বিজ্ঞানীরা এখন বলেন, ঈশ্বরের প্রার্থনায় সাড়া দেওয়া কিংবা সত্যিকার ঈশ্বর কে–এই হাইপোথিসিসগুলো কিন্তু সহজেই পরীক্ষা করে নির্ণয় করা যায়। যেমন, ধরা যাক একটি পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হলো যেখানে মৃত্যুপথযাত্রী হিন্দু মুসলিম, বৌদ্ধ বা খ্রিস্টান রোগীর জন্য আলাদা করে প্রার্থনার ব্যবস্থা করা হবে। দেখা গেল ইসলামি প্রার্থনাতেই রোগী কেবল ভালো হচ্ছে কিংবা মুসলিম রোগী পটাপট সেরে উঠছে, আর বাকিরা পটল তুলছে, তাহলে সাথে সাথে আমরা বুঝে নিতাম ইসলামি আল্লাহই সত্যিকার ঈশ্বর, কারণ তিনিই প্রার্থনায় সাড়া দিচ্ছেন। কিন্তু এ ধরনের ঘটনা ঘটে নি। বরং মায়ো ক্লিনিক, ডিউক ইউনিভার্সিটির সাম্প্রতিক গবেষণাগুলো প্রার্থনার সাথে রোগীর ভালো হওয়ার কোনো সম্পর্কই খুঁজে পায় নি[২২]।
আব্রাহামিক ধর্মগুলোতে বর্ণিত ঈশ্বর পরস্পরবিরোধী একটি সত্বা। যেমন বাইবেলের ধারণা অনুযায়ী ঈশ্বর অদৃশ্য (Col. 1:15, ITi 1:17, 6 : 16), এমন একটি সত্ত্বা যাকে কখনও দেখা যায় নি (John 1: 18, IJo 4 : 12)। অথচ বাইবেলেরই বেশ কিছু চরিত্র যেমন মুসা (Ex 33 : 11, 23), আব্রাহাম, জেকব (Ge. 12 : 7,26 : 2, Ex 6: 3) ঈশ্বরকে দেখতে পেয়েছিলেন বলে বর্ণিত হয়েছে। ঈশ্বর পরিষ্কার করেই বাইবেলে বলেছেন- ‘তোমরা আমার মুখ দেখতে পাবে না, আমাকে দেখার পর কেউ বাঁচতে পারবে না’ (Ex 33 : 20)। অথচ, জেকব ঈশ্বরকে জীবন্ত দেখেছেন (Ge 32:30)। এগুলো তো পরিষ্কার স্ববিরোধিতা। ঠিক একই কথা বলা যায় হযরত মুহাম্মদের মেরাজের ক্ষেত্রেও। আরজ আলী মাতুব্বর তার সত্যের সন্ধান গ্রন্থে লিখেছেন,
এ কথায় প্রায় সকল ধর্মই একমত যে, ‘সৃষ্টিকর্তা সর্বত্র বিরাজিত’। তাহাই যদি হয়, তবে তাহার সান্নিধ্যলাভের জন্য দূরে যাইতে হইবে কেন? আল্লাহতালা কি ঐ সময় হযরত (দ.)–এর অন্তরে বা তাহার গৃহে, মক্কা শহরে অথবা পৃথিবীতেই ছিলেন না? পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলিয়াছেন-”তোমরা যেখানে থাক, তিনি তোমাদের সঙ্গে সঙ্গে আছেন’ (সুরা হাদিদ-৪)। মেরাজ সত্য হইলে এই আয়াতের সহিত তাহার কোনো সংগতি থাকে কি?
