মুক্তমনাদের বিরুদ্ধে আরেকটা অভিযোগ মুক্তবুদ্ধি, নাস্তিক্যবাদ, মানবতাবাদ এগুলোর চর্চা করে তারা গণবিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছেন। এর জবাবে প্রবীর ঘোষের মতো বলা যায়, যেকোনো অসুস্থ সমাজে সুস্থ সচেতন, যুক্তিবাদী মানুষ বিচ্ছিন্ন হতে বাধ্য। পৃথিবীর ইতিহাসে গ্যালিলিও, প্যারাসেলস, ব্রুনো, বিদ্যাসাগরসহ বহু চিন্তাবিদের নাম উল্লেখ করা যায় যারা প্রত্যেকেই ছিলেন সমাজে একাকী। একাকী ছিলেন আরজ আলী মাতুব্বর বা আহমেদ শরীফও। কিন্তু এইসব বিদ্রোহী মানুষগুলো প্রথাগত স্থবিরতাকে চূর্ণ করতে গিয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন, সেসময়কার বৃহত্তর জনগোষ্ঠী থেকে। সেকালের বিচ্ছিন্ন বিশাল ব্যক্তিত্বদের মূল্যায়ন করার ক্ষমতা ছিল না তৎকালীন মানবগোষ্ঠীর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের এবং মগজ বেচা বুদ্ধিজীবী তকমাধারীদের। আজ সেসব বিচ্ছিন্ন মানুষেরাই হয়ে উঠেছেন এক একজন মহামানব, শ্রদ্ধা, আদর্শ ও প্রেরণার উৎস। যে বিচ্ছিন্নতার অর্থ পচনধরা, কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজকে সংস্কারমুক্ত করা, যে বিচ্ছিন্নতার অর্থ শোষণের অবসানমুখী সংগ্রাম, যে বিচ্ছিন্নতার অর্থ মানুষকে বিজ্ঞানমনস্ক করে সুস্থ সংস্কৃতিতে ফিরিয়ে আনা, সে বিচ্ছিন্নতা অবশ্যই কাম্য। একটা সময় আমরা দেখেছি ইউরোপে সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার অবসানের মধ্য দিয়ে বস্তুবাদের বিকাশ অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছিল। ইতিহাসের পরিক্রমায় আমরা একে একে দেখেছি ভারতীয় লোকায়ত বা চার্বাক দর্শন, গ্রিসের আযোনিয়ার বস্তুবাদী দর্শন, পশ্চিম এশিয়ার মুসলিমদের মোতাজিলা দর্শন, ইউরোপের দার্শনিকদের (বেকন, লক, হবস, হিউম প্রমুখ) ইহজাগতিক দর্শন, ফরাসি বিপ্লব, ইউরোপের রেনেসাঁ এবং উনিশ শতকে রামমোহন, বিদ্যাসাগর, ডিরোজিওদের কল্যাণে বাঙালিদের নবজাগরণ; আমরা সেই ঐতিহ্যের অনুসারী, জাতীয়ভাবে আমরা সহজিয়া, বাউলিয়ানার মতো বিভিন্ন অজ্ঞেয লোকজ মতবাদ, বিভিন্ন সমমনা ইহজাগতিক সংগঠন ও ব্যক্তির যুক্তিবাদী ভাবধারার উত্তরসূরি। ড. অজয় রায়ও ঠিক সেকথাই বলেছেন জাহানারা ইমাম স্মরণ সভায়–
আমরা বিংশ শতাব্দীর বাংলার উদারচেতা পুনর্জাগরণের উত্তরসূরি, ডিরোজিওর চিন্তা চেতনার অনুসারী, আমরা মনে করি শিখা গোষ্ঠীর ঐতিহ্যের ধারক ‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি যেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব’, আমরা আরজ আলী মাতুব্বরের আদর্শের সৈনিক, আমরা বেগম রোকেয়া, লীলা রায়, ফুলরেণু গুহের, সুফিয়া কামালের, জাহানারা ইমামের পথে চলতে প্রত্যয়দীপ্ত….।