০ মহাবিশ্বের অস্তিত্ব > প্রাকৃতিক নিয়ম
২) আমাদের সামনে এক জটিল মহাবিশ্বের অস্তিত্ব রয়েছে, এবং একজন ঈশ্বর’ও রয়েছেন যিনি এই মহাবিশ্ব তৈরি করেছেন। এখানে ‘ঈশ্বর স্বভাবতই একটি পৃথক সত্ত্বা হিসেবে দেখা দিচ্ছে। অর্থাৎ,
০ মহাবিশ্বের অস্তিত্ব > নিয়ম + ঈশ্বর
যদি এই দুইটি পথের মধ্যে একটিকে পছন্দ করতে হয়, তবে ‘অক্কামের সূত্র এদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত সহজটিকে সমাধান হিসেবে গ্রহণ করতে বলবে অর্থাৎ প্রথম সমাধানটি এক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হবে।
কেউ কেউ অবশ্য তৃতীয় একটি সমাধানকে অপেক্ষাকৃত সহজ হিসেবে বিবেচনা করতে পারেন–
আমাদের সামনে কোনো জটিল। মহাবিশ্বের অস্তিত্ব নেই আসলে সবই মাযা আমাদের কল্পনা!
তবে এই তৃতীয় সমাধানটি আমাদের সলিপসিজমের (Solipsism) পথে নিয়ে যায় যা অধিকাংশ যুক্তিবাদীর কাছে অগ্রহণযোগ্য।
জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অক্কামের সূরের চমৎকার একটি প্রয়োগ আমরা পাই যখন চার্লস ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে ঘটা বিবর্তন তত্ত্ব উইলিয়াম প্যালের ‘ডিজাইন আর্গুমেন্ট’ বা সৃষ্টির পরিকল্পিত যুক্তিকে বাতিল করে দিয়েছিল। উইলিয়াম প্যালে (১৭৪৩ ১৮০৫) ‘র বিখ্যাত বই ‘Natural Theology, or Evidence of Existence and Attributes of the Deity, collected from the Appearences of Nature’–প্রকাশিত হয় ১৮০২ সালে। ধর্মতত্ত্ব ও দর্শনের ইতিহাসে নিঃসন্দেহে এটি গুরুত্বপূর্ণ একটি বই ছিল সেসময়। জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়েও প্যালে ভেবেছিলেন বিস্তর, কিন্তু নিজেই শেষ পর্যন্ত বলেছিলেন ‘বুদ্ধিদীপ্ত স্রষ্টার অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য জ্যোতির্বিজ্ঞান উপযুক্ত মাধ্যম নয়’; এ ক্ষেত্রে প্যালের ‘উপযুক্ত মাধ্যম মনে হয়েছিল বরং জীববিজ্ঞানকে। আর পূর্ববর্তী অন্যান্য ন্যাচারাল থিওলজিয়ানদের মতোই প্যালেও জীবজগতকে পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে জীবের অভিযোজনের ক্ষমতা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। প্যালে লক্ষ্য করেছিলেন যে, প্রতিটি জীবদেহে নির্দিষ্ট কাজ করবার জন্য নির্দিষ্ট অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ রয়েছে, যা জীবটিকে নির্দিষ্ট কোনো পরিবেশে টিকে থাকতে সহায়তা করে। তিনি জটিল জীবদেহকে ঘড়ির কাঠামোর সাথে তুলনীয় মনে করেছিলেন, এবং তার মধ্যেই দেখেছিলেন স্রষ্টার সুমহান পরিকল্পনা, উদ্দেশ্য আর নিপুণ তুলির আঁচর। আর চোখকে প্যালে অনেকটা জৈব-টেলিস্কোপ হিসেবে ধরে নিয়েছিলেন। তাই খুব স্বাভাবিক ভাবেই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে, ঘড়ি কিংবা টেলিস্কোপ তৈরি করার জন্য যেহেতু একজন কারিগর দরকার, চোখ ‘সৃষ্টি করার জন্যও প্রয়োজন একজন অনুরূপ কোনো কারিগরের। সেই কারিগর যে একজন ব্যক্তি ঈশ্বর’ (Personal God) ই হতে হবে তা প্যালে খুব পরিষ্কার করেই বলেছিলেন তার গ্রন্থে।
