১। যার শুরু (উৎপত্তি) আছে, তার পেছনে একটি কারণ রয়েছে।
২। আমাদের আজকের এই মহাবিশ্বের একটি উৎপত্তি আছে।
৩। সুতরাং এই মহাবিশ্বের পেছনে একটি কারণ আছে।
৪। সেই কারণটিই হলো ‘ঈশ্বর।
দার্শনিকেরা কালামের যুক্তিকে তীব্রভাবে আক্রমণ করেছেন বিভিন্ন সময়েই[৩৫২]। এ বইয়েও কয়েকটি প্রবন্ধে ‘আদি কারণের’ যুক্তিগুলোর খণ্ডন অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এখানে ‘বাহুল্য বিধায় সেগুলোর পুনরুল্লেখ করা হলো
। তবে একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার উল্লেখ না করলেই নয়। সবকিছুর পেছনেই কারণ আছে বলে পেছাতে পেছাতে বিশ্বাসীরা ঈশ্বরের কাছে গিয়ে হঠাৎ করেই থেমে যান। এ সময় আর তারা যেন কোনো কারণ খুঁজে পান না। মহাবিশ্বের জটিলতাকে ব্যাখ্যা করার জন্য যদি ঈশ্বর নামক একটি সার আমদানি করতেই হয়, তবে সেই ঈশ্বরকে ব্যাখ্যা করার জন্য একই যুক্তিতে আরেকটি ‘ঈশ্বর’কে কারণ হিসেবে আমদানি করা উচিত। তারপর সেই ঈশ্বরের ঈশ্বর’-এর অস্তিত্ব ব্যাখ্যার জন্য লাগবে আরেকজন ঈশ্বর। এভাবে আমদানির খেলা চলতেই থাকবে একের পর এক, যা আমাদেরকে অসীমের দিকে ঠেলে দেবে। এই ব্যাপারটি স্বাভাবিকভাবেই সকল বিশ্বাসীদের কাছে আপত্তিকর। তাই ধর্মবাদীরা নিজেরাই ‘সবকিছুর পেছনেই কারণ আছে এই স্বতঃসিদ্ধের ব্যতিক্রম হিসেবে ঈশ্বরকে কল্পনা করে থাকেন আর সোচ্চারে ঘোষণা করেন ঈশ্বরের অস্তিত্বের পেছনে কোনো কারণের প্রয়োজন নেই। সমস্যা হলো যে, এই ব্যতিক্রমটি কেন শুধু ঈশ্বরের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে, মহাবিশ্বের ক্ষেত্রে কেন নয় এর কোনো যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা তারা দিতে পারেন না।
দর্শন ছেড়ে এবার বিজ্ঞানের দিকে চোখ ফেরানো যাক। ‘যার শুরু আছে তার পেছনে কারণ থাকতেই হবে’-কালামের যুক্তিমালার প্রাথমিক ধাপটিকে বিজ্ঞানের জগতে অনেক আগেই খণ্ডন করা হয়েছে কারণবিহীন কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনের উদাহরণ হাজির করে।
আণবিক পরিবৃত্তি, আণবিক নিউক্লিয়াসের তেজস্ক্রিয় অবক্ষয়ের মতো কোয়ান্টাম ঘটনাসমূহ ‘কারণবিহীন ঘটনা হিসেবে ইতোমধ্যেই বৈজ্ঞানিক সমাজে স্বীকৃত। হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা তত্ত্ব অনুযায়ী সামান্য সময়ের জন্য শক্তি উৎপন্ন ও বিনাশ ঘটতে পারে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কোনো কারণ ছাড়াই। এগুলো সবগুলোই পরীক্ষিত সত্য। কাজেই উপরের উদাহরণগুলোই কালামের যুক্তিকে খণ্ডন করার জন্য যথেষ্ট।
