কোন ব্যক্তি যদি একজন ক্ষুধার্তকে অন্নদান ও একজন পথিকের মাল লুণ্ঠন করে, একজন জলমগ্নকে উদ্ধার করে ও অন্য কাউকে হত্যা করে অথবা একজন গৃহহীনকে গৃহদান করে এবং অপরের গৃহ করে অগ্নিদাহ-তবে তাহাকে ‘দয়াময়’ বলা যায় কি? হয়ত তাহার উত্তর হইবে ‘না’। কিন্তু উপরোক্ত কার্যকলাপ সত্বেও ঈশ্বর আখ্যায়িত আছেন ‘দয়াময়’ নামে। … জীবজগতে খাদ্য-খাদক সম্পর্ক বিদ্যমান। যখন কোন সবল প্রাণী দুর্বল প্রাণীকে ধরিয়া ভক্ষণ করে, তখন ঈশ্বর খাদকের কাছে দয়াময় বটে। কিন্তু তখন কি তিনি খাদ্যপ্রাণীটির কাছেও দয়াময়? যখন একটি সর্প একটি ব্যাঙকে ধরিয়া আস্তে আস্তে গিলিতে থাকে, তখন তিনি সর্পটির কাছে দয়াময় বটে। কিন্তু ব্যাঙটির কাছে তিনি নির্দয় নহেন কি? পক্ষান্তরে তিনি যদি ব্যাঙটির প্রতি সদয় হন, তবে সর্পটি অনাহারে মারা যায় না কি? … কাহারও জীবন রক্ষা করা যদি দ্যার কাজ হয় এবং হত্যা করা হয় নির্দয়তার কাজ, তাহা হইলে খাদ্য-খাদকের ব্যাপারে ঈশ্বর ‘সদয় এর চেয়ে নির্দয়’ই বেশী। তবে কতগুণ বেশী তাহা তিনি ভিন্ন অন্য কেউ জানে না, কেননা তিনি এক একটি জীবের জীবন রক্ষা করার উদ্দেশ্যে অসংখ্য জীবকে হত্যা করিয়া থাকেন। কে জানে একটি মানুষের জীবন রক্ষার জন্য তিনি কয়টি মাছ, মোরগ, ছাগল ইত্যাদি হত্যা করেন?… কেহ কেহ মনে করেন যে, ঈশ্বর সদয়ও নহেন এবং নির্দয়ও নহেন। তিনি নিরাকার, নির্বিকার ও অনির্বচনীয় এক সত্ত্বা। যদি তাহা নাই হয়, তবে পৃথিবীতে শিশুমৃত্যু, অপমৃত্যু, এবং ঝড়, বন্যা, মহামারী, ভূমিকম্প ইত্যাদি প্রাণহানির ঘটনাগুলির জন্য তিনিই কি দায়ী নহেন?
আরজ আলীর প্রশ্নমালা মানব মনের অন্তহীন সংশ্যবাদী চিন্তাকেই তুলে ধরেছে সার্থকভাবে। গ্রিক দার্শনিক এপিকিউরাস (৩৪১-২৭০ খ্রি.পূ.) সর্বপ্রথম ‘আর্গুমেন্ট অব এভিল’ (Argument of Evil)-এর সাহায্যে ‘ঈশ্বরের অস্তিত্বের অসাড়তা তুলে ধরেন এভাবে–
‘ঈশ্বর কি অন্যায়-অবিচার-অরাজকতা নিরোধে ইচ্ছুক, কিন্তু অক্ষম?
তাহলে তিনি সর্বশক্তিমান নন।
তিনি কি সক্ষম, কিন্তু অনিচ্ছুক?
তাহলে তিনি পরম দয়াময় নন, বরং অপকারী সত্বা।
তিনি কি সক্ষম এবং ইচ্ছুক-দুটোই?
তাহলে অন্যায়-অবিচার-অরাজকতা পৃথিবীতে বিরাজ করে কীভাবে?
তিনি কি সক্ষমও নন, ইচ্ছুকও নন?
তাহলে কেন তাকে অযথা ‘ঈশ্বর’ নামে ডাকা?’
