বাঙলার লেখকদের মধ্যে চেতনায় সবচেয়ে আধুনিক সুধীন্দ্রনাথ দত্ত; সভ্যতা ও মানুষের বিবর্তন বুঝেছিলেন তিনি ভালোভাবে, এবং ঈশ্বর নামের অলীক ব্যাপারটি ছিলো তার কাছে স্পষ্ট। তিরিশের আধুনিক কবিরা অবিশ্বাসী ছিলেন; তবে তারা এড়িয়ে গেছেন ব্যাপারটি, শুধু সুধীন্দ্রনাথ এড়িয়ে যান নি। বারবার ঈশ্বর এসেছে তাঁর কবিতায়, তাঁর ঈশ্বর ঠিক হিন্দু নয়, ঈশ্বর বলতে তিনি মুসার ঈশ্বরকেই বুঝেছেন বেশি। তিনি ঈশ্বরকে প্রত্যাখ্যান করেছেন, পরিহাস করেছেন, ওই অলীক কল্পনার মূলও দেখিয়েছেন। ‘উড়ায়ে মরুর বায়ে ছিন্ন বেদ-বেদান্তের পাতা’, সুধীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘বলেছি পিশাচহস্তে নিহত বিধাতা।’ ইউরোপে উনিশ শতকের শুরু থেকেই ঈশ্বরের মৃত্যুর সংবাদ রটতে থাকে, যা চরম সংবাদে পরিণত হয় নিটশের ‘ঈশ্বর মৃত : গড ইজ ডেড’ ঘোষণায়। বহু শতক ধ’রেই অসুস্থতায় ছিলো ইউরোপি ঈশ্বর, নিটশে তার মৃত্যুর সংবাদটি সংবাদপত্রের শিরোনামের মতো প্রচার করেন। কিন্তু সে কি অচিকিৎসায় বা বাৰ্ধক্যজনিত রোগে মারা গেছে? না, তাকে হত্যা করা হয়েছে। নিটশের প্রফুল্ল বিজ্ঞান (১৮৮২) বইটিতে এক পাগল বাজারে গিয়ে চিৎকার করতে থাকে, ‘আমি ঈশ্বরকে খুঁজছি! আমি ঈশ্বরকে খুঁজছি।’ তার কথা শুনে বাজারের লোকজন হেসে ওঠে; মজা করার জন্যে তারা জিজ্ঞেস করে ঈশ্বর কি হারিয়ে গেছে, না কোথাও লুকিয়েছে, না কি ভ্ৰমণে বেরিয়েছে? তখন ওই পাগল ঘোষণা করে : ‘ঈশ্বর মারা গেছে। ঈশ্বর মৃত। আর আমরাই খুন করেছি তাকে।’ সুধীন্দ্রনাথই সম্ভবত প্ৰথম, বাঙলা ভাষায়, ঈশ্বরের নিহত হওয়ার সংবাদটি দেন।
বেদবেদান্তের পাতা ছিড়ে মরুর বায়ে উড়িয়ে দিয়ে একসাথে তিনি বাতিল করেছেন প্যালেস্টাইনি ও আর্য ঈশ্বর। সুধীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘শূদ্রের অলক্ষ্যভেদে নিহত আমার ভগবান।’ এতে মনে পড়ে মহাভারত-এর কৃষ্ণের মৃত্যুর ঘটনা। প্রত্যাদেশকেও বাতিল করেছেন সুধীন্দ্রনাথ, এবং পরিহাস করেছেন ধৰ্মবোধকে। ধার্মিকেরা ‘ঈশ্বর যা করেন মঙ্গলের জন্যেই করেন’ তত্ত্বে বিশ্বাসী, যাকে দর্শনে পরিণত করেছেন বহু দার্শনিক, যেমন লাইবনিৎস, আর একে পরিহাসও করেছেন। অনেকে, যেমন ভলতেয়ার কাঁদিদ-এ দেখিয়েছেন উপদংশও দিয়ালু ঈশ্বরের দয়া, মঙ্গলের জন্যেই তিনি দান করেছেন উপদংশ; আর সুধীন্দ্রনাথ গভীর বেদনায় বলেছেন : ‘শর্বরীর রুগ্ন মুখ ভ’রে গেলে মারী গুটিকায়/ভাবিব না উৎসুক আমরা/আমাকে ও–পার থেকে আরাত্রিকে আহবান পাঠায়।’ তার কাছে ভগবান হচ্ছে ভগবান, ভগবান, য়িহুদির হিংস্র ভগবান’,-জিহোভা, ইহুদি মহাপুরুষদের কল্পিত প্ৰচণ্ড ঈশ্বর, যে ক্ষিপ্ত হয় সহজে, যে এতোই পবিত্র যে তার নাম নেয়াও নিষেধ, তাই তার নাম এমনভাবে বানান করা হয়, JHWH, যাতে তা উচ্চারণও করা না যায়। সুধীন্দ্রনাথ প্রচুর ধর্ম আর ঈশ্বর দেখেছেন, তাদের সর্বশক্তির অনেক উপাখ্যান শুনেছেন, কিন্তু তার পরিচয় পান নি। অবিশ্বাসে বলেছেন :
ভগবান, ভগবান, রিক্ত নাম তুমি কি কেবলই?
তুমি কি সত্যই
আরণ্যিক নির্বোধের ভ্রান্ত দুঃস্বপন?
তপন্ত তপন
সাহারা-গোবির বক্ষে জুলে না কি তোমার আজ্ঞায়?