সম্প্রতি বিজ্ঞানী লরেন্স ক্রাউস তার লেখা A Universe from Nothing[৩৫৩] বইটিতে তথাকথিত শূন্য থেকে কীভাবে জড় কণিকা উদ্ভূত হয় তা নিয়ে বিশদভাবে আলোচনা করেছেন। বহু বিজ্ঞানীই আজ মনে করেন এক কারণবিহীন কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনের (Quantum Fluctuation) মধ্য দিয়ে এই মহাবিশ্বের উৎপত্তি হতে পারে, যা পরবর্তীকালে সৃষ্ট মহাবিশ্বকে স্ফীতির (Inflation) দিকে ঠেলে দিয়েছে, এবং আরও পরে পদার্থ আর কাঠামো তৈরির পথ সুগম করেছে[৩৫৪]। এগুলো কোনো কল্পকাহিনি নয়। মহাবিশ্ব যে শূন্য থেকে উৎপন্ন হতে পারে প্রথম এ ধারণাটি ব্যক্ত করেছিলেন এডওয়ার্ড ট্রিয়ন ১৯৭৩ সালে ‘নেচার’ নামক বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক জার্নালে[৩৫৫]। এরপর আশির দশকে স্ফীতি তত্ত্বের আবির্ভাবের পর থেকেই বহু বিজ্ঞানী প্রাথমিক কোয়ান্টাম ফ্লাকচুযেশনের ধারণাকে স্ফীতি তত্বের সাথে জুড়ে দিয়ে মডেল বা প্রতিরূপ নির্মাণ করেছেন। শুন্য থেকে এই মহাবিশ্ব উৎপত্তির ধারণা যদি অবৈজ্ঞানিক এবং ভ্রান্তই হতো, তবে সেগুলো প্রখ্যাত বৈজ্ঞানিক সাময়িকী (Scientific Journal) গুলোতে কখনোই প্রকাশিত হতো না। মূলত স্ফীতি তত্বকে সাম্প্রতিককালে বেশ কিছু পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়েছে, এবং প্রায় সবগুলোতেই এই তত্ব অত্যন্ত সাফল্যের সাথে এ পর্যন্ত উত্তীর্ণ হয়েছে[৩৫৬]। স্ফীতি তত্ব গ্যালাক্সির ক্লাস্টারিং, এক্স রশ্মি এবং অবলোহিত তেজস্ক্রিয়তার বিন্যাস, মহাবিশ্বের প্রসারণের হার এবং এর ব্যস, মহাবিশ্ব গঠনে এর উপাদানগুলোর প্রাচুর্য সবকিছুই ব্যাখ্যা করতে পেরেছে নিখুঁত সৌন্দর্যে। এর কারিগরি দিকগুলো এখানে আলোচনা করছি না, এগুলো নিয়ে বিস্তৃতভাবে আলোচনা করা হয়েছে অভিজিৎ রায় এবং মীজান রহমানের ‘শূন্য থেকে মহাবিশ্ব বইয়ে[৩৫৭]।
আসলে ইনফ্লেশন বা স্ফীতি নিয়ে আঁদ্রে লিন্ডে আর তার দলবলের সাম্প্রতিক গবেষণার ফলাফল যদি সত্যি হয়ে থাকে তবে সত্যিকার অর্থেই সেই উত্তপ্ত বিগব্যাং যার মাধ্যমে পনেরো শ’ কোটি বছর আগে এক মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে এ মহাবিশ্ব তৈরি হয়েছে বলে ধারণা করা হয়, তাকে বিদায় জানানোর সময় এসে গিয়েছে। কারণ, সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, বিগব্যাং দিয়ে মহাবিশ্বের শুরু নয়, বরং মহাবিশ্বের শুরু হয়েছে ইনফ্লেশন দিয়ে। অর্থাৎ, বিগব্যাং-এর পরে ইনফ্লেশনের মাধ্যমে মহাবিশ্ব তৈরি (যা কিছুদিন আগেও সত্যি বলে ভাবা হতো) হয় নি, বরং ইনফ্লেশনের ফলশ্রুতিতেই কিন্তু বিগব্যাং হয়েছে, তারপর সৃষ্ট হয়েছে আমাদের মহাবিশ্ব। তার কথায়[৩৫৮]–
Inflation is not a part of big-bang theory as we thought 15 years ago. On the contrary, the big-bang is the part of inflationary model.