আসলে আব্রাহামিক গড হিসেবে চিত্রিত ঈশ্বরের অনেক অ্যাট্রিবিউটকেই যুক্তির নিরিখে পরীক্ষা করে ভুল প্রমাণ করা যায় তা পদার্থবিজ্ঞানী ভিক্টর স্টেঙ্গর দেখিয়েছেন তার ‘গড-দ্য ফেইল্ড হাইপোথিসিস’ বইয়ে। তিনি বলেন–
আমি আমার বইয়ে ধার্মিকদের দেওয়া ঈশ্বরের অনুকল্প নিয়ে বৈজ্ঞানিকভাবেই আলোচনা করেছি, এবং আমার উপসংহার হচ্ছে আব্রাহামিক ঈশ্বর বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি।
আবার, ঈশ্বরকে সংজ্ঞায়িত করতে যে ধরনের গুণাবলি আরোপ করা হয়, পরীক্ষা করে দেখা যেতে পারে সেগুলো পরস্পরবিরোধী কিনা। যেমন, কেউ যদি চারকোণা বৃত্তের অস্তিত্ব দাবি করে, সেটা যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করা যাবে এই ধারণাটি পরস্পরবিরোধী। একই কথা খাটে ঈশ্বরের ক্ষেত্রেও। ধর্ম-দর্শন নির্বিশেষে যে বৈশিষ্ট্যগুলো দিয়ে ঈশ্বরকে সচরাচর মহিমান্বিত করা হয় সেগুলো সবই দেখা গেছে যুক্তির কষ্টিপাথরে খুবই ভঙ্গুর। যেমন, ঈশ্বরকে বলা হয় ‘পরম দয়াময়’ (all-loving) এবং সর্বশক্তিমান (all-powerful or omnipotent), fazo (perfect), সর্বজ্ঞ (omniscient) ইত্যাদি। কিন্তু সর্বশক্তিমত্তা (omnipotence) এবং সর্বজ্ঞতা (omniscience) যে একসাথে প্রযোজ্য হতে পারে না তা যুক্তিবাদীদের দৃষ্টি এড়ায় নি। যেমন, ক্যারেন ওয়েন্স তা সুন্দরভাবে নিম্নোক্ত পঙক্তিমালায় তুলে ধরেন।[২৩]
Can Omniscient God, who
Knows the future, find
The omnipotence to
Change His future mind?
কথা হচ্ছে, ঈশ্বর যদি সর্বজ্ঞ বা ‘অমনিসায়েন্ট’ হন, তবে ভবিষ্যতে কী ঘটবে তা তিনি জানেন। আবার সর্বশক্তিমান হওয়ার কারণে তিনি তা পরিবর্তনেরও ক্ষমতা রাখেন। কিন্তু মুশকিল হলো, তিনি কী করবেন তা অনেক আগে থেকেই জানার মানে হলো শেষ সময়ে আকস্মিকভাবে মত পরিবর্তন করা তার পক্ষে অসম্ভব। আর তার পক্ষে কোনোকিছু অসম্ভব মানেই হচ্ছে তিনি সর্বশক্তিমান নন।
ঈশ্বর যে সর্বশক্তিমান নন, তা নিচের প্রশ্নটির সাহায্যে সহজেই দেখানো যেতে পারে–
যদি প্রশ্ন করা হয়– ঈশ্বর কি এমন কোনো ভারি পাথরখণ্ড তৈরি করতে পারবেন, যা তিনি নিজেই উত্তোলন করতে পারবেন না?
এ প্রশ্নটির উত্তর যদি হ্যাঁ হয়–তার মানে হচ্ছে ঈশ্বরের নিজের তৈরি পাথর নিজেই তুলতে পারবেন না, এর মানে তিনি সর্বশক্তিমান নন। আবার প্রশ্নটির উত্তর যদি না হয়, তার মানে হলো, সেরকম কোনো পাথর তিনি বানাতে পারবেন না, এটাও প্রকারান্তরে তার অক্ষমতাই প্রকাশ করছে। এ থেকে বোঝা যায়, অসীম ক্ষমতাবান বা সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী বলতে কিছু নেই। দেখা গেছে, মানুষের কাছে যা যৌক্তিকভাবে অসম্ভব, তা ঈশ্বরও তৈরি করতে পারছেন না। ঈশ্বর পারবেন না চারকোণা বৃত্ত আঁকতে, ঈশ্বর পারবেন না কোনো ‘বিবাহিত ব্যাচেলর’ দেখাতে; কারণ এগুলো যৌক্তিকভাবে অসম্ভব।
ঈশ্বর যে পরম করুণাময় বা ‘অল লাভিং’ নন, তা বুঝতে রকেট সায়েন্টিস্ট হতে হয় না। আরজ আলী মাতুব্বর তার ‘সত্যের সন্ধানে’ গ্রন্থে বলেছেন–