সূর্য উঠতে দেখি আমরা, দেখি ডুবতে; টলেমিও দেখেছিলেন সূর্য ওঠে, সূর্য ডোবে। এ দেখেই মনে করেছিলেন সূর্য এভাবেই ঘোরে পৃথিবীর চারদিকে, যা খুবই বড়ো ভুল। সূর্য ওঠেও না ডোবেও না; পৃথিবীই ঘুরছে নিজের অক্ষরেখার ওপর ও সূর্যকে ঘিরে নিজের কক্ষপথে। প্যালেস্টাইন অঞ্চলের ধর্মবইগুলোতে এ-ভুলই ঈশ্বরের সত্য ব’লে ঘোষিত হয়েছে। চাদ, সূর্য, ও গ্রহগুলোর দিকে তাকালে মনে হয় এগুলো ঘুরছে পৃথিবীকে ঘিরে; টলেমি এগুলোর গোলাকার পথগুলোকে ভাগ করেছিলেন সাতটি পথে। এগুলোই ধৰ্মগ্রন্থের পবিত্ৰ সাত আসমান : পৃথিবী থেকে ক্রমশ দূরবর্তী চাঁদ, SK (Mercury), &th (Venus), সূৰ্য, Notai (Mars), বৃহস্পতি (Jupiter), ও শনির (Saturn) কক্ষপথ (তখনো ইউরেনাস, নেপটুন, এবং মঙ্গল ও বৃহস্পতির মধ্যবর্তী গ্রহাণুগুলো আবিষ্কৃত হয় নি; আবিষ্কারের পর ধাৰ্মিকেরা আরো তিন আসমান যোগ ক’রে দশ আসমানে বিশ্বাস আনেন)। মধ্যযুগের ইউরোপের কতো না কবিই মুগ্ধ ছিলেন ‘স্ফেয়ার’ বা কক্ষপথের অশ্রুত সঙ্গীতে, এ নিয়ে কতোই কবিতা লিখেছেন তারা। এই সাত আসমানের পরে স্থির নক্ষত্রদের পথ বা অষ্টম আসমান, তারপর আদিচালকের (Primum Mobile : First Mover) অবস্থান, যা নিজে চলে না। কিন্তু চালার সব কিছু। এই নয় কক্ষ বা পথ বা আসমানের পর হচ্ছে দশম স্বৰ্গ, ঈশ্বরের ও তার সন্তদের প্রকৃত বাসভবন। এর কোনো অবস্থান নেই, গতি নেই, চলাচল নেই; এটা শাশ্বত ও অনন্ত। এমন কল্পনায় বিশ্বাসীদের চােখ জলে ভ’রে যায়, ঈশ্বরের মহিমা অনুভব ক’রে তারা স্বর্গের সুখ অনুভব করে। কিন্তু এ হচ্ছে অপকল্পনার চমৎকার উদাহরণ। মানুষের সব ধরনের কল্পনা আমার ভালো লাগে, কিন্তু সেগুলোতে আমি বিশ্বাস করি না, মজা পাই। দান্তের কাব্য সুন্দর, কিন্তু বিশ্বাস ভুল; তাঁর বিশ্বাসের কাজ হচ্ছে বিশ্বকে মিথ্যোয় বা রহস্যে ঢেকে দেয়া।
বাঙলা লেখকদের লেখা পড়ার সময় বিব্রত বোধ করি বারবার। আমাদের প্রধান লেখকদের মধ্যেও মৌলিকত্ব শোচনীয়রূপে কম, যখন তারা চিন্তা করেন তখন তারা অনেকটা শিশু; তাদের অধিকাংশই অবিকশিত, অনেকাংশে অজ্ঞান, বিশ্বজ্ঞানের অভাবে আদিম বিশ্বাস প্রবল তাদের; তাঁরা স্বস্তি পান কুসংস্কারে, পুরোনো বাজেকথায়। কুসংস্কারকীর্তনে তারা অকুণ্ঠ। তরুণ বয়স থেকেই অস্বস্তি বোধ করি আমি নজরুলের লেখা পড়ার সময়; তিনি মাঝারি লেখক বলে নয়, কুসংস্কারাচ্ছন্ন বিভ্রান্ত লেখক ব’লে। তিনি ভারী বোঝার মতো চেপে আছেন বাঙালি মুসলমানের ওপর; বাঙালি মুসলমান তাকে নির্মোহভাবে বিচার করতে পারবে না বহু দিন। বাঙালি মুসলমান প্রগতিশীলেরাও যথেষ্ট প্রতিক্রিয়াশীল, আর তারা পড়ে না, নজরুলকেও পড়ে না, শুনে শুনে বিশ্বাস করে যে নজরুল বিদ্রোহী। প্রচারে প্রচারে তাকে আমি বিদ্রোহী ব’লেই মনে করেছি। যখন বালক ছিলাম, বেশ কিছু পদ্যোগদ্যে দেখেছিও তার বিদ্রোহীরূপ, কিন্তু তিনি বাঙলা ভাষার বিভ্রান্ত কুসংস্কার-উদ্দীপ্ত লেখকদের মধ্যে প্রধান। বেশি ব্যাখ্যায় যাচ্ছি না, কয়েকটি মাত্র উদাহরণ দিচ্ছি। গানের পরে গানে তিনি লিখেছেন ‘নামাজ পড়, রোজা রাখ, কলমা পড়া ভাই।