শুধু ব্লগ কেন, পৃথিবীর দিকে তাকালে দেখা যাবে, বহু দেশেই বিশেষ করে ইউরোপের দেশগুলোতে লোকজন এখন ধর্মের ধারই ধারে না। চার্চগুলো খালিই পড়ে থাকে। অনেকেই মনে করেন, নাস্তিকতাকে ধর্ম হিসেবে দেখলে ‘ফাস্টেস্ট গ্রোয়িং রিলিজিয়ন সম্ভবত ধর্মহীনতার দিকেই রায় দিবে[৩৪৯]। ছোটবেলা থেকে মগজ ধোলাইয়ের মতো স্রেফ পৈত্রিক সূত্রে প্রাপ্ত ধর্ম বিশ্বাসটা মাথায় জোর করে ঢুকিয়ে না দিয়ে পরিণত বয়সে এসে ‘সবকিছু দেখে শুনে, যাচাই বাছাই করে’ ধর্মকে গ্রহণ করার সুযোগ দেওয়া হলে আমরা বহু ধার্মিককে নাস্তিক হিসেবে দেখতে পেতামও এটা সত্যিই বলা যায়।
আমাদের বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা এবং মানবতা শিশুকাল অতিক্রম করে গেছে বহু আগেই। এখন আর আমরা রূপকথার কল্পিত পরম পিতা নিয়ে মোহিত নই, যে পরম পিতা ‘ডাবের ভিতর পানি কেন’ থেকে শুরু করে বিগব্যাং কিংবা ব্ল্যাকহোল পর্যন্ত সবকিছুর পেছনেই একমাত্র গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা হিসেবে হাজির হবেন আর আমাদের প্রযোজনের অলীক ত্রাণকর্তা হিসেবে নিজেকে পরিচিত করবেন। সময় এগিয়েছে অনেক, আমরা নিজেরাই এখন নিজেদের দায়িত্ব নিতে সম, মানুষ নিজেই আজ নিজের ভাগ্যবিধাতা। আমরা আর রূপকথার জাল বুনে নিজেদের প্রবোধ দিতে চাই না, বরং বিজ্ঞানের সাম্প্রতিক জ্ঞানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে এখন জীবন সাজাতে চাই। অন্যদিকে ধর্মগুলো এখন প্রগতির অন্তরায়, বিজ্ঞানের অন্তরায়, নারীমুক্তির পথে প্রধান বাধা। ধর্মগুলো নৈতিকতার নামে পুরনো আমলের জিনিস শেখাতে চায়। মানুষের উদ্ভব সম্বন্ধে ভুল ধারণা দেয়, বিজ্ঞানের নানান অপব্যাখ্যা হাজির করে। আর জিহাদ, ধর্মযুদ্ধ, জাতিভেদ, নিম্ন বর্ণের ওপর অত্যাচার কিংবা নারীদের অন্তরিন রাখার বৈধতা এগুলো তো আছেই। এগুলোকে ‘না’ বলার মাধ্যমেই প্রগতিশীল সমাজ গঠন সম্ভব, সেই সাথে সম্ভব বিশ্বাসের ভাইরাসমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার দিকে এগিয়ে যাওয়ার। এটাই আজ সময়ের দাবি।
পরিশিষ্ট – অক্কামের ক্ষুর এবং বাহুল্যময় ঈশ্বর
অক্কামের ক্ষুরকে দর্শনশাস্ত্রে অনেক সময় মিতব্যয়িতার নীতি’ (Principle of Parsimony/Economy) কিংবা ‘সরলতার নীতি’ (Principle of Simplicity) হিসেবে অভিহিত করা হয়। সংক্ষেপে এর মূলনীতিটি হলো–
Pluralitas non est ponenda sine neccesitate (Plurality should not be posited without necessity).
