স্বাধীন বাংলাদেশের এক অসম্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম নিয়ে, টুপি পরে আইডিয়াল স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করে সপ্তম শ্রেণীতে চলে গেলাম থাকি চত্বরের খোঁয়াড় ক্যাডেট কলেজে। কলেজ শেষ করে মুসলমান কোটায় কোনো ভর্তি পরীক্ষা না দিয়ে ঢুকে গেলাম ইসলাম প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (আইইউটি) তে। আইইউটি, ওআইসিপরিচালিত বাংলাদেশের অন্যতম ‘আন্তর্জাতিক প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গল্প শুনেছি তারা প্রত্যেক ছাত্রের পেছনে পনেরো হাজার ডলার ব্যয় করে শিক্ষাজীবনের চার বছরের বাজেট হিসেবে। ওআইসির সেই টাকা আমার কপালে জুটে নি, কারণ মুসলমান হলেও ভালো মুসলিম ছাত্র ছিলাম না, বাবা-মার পকেট থেকে মোটা অংকের টিউশন ফি দিয়েই তাই পড়াশোনা করতে হয়েছে।
আইইউটিতে ভর্তি হবার আগেই জানতাম এখানে কেবলমাত্র ‘মানুষ’ (শর্ত প্রযোজ্য) দের ভর্তি হবার সুযোগ দেওয়া হয়। ‘মুসলিম পুরুষ’ হওয়াটাই সেখানে মানুষ হবার একমাত্র শর্ত। আইইউটির দুয়ার নারী এবং অমুসলিমদের জন্য বন্ধ। এই চরম সাম্প্রদায়িক আচরণ আমাকে অবাক করলেও অন্য সবার কাছে শুনেছি- জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে মুসলমানদের অবস্থা সারাবিশ্বেই খুব খারাপ, মুসলমানরা নিজেরা বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করে নিজেরা পড়াশোনা করে নিজেদের উন্নতি সাধনের চেষ্টা নাকি খুব ভালো। নারীদের ঢুকতে না দেওয়ার উছিলাটা ছিল- তাতে করে নাকি বিশ্ববিদ্যালয় জুড়ে শুধু পাপাচার হবে। প্রথম বর্ষেই আমাদের তৎকালীন তড়িৎ প্রকৌশল বিভাগের প্রধান পাকিস্তানি অধ্যাপক বলেছিলেন ঠিক এই কথাটাই। রুমে ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়ার অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতেও তার যুক্তি ইসলাম ধর্মে প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে যাবার পর ভাই আর বোনেরও এক রুমে থাকা নিষিদ্ধ। ইন্টারনেটও ঠিক তেমন একটি প্রাপ্ত বয়স্ক আপন বোন, রুমে তাকে আমাদের সাথে একা রাখা যাবে না।
২০০৭ সাল। দ্বিতীয় বর্ষের সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা শেষে দীর্ঘ তিনমাসের ছুটি চলছে। আমার বাসায় থাকতে ভালো লাগত না, তাই ছুটির সময়েও হলে থাকতাম। সপ্তাহান্তে ছোট ভাই জান্নাকে দেখতে খুব ইচ্ছা হতো। ও তখন ক্লাস টু এর পুচকা এবং প্রতি সপ্তাহের শুক্রবারে আমাকে দেখতে পেলে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যেত কারণ আমাকে বললেই আমি চকলেট, আইসক্রিম আর কোক খাওয়াতাম। গাজীপুর থেকে জ্যাম ঠেলে ঢাকা আসতে তিন ঘণ্টা সময় লাগে। সেই সময় আমার প্রথম পরিচয় হয় ‘অভিজিৎ রায় এর লেখার সাথে। প্রিয় বন্ধু ‘শিক্ষানবিস’ আজিজ মার্কেট থেকে দুটো বই কিনে এনেছিল। ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ এবং ‘মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে’। শিক্ষানবিস ময়মনসিংহের এক লাইব্রেরিতে আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী বইটির সামান্য অংশ পড়ে অভিজিৎ রাযের লেখনীতে বেশ মুগ্ধ হয়েছিল, তাই আজিজ থেকে ‘আস্ত” দু’টি বই কিনে আনা। পরের সপ্তাহান্তে জান্নাকে দেখার জন্য আলো। হাতে আঁধারের যাত্রীকে সঙ্গী করে জ্যাম হাতে বাসযাত্রী হলাম। সেই থেকে শুরু। অভিজিৎ রায়ের আলোয় কাল্পনিক সত্তার দাসত্ব থেকে মুক্ত জীবন।
আমাদের সমাজ সদ্যজন্মজাত শিশুর ইহলৌকিক খেলার মাঠের মৌলিক চাহিদা পূরণে খুব একটা আগ্রহী না হলেও তার। পরকাল নিশ্চিত করতে সিদ্ধহস্ত। জন্মগ্রহণ করতে না করতেই সে একটি নির্দিষ্ট ধর্মযুক্ত হয়ে যায়, তারপর ধীরে ধীরে তাকে শেখানো হয় সে যে দলভুক্ত তারাই সেরা, একমাত্র সত্যপথের অনুসারী। অন্যান্যদের জন্য রয়েছে…… (কী রয়েছে সেটা দিয়ে শূন্যস্থান পূরণ করুন)। আমার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। ছোটবেলা থেকেই আশেপাশের সবার কাছে আমার ধর্মের মুজেজা শুনেছি, আর ভেবেছি ‘ওয়াও!!”। আমার বন্ধু-বান্ধব কেউ অন্য কোনো ধর্মের অনুসারী ছিল কিনা এখন মনে নেই, থাকলেও তাদের সাথে ধর্ম সংক্রান্ত ব্যাপারে আমার কথা হয়নি নিশ্চিত। হলে তখনই জানতে পারতাম, নিজ ধর্মকে অন্যদের চেয়ে সেরা প্রতীয়মান করার জন্য প্রত্যেক ধর্মই নানা ধরনের আকর্ষণীয় মুজেজা সংবলিত গল্পের আশ্রয় নেয়। এই সহজ সত্যটা বোধহয় পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষই না জেনে ইন্তেকাল করেন।
আমিও হয়ত সে পথেই যাচ্ছিলাম। ক্যাডেট কলেজে কোনো এক শুক্রবার আমাদের মসজিদের ঈমাম, আবেগঘন ওয়াজ করতে করতে এক গল্প শোনালেন। সে গল্পে ঈশ্বরের অসীম কুদরতে বিখ্যাত কোনো ব্যক্তির পাতে থাকা ভাজা মাছ হঠাৎ করে অভাজা মাছ হয়ে পানিতে ঝাঁপ দিয়ে থর্পের মতো সাঁতার কেটে হারিয়ে যায় গভীর জলে। সমসাময়িক আর আট-দশটা ছেলের মতই বাংলাদেশি মুসলমান পরিবারে বডো হবার ফলে তখনও আমি নিজেকে ধার্মিক ভাবতাম, যদিও পালন করতাম না সেভাবে। ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হতে পারলে ‘মানত” করেছিলাম সেখানে ছয় বছর এক ওয়াক্ত নামাজ বাদ দেবো না। সেটা সম্ভব হয় নি। যদিও কোনো ঝামেলায়পড়লে আর রহমান সুরা এগারো বার পড়ে আল্লাহর নিকট ঝামেলা মুক্তির আবেদন করতাম এ আশায় যে এগারো বার ‘সুরা আর রহমান’ পড়লে যেকোনো ধরনের ঝামেলা থেকে প্যারোলে মুক্তি পাওয়ার বিষয়টা একেবারেই অব্যর্থ। এছাড়া পাশের বাড়ির কোনো মেয়েকে ভালো লাগলেও ‘আর রহমান এবং সুরা ইয়াসিনের আশ্রয় নিতাম, কারণ সুরাগুলো যথাক্রমে এগারোবার ও তিনবার পড়লে, মনোবাসনা পূরণ হতে বাধ্য। কিন্তু ভাজা মাছের জ্যান্ত হয়ে যাওয়া বিশ্বাস করা অসম্ভব। মনে মনে ভাবলাম- যদি সত্যিকার অর্থেই এমন ঘটনা কোরান হাদিসে থেকে থাকে, তবুও আমি ভাজা মাছের অভাজা হয়ে যাওয়া বিশ্বাস করতে পারব না। ধন্যবাদ।