যা হোক, লেখার এই পর্যায়ে এসে অক্কামের ক্ষুরের ইতিহাসটি পাঠকদের সামনে একটু ছোট করে বান করতে চাচ্ছি। অক্কামের ক্ষুর’ নামক এই অদ্ভুতুড়ে পরিভাষাটি আসলে এসেছে ইংরেজ দার্শনিক উইলিয়াম অকহামের (William Ockham, ১২৪৫-১৩৪৯) নাম থেকে। অকহাম নিজে যদিও এই সূত্রটির উদ্ভাবক ছিলেন না, তবে এই সূত্রটি তিনি প্রায়শই বিভিন্নভাবে ব্যবহার করতেন বলে শোনা যায়। আর সেজন্যই তার নাম এই সূত্রের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে। আমরা অবশ্য জানি না যে, নাপিতের ‘দাঁড়ি কামানোর ক্ষুরের মতো ভয়ংকর একটা কিছুর আদলে তার নাম নিয়ে এই উদ্ভট পরিভাষা সৃষ্টির সাথে তিনি একমত হতেন কিনা, তবে তিনি চান বা না চান তার নামটি কিন্তু বিখ্যাত এই সূত্রের সাথে আজ ওতপ্রোতভাবেই জড়িয়ে রয়েছে। ‘অক্কামের ক্ষুর’ মধ্যযুগীয় দর্শনের এক গুরুত্বপূর্ণ নীতি হিসেবে বিবেচিত হয়।
রসিকজনেরা কিন্তু এই সূত্রটি নিয়ে নানা ধরনের রসিকতা করতেও ছাড়েন নি। যেমন কেউ কেউ এই সূত্রটিকে অভিহিত করেন ‘Kiss’ সূত্র (Keep it simple, stupid) হিসেবে। কেউবা এই সূত্রটির নির্যাসকে তুলে ধরেন এভাবে–
যখন কোথাও ঘোড়ার ডাক শোনো, তখন ঘোড়ার কথাই মাথায় রেখো, জেব্রা বা জিরাফের নয়।
বিখ্যাত চিত্রকর ও বিজ্ঞানী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি (১৪৫২-১৫১৯) ছিলেন অকহামের সমসাময়িক ব্যক্তিত্ব। তিনিও তার মতো করে একটি ‘অক্কামের সূর’ তৈরি করেছিলেন। তার রচিত ‘অষ্কামের ক্ষুরটি ছিল এ রকম–
Simplicity is the ultimate sophistication
ইতিহাসে অক্কামের ফুরের একটি সার্থক প্রযোগের উল্লেখ পাওয়া যায় বিজ্ঞানী লাপ্লাস এবং নেপোলিয়নের একটি মজার ঘটনায়। মুক্তমনার প্রথম বই ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী,[৩৫১] শেষ হয়েছিল এ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটির উল্লেখে। তবে, ঘটনাটি বানানো কিছু নয়। ঘটনাটি আমাদের নজর কাড়ে বিখ্যাত জ্যোতির্পদার্থবিদ মেঘনাদ সাহার ‘হিন্দু ধর্ম-বেদ-বিজ্ঞান সম্পর্কিত একটি চিত্তাকর্ষক বাদানুবাদ থেকে (আধুনিক বিজ্ঞান ও হিন্দুধর্মঃ অনিলবরণ রাযের সমালোচনার উত্তর, মেঘনাদ সাহা, মেঘনাদ রচনা সংকলন, শান্তিময় চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত, ওরিয়েন্ট লংম্যান, কলিকাতা, ১৯০৮, পৃষ্ঠা ১২৭-১৬৯ দ্র.)। বর্ণিত ঘটনাটি এরকম–
বিখ্যাত গণিতজ্ঞ লাপ্লাস তার সুবিখ্যাত ‘Mechanique Celeste’ গ্রন্থে গ্রহসমূহের এবং চন্দ্রের গতির খুব সন্তোষজনক ব্যাখ্যা প্রদান করেন। তিনি প্রমাণ করেন যে, গতিবিদ্যা ও মাধ্যাকর্ষণ দিয়ে পর্যবেক্ষিত সকল গ্রহগতির সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা দান সম্ভব। তিনি যখন গ্রন্থটি নেপোলিয়নকে উৎসর্গ করার জন্য অনুমতি চাইতে গেলেন, তখন নেপোলিয়ন রহস্য করে বলেন,
মসিঁয়ে লাপ্লাস, আপনি আপনার বইয়ে বেশ ভালোভাবেই মহাকাশের গ্রহ-নক্ষত্রের চালচলন ব্যাখ্যা করেছেন; কিন্তু আমি দেখলাম আপনি কোথাও ঈশ্বরের নাম উল্লেখ করেন নি। আপনার মডেলে ঈশ্বরের স্থান কোথায়?