বাংলা করলে দাঁড়ায়– ‘অনাবশ্যক বাহুল্য সর্বদাই বর্জনীয়।
এই নীতি প্রয়োগ কিন্তু বিজ্ঞানে, ধর্মে, দর্শনে খুবই ব্যাপক। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ‘অক্কামের ক্ষুরের প্রয়োগ হরহামেশাই লক্ষ্য করা যায়। বিজ্ঞানীরা অষ্কামের যে মূলনীতিটি অনুসরণ করেন তা হলো ‘যদি দুটি বৈজ্ঞানিক মডেল একই রকম ভবিষ্যদ্বাণী কিংবা ফলাফল প্রদান করে থাকে, তবে অপেক্ষাকৃত সহজ মডেলটি সমাধান হিসেবে গ্রহণ করো’ একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। একটা সময় গ্রহদের অনিয়ত-গতিপ্রকৃতি জ্যোতির্বিদদের কাছে বড় ধরনের তাত্ত্বিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল। কেপলার এই সমস্যা সমাধান করতে আমাদের সামনে হাজির করেছিলেন তিনটি সূত্র। আর পরবর্তীকালে একই সমস্যা সমাধান করতে গিয়ে কেপলারের এই তিনটি নিয়মের বদলে নিউটন আমাদের দিলেন একটি মাত্র সূত্র ‘মহাকর্ষীয় ব্যস্তবর্গীয় নিয়ম (Inverse Law of Gravity) যা দিয়ে গ্রহ উপগ্রহের চলাচলজনিত সমস্যাগুলোর একটা সহজ সমাধান পাওয়া যায়। দেখা গেল, এই একটি নিয়ম থেকেই কেপলারের পূর্বেকার নিয়মগুলো স্বতঃসিদ্ধভাবে বেরিয়ে আসে। কাজেই যখন থেকে নিউটনের মহাকর্ষ সূত্রটিকে ‘বৈজ্ঞানিক মডেল হিসেবে গ্রহণ করা হলো, কেপলারের সূত্রগুলো ‘অনর্থক বাহুল্য হিসেবে পরিত্যক্ত হলো সংগত কারণেই। এটি অক্কামের সূত্রের একটি খুবই সার্থক প্রয়োগ।
অক্কামের ক্ষুরের আরেকটি সার্থক প্রয়োগ দেখা যায় ইথারের ক্ষেত্রে। ঊনবিংশ শতাব্দীর পদার্থ বিজ্ঞানীরা আলো চলাচলের জন্য মাধ্যম হিসেবে ইথার’ নামক একটি অদৃশ্য, ঘর্ষণহীন, রাসায়নিকভাবে নিষ্ক্রিয় এবং ‘সর্বভূতে বিরাজমান’ এক রহস্যময় পদার্থ কল্পনা করেছিলেন। তাদের ধারণা ছিল শব্দ চলাচলের জন্য যেমন মাধ্যমের প্রয়োজন, তেমনই আলো চলাচলের জন্যও একটি মাধ্যম থাকতেই হবে। তারা ধরে নিয়েছিলেন এই পুরো মহাবিশ্বটাই ডুবে রয়েছে ইথার নামক এক অদৃশ্য পদার্থের অথৈ মহাসমুদ্রে। আর এই ইথার নামক মাধ্যমের সাহায্যেই আলো অনেকটা শব্দের মতোই তরঙ্গাকারে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু ১৮৮০ সালে মাইকেলসন-মর্লির বিখ্যাত পরীক্ষা এবং তারও পরে ১৯০৫ সালে আলবার্ট আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ব’ তাত্ত্বিকভাবে ইথারের অস্তিত্বকে নস্যাৎ করে দিল। গন্ধহীন, স্পর্শহীন রহস্যময় ‘ইথার’ ‘অহেতুক বাহুল্য হিসেবে পরিত্যক্ত হলো।
অক্কামের ক্ষুরের ব্যাপকতর প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায় দর্শনেই। নাস্তিক্যবাদী দার্শনিকরা, অক্কামের ফুরের প্রযোগে যুক্তি দেখিয়ে থাকেন, ঈশ্বরের অনুমান নিতান্তই একটি অপ্রয়োজনীয় অনুকল্প। কীভাবে? নিম্নোক্ত দুটি হাইপোথিসিস বা অনুকল্প বিবেচনায় আনা যাক—
১) আমাদের সামনে এক জটিল মহাবিশ্বের অস্তিত্ব রয়েছে, যেটি প্রাকৃতিক নিয়মে (Natural Process) উদ্ভূত হয়েছে। অর্থাৎ,