/তোর আখেরের কাজ করে নে, সময় যে আর নাই’; ‘শোনো শোনো য়্যা এলাহি আমার মুনাজাত।/তোমারি নাম জপে যেন হৃদয় দিবস-রাত’; ‘আল্লাহ নামের নায়ে চড়ে যাব মদিনায়’; ‘মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই/যেন গোরে থেকেও মোয়াজিনের আজান শুনতে পাই’, ‘ওরে ও দরিয়ার মাঝি! মোরে নিয়ে যা রে মদিনা’, ‘খোদার প্রেমের শারাব পিয়ে বেহুশ হয়ে রই পড়ে’; ‘আল্লাহ্ আমার প্রভু, আমার নাহি নাহি ভয়/ আমার নবী মোহাম্মদ, যাঁহার তারিফ জগৎময়।’ অবশ্য এগুলোকেও অনেকে মনে করতে পারেন খুবই বিদ্রোহী ও প্রগতিশীল কাণ্ড; কিন্তু এখানো কোনো বিদ্রোহীকে পাচ্ছি না, পাচ্ছি। একজন ইসলাম অন্ধকে।
রবীন্দ্রনাথ করতেন রহস্যীকরণ, তিনি কোনো প্রথাবদ্ধ ধর্মের গীতিকার ছিলেন না; তিনি তাঁর বিশ্বাসকে জড়িয়ে দিতেন মহাজগতের সাথে। নজরুলে সেই রহস্যীকরণ নেই, তিনি স্থূলভাবে প্রকাশ করেছেন তাঁর বিশ্বাস বা উদ্দীপনা। নজরুলের বিশ্বাসও সন্দেহজনক, মনে হয় তিনি এক বিশ্বাসের সাথে আরেক বিশ্বাসের পার্থক্য বোঝেন না। বিধিবদ্ধ ধর্মীয় বিশ্বাসগুলো কঠোর, একটি মানলে আরেকটি মানা যায় না, ইসলাম মানলে হিন্দুধর্ম মানা যায় না, একই সাথে কেউ হ’তে পারে না মুসলমান ও হিন্দু; কিন্তু নজরুল তাঁর এক বিশ্বাস থেকে আরেক বিশ্বাসে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন আগের বিশ্বাস সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে। আমি বিস্মিত হই যিনি লেখেন ‘আল্লাহ্ আমার প্রভু, আমার নাহি নাহি ভয়/ আমার নবী মোহাম্মদ, যাঁহার তারিফ জগৎময়’, তিনি কী ক’রে লিখতে পারেন ‘কালী কালী মন্ত্র জপি বসে লোকের ঘোর শ্মশানে’; ‘বল রে জবা বল!/কোন সাধনায় পেলি শ্যামা মায়ের চরণতল’; ‘তোর রাঙা পায়ে নে মা শ্যামা আমার প্রথম পূজার ফুল’ ও আরো এমন বহু পৌত্তলিক পদ। তিনি কি একই সাথে হতে পারেন খাঁটি মুসলমান, আর কালীভক্ত? অনেকে ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করেন যে নজরুল দুই সংস্কৃতির মিলন ঘটিয়েছিলেন; যদি তিনি তাই ক’রে থাকেন তাহলে তিনি মিলন ঘটিয়েছিলেন দুই খারাপের। আমি কি এমন মিলন ঘটাতে পারি? আমি কি আজ আল্লার স্তব লিখে কাল কালীমায়ের পায়ে সঁপতে পারি নিজেকে? নজরুলের কী কোনো বিশ্বাস ছিলো? না কি তিনি স্বতস্ফুর্ত উদ্গীরণ করেছেন বিদ্রোহ; আর বাণিজ্যিক প্রেরণায় লিখে গেছেন একই সাথে হামদ, নাত, আর কালীকীর্তন? নজরুলের ইসলামি আর শাক্ত গানগুলো তাকে প্রচুর অর্থ এনে দিয়েছিলো, আমরা জানি, আর ওই অর্থই হয়তো তাঁকে মাতিয়েছিলো কুসংস্কৃত উদ্দীপনায়।