২. আমরা আন্দোলন গড়ে তুলি শাহরিয়ার কবিরের পক্ষে তার মুক্তির লক্ষ্যে, যখন খালেদা নিজামী সরকার তাঁকে বিমান বন্দরে গ্রেপ্তার করে দেশদ্রোহিতার অভিযোগে। আমরা সফল হই তাকে মুক্ত করতে দেশে বিদেশে গড়ে ওঠা সফল আন্দোলনের গড়ে তোলার মাধ্যমে।
৩. পরে দ্বিতীয়বার শাহরিয়ার কবির, মুনতাসীর মামুন ও সাংবাদিকসহ অনেক অবরুদ্ধ অত্যাচারিত ব্যক্তিদের পক্ষে মানবতার মুক্তির পক্ষে আন্দোলনে নামি এবং এখানেও আমরা সফল হই।
৪. আমরা এককভাবে প্রশিকার পক্ষে’ নেটওয়ার্কে আন্দোলন গড়ে তুলি অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সহযোগিতায়। প্রশিকা মহাপরিচালককে মুক্তি দিতে বাধ্য হন সরকার।
৫. আমরা সাম্প্রদায়িকতার নগ্ন প্রকাশ সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের বিরুদ্ধে সর্বদাই উচ্চকণ্ঠ : আমরা মৌলবাদীদের হাতে মুসলমান বা হিন্দু যে-ই নির্যাতিত হয়েছে তার পক্ষে দাঁড়িয়েছি, মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছি আমাদের সীমিত শক্তি নিয়ে। গুজরাটে আহমেদাবাদের জিঘাংসা বৃত্তিকে আমরা ধিক্কার জানিয়েছি। নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে তাকে অপসারণের দাবিতে আমরা ভারতীয় প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীকে স্মারকলিপি ও প্রতিবাদপত্র পাঠিযেছি, ভারতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সাথে একসাথে কাজ করেছি সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলতে।
৬. একইভাবে ২০০১ সালে খালেদা-নিজামীর লেলিয়ে দেওয়া সাম্প্রদায়িক শক্তি বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের উপর হত্যা, লুণ্ঠন, ঘরবাড়িতে অগ্নি সংযোগ, উপাসনালয় ধ্বংস ও অপবিত্রকরণের যে ঘৃণ্য নিদর্শন স্থাপন করেছে তার বিরুদ্ধে দেশের সেকুলার শক্তির সাথে হাত মিলিয়ে এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছি। মুক্তমনার প্রতিষ্ঠাতা উপদেষ্টা অধ্যাপক অজয় রায় অন্যান্য মুক্তমনা ও। বুদ্ধিজীবীদের সাথে নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী আন্দোলন ‘নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটির ব্যানারে। তারা গঠন করেছিলেন অধ্যাপক জিল্লুর রহমানের নেতৃত্বে ‘গণ তদন্ত কমিশন’, যার প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ২০০২-এর ডিসেম্বরে এবং তাৎক্ষণিক ভাবে আমাদের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী প্রচারিত হয়46। প্রবাসী মুক্তমনার সদস্যরা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিকে প্রতিবাদপত্র প্রেরণ করেন সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে চালিত নির্যাতন বন্ধের দাবিতে। তারা ঘৃণা প্রকাশ করেছেন মৌলবাদী শক্তিকে সরকার প্রশ্রয় দেওয়ায়।