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস, ধর্মান্ধতা, কূপমণ্ডুকতা আর সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে বিজ্ঞানমনস্ক ও যুক্তিনিষ্ঠ এক প্রজন্ম গড়ে তোলার লক্ষ্যে জনগণের মধ্যে দুর্বার আন্দোলন গড়ে উঠেছে। আমরা ইতোমধ্যেই দেখেছি ভারতে প্রবীর ঘোষের নেতৃত্বে ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি’ সেদেশের যুক্তিবাদী আন্দোলনের ক্ষেত্রে বিরাট সাফল্য অর্জন করেছে। তার সুযোগ্য নেতৃত্বেই ‘যুক্তিবাদী চিন্তা আজ সেখানে ব্যক্তিগণ্ডি অতিক্রম করে আন্দোলনের রূপ পেয়েছে। আন্দোলিত হয়েছে লক্ষ-কোটি মানুষ, আন্দোলিত হয়েছে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, নাট্য সংস্থা, বিজ্ঞান ক্লাবসহ বহু সংগঠন; এরা অংশ নিয়েছে যুক্তিবাদী চিন্তার বাতাবরণ সৃষ্টিতে প্রত্যাশা বেড়েছে অনেক। তৈরি হয়েছে নতুন নতুন প্রতিশ্রুতিশীল লেখক। ইন্টারনেটে তৈরি হয়েছে বহু ব্লগ সাইট। আমাদের দেশে ‘বিজ্ঞান চেতনা পরিষদ’, ‘জনবিজ্ঞান আন্দোলন’, ‘মুক্তচিন্তা চর্চা কেন্দ্র’, ‘বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী কাউন্সিল, সিলেট’, ‘বাংলাদেশ যুক্তিবাদী সমিতি ইত্যাদি বিভিন্ন নামে সংগঠন গড়ে উঠেছে প্রায় একই উদ্দেশ্য সামনে রেখে। কুসংস্কার, ভাববাদ, আধ্যাত্মবাদ, নিয়তিবাদ ও অলৌকিকতা-মুক্ত এক আলোকিত বাঙালি প্রজন্ম গড়ে তুলতে অবদান রেখে চলেছে ‘মুক্তমনা। এদের কারণেই আজকে আমাদের এত বড় প্রাপ্তি। জাহানারা ইমাম স্মৃতি পদক প্রাপ্তির মতো বিরল সম্মান অর্জন। আমরা আর কোনো বাঙালি ওযেবসাইট বা ফোরামের খবর জানি না, যারা সাম্প্রতিক সময়ে এমন সম্মান অর্জন করে নিতে পেরেছে। মুক্তমনা আজ শুধু একটি ব্লগ সাইট নয়, এটি একটি সফল আন্দোলনের নাম। মুক্তমনা শব্দটির ব্যাপ্তি আজ এতই গভীরে, যে বিভিন্ন ফোরাম এবং ব্লগ সাইটে সমমনা প্রগতিশীল লেখকদের আজ ‘মুক্তমনা লেখক হিসেবে অভিহিত করা হয়।
.
নতুন দিনের নাস্তিকতা : নেতৃত্ব দিচ্ছেন ব্লগাররা
শুধু মুক্তমনাতেই নয়, আজকে যেকোনো বাংলা ব্লগে গেলেই মুক্তবুদ্ধির লেখা সমৃদ্ধ বহু প্রবন্ধ চোখে পড়ে। বহু লেখকই ধর্মকে ক্রিটিক্যালি দেখছেন এবং লিখেছেন। আজকে একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে তথ্য যেখানে মুক্ত, সেখানে সত্যিটা যাচাই করে নেওয়া অনেক সহজ। এই কিছুদিন আগেও তথ্যের অবাধ প্রবাহ যখন রাষ্ট্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল তখন এইভাবে বিভিন্ন সাইটে এত বেশি মুক্তবুদ্ধির লেখা সমৃদ্ধ রচনা আমরা দেখি নি। ব্লগারদের উপর সাম্প্রতিক রাষ্টীয়। নিপীডন এবং নির্যাতন প্রমাণ করেছে যে তাদের শক্তিকে আর শাসক-যন্ত্রের পক্ষে খাটো করে দেখা সম্ভব হচ্ছে না।