তাঁর ভগবান সংজ্ঞাটি চমৎকার : আরণ্যিক নির্বোধের ভ্রান্ত দুঃস্বপন্ন। ভারতীয় ভগবানকে তিনি বলেছেন ‘যাযাবর আর্যের বিধাতা’, আর ‘লুপ্তবংশ কুলীনের কল্পিত ঈশান’। ঈশ্বর কার স্বাৰ্থ দেখে? চিরকাল ঈশ্বর বাস করে গরিবের উঠোনে, আর স্বাৰ্থ দেখে অসুরদের ; ‘তোমার অমিত ক্ষমা, সে কি শুধু অসুরের তরে?’ বিধাতার ক্রিয়াকলাপ দেখে পরিহাস করেছেন সুধীন্দ্রনাথ :
হে বিধাতা,
অতিক্রান্ত শতাব্দীর পৈতৃক বিধাতা,
দাও মোরে ফিরে দাও অগ্রজের অটল বিশ্বাস।
যেন পূর্বপুরুষের মতো
আমিও নিশ্চিন্তে ভাবি, ক্রীত, পদানত
তুমি মোর আজ্ঞাবাহী দাস।
তাদের সমান
মণ্ডূকের কূপে মোরে চিরতরে রাখো, ভগবান।
অগ্রজের অটল বিশ্বাস কিসে? ঈশ্বরে? না, তারা বিশ্বাস করেছে নিজেদের ক্ষমতায়। তারা সৃষ্টি করেছে সর্বশক্তিমানদের, লাগিয়েছে নিজেদের কাজে, এবং নিজেরা রয়ে গেছে কুয়োর ব্যাঙ। সুধীন্দ্রনাথের প্রার্থনা যেনো পূরণ করেছে বিধাতা, তাই এখন বিশ্বজুড়ে দেখা দিচ্ছে অটল বিশ্বাসী কুপমণ্ডুকগণ।
নাইটিংগেলের প্রতি
যা কিছু প্রিয় আমার, যা কিছুর জন্যে নিরর্থক জীবনধারণকে তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয় অনেকখানি, বেঁচে থাকাকে সুখকর মনে হয়, তা রাষ্ট্র নয় সংঘ নয়। সুধীদের কর্মীদের রাজনীতিবিদদের বিবর্ণিতা নয়, সেগুলো খুবই সামান্য ব্যাপার, আর সেগুলোর শুরুতেই রয়েছে কবিতা। সমাজ, বিশেষ ক’রে রাষ্ট্রের কবিতার দরকার নেই; কোনো রাষ্ট্রই মনে করে না যে তার সুঠু পরিচলনের জন্যে কবিতা দরকার, দরকার কবি। ১০০০ মানুষের জন্যে আমাদের ৫০ জন চিকিৎসক দরকার, এক জেলার জন্যে দরকার ১০০ প্রকৌশলী, ৩০০ নির্বাহী কর্মকর্তা, ৪টি নির্বাচিত ১টি মনোনীত প্রতিনিধি, এবং ১৫০০ পতিতা, কিন্তু কোনো কবির দরকার নেই। তবে ব্যক্তির দরকার কবিতা, সমাজের দরকার কবিতা, সভ্যতার দরকার কবিতা। মানুষ সৃষ্টিশীল, তার সম্ভাবনা অশেষ, কবিতা মানুষের সৃষ্টিশীলতার এক শ্রেষ্ঠ প্রকাশ। কবিতার বিচিত্ররূপে মুগ্ধ হই আমি, যদিও সব কবিতাকে সমান মূল্য দিই না, যা কিছু দেখতে কবিতার মতো তাকেই কবিতা মনে করি না, কিন্তু যা কবিতা হয়ে উঠেছে, যা আমার ভেতরে ঘণ্টা বাজায়, তার জন্যে আমার ভালোবাসা অন্তহীন। ‘আমাদের ছোট নদী চলে বাকে বাঁকে’র সরল বর্ণনা যেমন সুখ দেয় আমাকে, বর্ষার উৎসবে পাড়া জেগে ওঠার উল্লাস যেমন চমকে দেয়, তেমনি সুখী করে আমাকে ‘হাতে হাত ধ’রে-ধ’রে গোল হয়ে ঘুরে-ঘুরে-ঘুরে কার্তিকের মিঠা রোদে আমাদের মুখ যাবে পুড়ে’, বা ‘জাতিভেদে বিবিক্তি মানুষ; নিরঙ্কুশ একমাত্র একনায়কেরা’। আমি তেমনি সুখী হই, দেখতে পাই অরণ্যের সামনে সন্ধ্যায় এসে পৌচেছে সে, তাকে মাইল মাইল যেতে হবে মাইল মাইল যেতে হবে ঘুমোনোর আগে, দেখতে পাই সেই ব্ল্যাকবার্ডের চোখ, সমগ্র পর্বতমালার মধ্যে একমাত্র যা-ই শুধু অভিভূতকর, দেখতে পাই সেই পাখিটিকে মৃত্যুর জন্য যার জন্ম হয় নি, বা কোনো লাল চুলের ভিখিরিমেয়েকে, দুটি চোখের মতো যার বুক দীপ্তিময় লাবণ্যের চাপে, দেখতে পাই আকন্দ ধুন্দুল জোনাকিতে ভ’রে গেছে, যে-মাঠে ফসল নাই তাহার শিয়রে চুপে দাঁড়ায়েছে চাঁদ-কোনো সাধ নাই তার ফসলের তরে। অজস্র দৃশ্যের পর দৃশ্য দেখতে পাই, শুনতে পাই ধ্বনির পর ধ্বনি, আর অনুভব করি এমন কিছু যার দৃশ্য নেই গন্ধ নেই ধ্বনি নেই রঙ নেই, রয়েছে অপার গভীর বিপুল বিস্তার।