লাগ্লাস উত্তরে বললেন, স্যার, এই বাড়তি অনুকল্পের কোনো প্রয়োজন নেই।
.
ঈশ্বরই কি সৃষ্টির আদি বা প্রথম কারণ?
বার্ট্রান্ড রাসেল তার বিখ্যাত ‘Why I am not a Christian প্রবন্ধে প্রথম কারণ সম্বন্ধে বলেন–
আমাদের আগেই বুঝে রাখা দরকার যে জগতের যা কিছু আমরা দেখতে পাই, সবকিছুর একটি কারণ আছে। এই কারণকে প্রশ্ন করতে করতে আপনি পেছনের দিকে এগিয়ে গিয়ে অবশ্যই প্রথম কারণের (First Cause) সম্মুখীন হবেন, এবং এই প্রথম কারণকেই স্বতঃসিদ্ধভাবে ‘ঈশ্বর হিসেবে ধরে নেওয়া হয়।… আমিও বহুদিন ধরেই এটিকে স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছিলাম কিন্তু একদিন, যখন আমার বয়স আঠারো, আমি জন স্টুয়ার্ট মিলের আত্মজীবনী পড়ছিলাম, আর পড়তে গিযেই সেখানে এই বাক্যটি পেলাম: ‘আমার বাবা আমাকে প্রশ্ন করলেন। ‘কে আমাকে তৈরি করেছে?” আমি এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারি নি। কিন্তু এই প্রশ্নটি আমাকে আরও একটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্নের দিকে ঠেলে দিল। যেটি হলো ঈশ্বরই যদি আমাকে তৈরি করে থাকেন, তবে ঈশ্বরকে তৈরি করেছে কে? আমি এখনও মনে করি ঈশ্বরকে তৈরি করেছে কে? এই সহজ সরল বাক্যটি প্রথম কারণ সম্পর্কিত যুক্তির দোষটি। সেই প্রথম আমাকে দেখালো। যদি প্রতিটি জিনিসের একটি কারণ থাকে, তবে ঈশ্বরেরও কারণ থাকতে হবে। আবার যদি কারণ ছাড়াই কোনোকিছু থাকতে পারে (যেমন ঈশ্বর), তবে এই যুক্তি ঈশ্বরের জগতের জন্যও সমানভাবে প্রযোজ্য।
‘বিগব্যাং তত্বটি বৈজ্ঞানিক সমাজে গৃহীত হওয়ার পর পরই বিশ্বাসীদের মধ্যে নতুন করে প্রথম কারণটিকে প্রতিষ্ঠিত করার নব উদ্দীপনা লক্ষ্য করা গেল। ১৯৫১ সালে Pope Pius XII পন্টিফিকাল অ্যাকাডেমির সভায় বলেই বসলেন–
যদি সৃষ্টির শুরু থাকে, তবে অবশ্যই এই সৃষ্টির একজন স্রষ্টাও রয়েছে, আর সেই স্রষ্টাই হলেন ঈশ্বর।
জ্যোর্তিবিজ্ঞানী এবং ধর্মযাজক জর্জ হেনরি লেমিত্রি (যিনি ‘বিগব্যাং’ প্রতিভাসের একজন অন্যতম প্রবক্তা) পোপকে সেসময় বিনয়ের সঙ্গে এধরনের যুক্তিকে ‘অভ্রান্ত’ হিসেবে প্রচার করা থেকে বিরত থাকতে পরামর্শ দিয়েছিলেন।
ইদানীংকালে ‘কালাম কসমোলজিক্যাল আর্গুমেন্ট (Kalam Cosmological Argument) নামে একটি দার্শনিক যুক্তিমালা সাধারণ বিশ্বাসীদের কাছে খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত সুদর্শন দার্শনিক এবং পেশাদার বিতার্কিক উইলিয়াম লেন ক্রেইগ (William Lane Craig) ১৯৭৯ সালে লেখা The Kalam Cosmological Argument বইয়ের মাধ্যমে যুক্তির এই ধারাকে সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয় করে তোলেন। ধারাটিকে নিচের চারটি ধাপের সাহায্যে বর্ণনা করা যায়–