি বা স্তবকে।