অকাট্য এই যুক্তি। The Oxford Companion to Philosophy স্বীকার করেছে যে, সনাতন আস্তিকতার বিরুদ্ধে ‘আর্গুমেন্ট অব এভিল’ বা মন্দের যুক্তি সবচেয়ে শক্তিশালী মারণাস্ত্র, যা কেউই এখন পর্যন্ত ঠিকমতো খণ্ডন করতে পারে নি[২৪]। এ তো নিঃসন্দেহে বোঝা যায় যে, প্লেগ, মহামারী, খরা, বন্যা, সুনামির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে লক্ষ কোটি নিরপরাধ নারী-পুরুষ এবং শিশুর মৃত্যুর ব্যাপারে মানুষকে কোনোভাবেই দায়ী করা চলে না। এ সমস্ত অরাজকতার অস্তিত্ব প্রমাণ করে যে, ঈশ্বর একটি অপকারী সত্ত্বা। কারণ ‘সর্বজ্ঞ’ ঈশ্বর আগে থেকেই জানতেন যে, সুনামির ঢেউ আছড়ে পড়ে তার নিজের সন্তানদের হত্যা করবে, তাদের স্বজনহারা করবে, গৃহচ্যুত করবে, ভাসিয়ে নিয়ে যাবে, ঘরবাড়ি ধ্বংস করে এক অশুভ তাণ্ডব সৃষ্টি করবে। অথচ আগে থেকে জানা থাকা সত্ত্বেও সেসব প্রতিরোধে কোনো ব্যবস্থাই তিনি নিতে পারেন নি। এ থেকে প্রমাণিত হয় ঈশ্বর এক অক্ষম সত্ত্বা বই কিছু নয়। দার্শনিক পল কার্জ তার ‘ধর্মীয় দাবি সম্বন্ধে যে কারণে আমি সংশয়বাদী’ প্রবন্ধের একটি অংশে ‘আর্গুমেন্ট অব এভিল’ নিয়ে প্রাঞ্জল ভাষায় আলোচনা করেছেন। এছাড়া, মুক্তমনায় বহু লেখক বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা এবং ঈশ্বরের সর্বজ্ঞতা আসলে পরস্পরবিরোধী[২৬]।
ভিক্টর স্টেঙ্গর পেশায় হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘পদার্থবিদ্যা ও জ্যোতির্বিজ্ঞান’ বিভাগের ইমিরিটাস অধ্যাপক এবং কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালযের দর্শনের সংযুক্ত অধ্যাপক (Adjunct Professor। তিনি একবিংশ শতাব্দীর এই নতুন দিনের নাস্তিকতাবাদী আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ। ভিক্টর স্টেঙ্গর তার ‘গড-দ্য ফেইল্ড হাইপোথিসিস’ বইয়ে সর্বজ্ঞ (Omniscient), পরম করুণাময় (Omnibenevolent) এবং সর্বশক্তিমান (Omnipotent) ঈশ্বর (30 God) থাকাটা যে যৌক্তিকভাবে অসম্ভব তা দেখিয়েছেন[২৭]। একই ধরনের উপসংহারে পৌঁছিয়েছেন মাইকেল মার্টিন এবং রিকি মনিয়ার তাঁদের The impossibility of God বইয়ে[২৮]। কাজেই ঈশ্বরের কোনো বৈশিষ্ট্য যৌক্তিকভাবে পরীক্ষা করে বাতিল করে দেওয়া যাবে না, কিংবা বিজ্ঞান এ ব্যাপারে কোনো অভিমত দিতে পারে না–তা কিন্তু এখন আর ঠিক নয়। বিখ্যাত জীববিজ্ঞানী এবং বিজ্ঞানের দার্শনিক রিচার্ড ডকিন্সও মনে করেন ধার্মিকদের দেওয়া ঈশ্বরের অনেক সংজ্ঞাই টেস্টেবল হাইপোথিসিস, এবং তিনি তার সাম্প্রতিক’ গড ডিলুশন’ বইয়ে এর অনেকগুলোই খণ্ডন করেছেন। এরকম অনেক অনুকল্পের বেশকিছু পরীক্ষা এখনই করা যায়, বাকিগুলো হয়ত প্রযুক্তি উন্নত হলে করা যাবে। অন্তত আব্রাহামিক ধর্মগুলোর ঈশ্বরের যে সংজ্ঞায়ন ধর্মগ্রন্থগুলোতে পাওয়া যায়, তা যে অবৈজ্ঞানিক এবং ভ্রান্ত, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সেজন্যই ভিক্টর স্টেঙ্গর তার নিউ এথিজম বইয়ে বলেন–