প্যালের এই ‘ঘড়ির কারিগরের যুক্তি’ দর্শনশাস্ত্রে পরিচিত ‘পরিকল্পিত যুক্তি’ বা ‘আমেন্ট অব ডিজাইন নামে। এই যুক্তি ঈশ্বর নামক একটি সত্ত্বার অস্তিত্বের পেছনে অত্যন্ত জোরালো যুক্তি হিসেবে বিশ্বাসীরা ব্যবহার করতেন। ডারউইনের বিবর্তন তত্বই প্রথমবারের মতো এই ডিজাইন আর্গুমেন্টকে শক্তিশালীভাবে চ্যালেঞ্জ করে ভুল প্রমাণ করে দিয়েছিল। ডারউইন প্রস্তাব করলেন জীবদেহকে কেবল ঘড়ির সদৃশ যন্ত্রের মতো কিছু ভেবে বসে থাকলে চলবে না। জীবজগৎ যন্ত্র নয়; কাজেই যন্ত্র হিসেবে চিন্তা করা বাদ দিতে পারলে এর পেছনে আর কোনো ডিজাইন বা পরিকল্পনার মতো ‘উদ্দেশ্য খোঁজার দরকার নেই। জীবজগতে চোখ বা এধরনের জটিল। প্রত্যঙ্গের উদ্ভব ও বিবর্তনের পেছনে ডারউইন প্রস্তাব করলেন এক ‘অন্ধ কারিগরের’, নাম প্রাকৃতিক নির্বাচন যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে লাখ লাখ বছর ধরে ধাপে ধাপে গড়ে ওঠা পরিবর্তনের ফলে চোখের মতো অত্যন্ত জটিল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গড়ে ওঠা সম্ভব। এ প্রক্রিয়াটির নাম ক্রমবর্ধমান নির্বাচন (Cumulative selection। একাধিক ধাপের এই ক্রমবর্ধমান নির্বাচনের মাধ্যমে ধাপে ধাপে যে জটিল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ উদ্ভূত হতে পারে তা ইতোমধ্যেই বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে।
ছবি। পেজ ৪৫৯
চিত্র : ডারউইন দেখিয়েছেন যে, প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে ঘটা বিবর্তন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে লাখ লাখ বছর ধরে ধাপে ধাপে গড়ে। ওঠা পরিবর্তনের ফলে কাঠঠোকরার ঠোঁটের মতো অত্যন্ত জটিল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গড়ে ওঠা সম্ভব।
শুধু তাই নয়, এ পদ্ধতিতে আংশিকভাবে চোখের উৎপত্তি ও বিকাশ যে সম্ভব এবং তা বিভিন্ন প্রতিকূল পরিবেশে যে একটি জীবের টিকে থাকার সম্ভাবনাকে অনেকাংশে বাড়িয়ে তুলতে পারে তারও অজস্র উদাহরণ রয়েছে আমাদের চারপাশে। বিবর্তন তত্ত্ব ডিজাইন আর্গুমেন্টকে। বাতিল করে দেয় বলেই আমরা আজ প্রজাতির ‘উৎপত্তির কথা বলি, ‘সৃষ্টি’র নয়। বিবর্তন তত্বই প্রথমবারের মতো আমাদের দেখিয়ে দিল যে, মানুষসহ অন্যান্য জীবের উদ্ভবের পেছনে কোনো স্বর্গীয় কারণ খোঁজার দরকার নেই; অন্যান্য পশুপাখি, গাছপালা প্রাকৃতিক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এ পৃথিবীতে এসেছে, মানুষ নামের দ্বিপদী প্রাণীটিও ঠিক একই বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় এ পৃথিবীতে এসেছে, কোনো ধরনের ‘সৃষ্টি’ (কিংবা সৃষ্টিকর্তার হস্তক্ষেপ) ছাড়াই। বিবর্তন তত্ব কীভাবে সৃষ্টির পরিকল্প যুক্তি বা ডিজাইন আর্গুমেন্টকে সরাসরি বাতিল করে দেয়, সেটার তেরো পর্বের একটা flaps (written by Dylan Evans & Howard Selina) রাখা আছে মুক্তমনা সাইটে[৩৫০]। এর দার্শনিক অভিব্যক্তি এতই বিশাল ছিল যে, অধ্যাপক ডকিন্স বলতে বাধ্য হয়েছিলেন যে, ডেভিড হিউম কিংবা বার্ট্রান্ড রাসেলেরা ঈশ্বরের অস্তিত্বের যুক্তিগুলো বহুভাবে খণ্ডন করলেও ডারউইনের বিবর্তন তত্বই তাকে intellectually fulfilled atheist’-এ রূপান্তরিত করতে পেরেছে অত্যন্ত সার্থকতার সাথে। দার্শনিক ড্যানিয়েল ডেনেট সেজন্যই তার একটি বইয়ে বিবর্তন তত্বকে রাজাম্ল বা ইউনিভার্সাল এসিড’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।