৭. আমরা শুধু তাত্ত্বিক আন্দোলন করি না। আমরা আর্ত মানবতার পাশে পার্থিব ভাবেই এগিয়ে আসি। (ক) সাম্প্রদায়িক ভাবে নির্যাতিত ভোলার অন্নদাপ্রসাদ ও ফাতেমাবাদ গ্রামে ১০০টি পরিবারকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে এগিয়ে এসেছি ‘দৃষ্টিপাত’ নামক আমাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠানের পাশে। এই প্রকল্পে ১০০টি ঘরবাড়ি নির্মাণ, জমি ক্রয় করে দেওয়া, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার ব্যয় ইত্যাদি কর্মকাণ্ডে আমরা সংশ্লিষ্ট ছিলাম। আমরা এসে দাঁড়িয়েছিলাম পূর্ণিমার পাশে, রিতার পাশে, মাধুরীর পাশে, রাজকুমার বাবুর পাশে, নরহরি কবিরাজের পাশে, জনের পাশে, সিতাংশু মরমুর পাশে, ফাতেমার পাশে, মিনতির পাশে- এরা সবাই নরপশুদের পাশবিক অত্যাচারের শিকার।
৮. আমরা সাংবাদিক মানিক সাহার পরিবারের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলাম, তার দুটি কন্যার পড়াশোনা চালিয়ে যেতে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছি। সাংবাদিক বিভুরঞ্জনের পাশে দাঁড়িয়েছি।
৯. দুর্ঘটনা কবলিত মানবতাবাদী শাহরিয়ার কবির, কাজী মুকুল ও তাদের সহকর্মীদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছি যৎসামান্য শক্তি নিয়ে, আমরা ইসলামি মৌলবাদের শিকার হুমায়ুন আজাদের অসহায় পরিবারের প্রতি সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেছি। হুমায়ুন আজাদ ফাউন্ডেশন গড়ে তুলতে সাধ্যমতো সহায়তা করেছি।
১০. ব্রহ্মপুত্রের চরে বন্যাবিধ্বস্ত একটি নিম্ন মাধ্যমিক স্কুল আমরা পুনর্নির্মাণ করেছি এবং আমরা এর পরিচালনার দায়ভার গ্রহণ করেছি। সেখানে মুক্তিযুদ্ধের শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ গড়ে তোলার প্রকল্প গ্রহণ করেছি এবং সে উপলক্ষে কয়েক হাজার স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধার সম্মেলন করেছি এবং স্মৃতিস্তম্ভের শিলান্যাস করেছি।
১১. চোলেশ মিছিলের মৃত্যুর বিচার চেয়ে পিটিশন করেছি, তার পরিবারকে আর্থিকভাবে যথাসম্ভব সাহায্য করেছি।
১২. আমরা পিটিশন করেছি, বক্তব্য রেখেছি কিংবা জনসংযোগ করেছি ভারতে অবৈধ নদী সংযোগের প্রতিবাদে, গুজরাটে মুসলিম জনগণকে নির্বিচারে হত্যার প্রতিবাদে, কানসাটে নিষ্ঠুরভাবে কৃষক-বিদ্রোহ দমনের প্রতিবাদে, জাফর ইকবাল এবং হাসান আজিজুল হককে সাম্প্রদায়িক মহল থেকে মৃত্যু-হুঁমকি দেওয়ার প্রতিবাদে, সি.আর.পি-এর প্রতিষ্ঠাতা ভ্যালেরি টেলরের অপসারণের প্রতিবাদে, কিংবা সালমান রুশদি অথবা তসলিমা নাসরিনের ওপর ফতোয়ার প্রতিবাদে।
এগুলো কি দেশের মানুষের জন্য করা নয়? আত্মপ্রচারণার সুর ধ্বনিত হলেও, আমরা বিনীতভাবেই বলতে চাই মুক্তমনা উপরের সবগুলো কাজই সাফল্যের সাথে করেছে। অতি সম্প্রতি আমরা অসুস্থ প্রবীণ রাজনীতিবিদ এবং সাংবাদিক নির্মল সেনের চিকিৎসার জন্য যথাসম্ভব সাহায্য করেছি[৩৪৭]। সাহায্য করেছি কার্টুনিস্ট আরিফের মায়ের চিকিৎসার জন্যও[৩৪৮]। তারপরও একটি বিষয়ে সতর্ক থাকা প্রয়োজন। যারা যুক্তিবাদী আন্দোলনের মাধ্যমে মানুষের চেতনামুক্তি আর সেই পথ ধরে শোষণমুক্তির স্বপ্ন দেখেন তাদের কিন্তু একটা বিষয়ে সচেতন থাকতেই হবে। উপলক্ষ যেন লক্ষ্যকে ছাড়িয়ে না যায়। কুসংস্কার মুক্তির লক্ষ্যে পৌঁছুতে জনকল্যাণমূলক কাজকর্ম কেবল উপলক্ষই হতে পারে, এ বিষয়ে অতি সচেতনতার প্রযোজনা স্পষ্ট মনে রাখতে হবে এই সত্যটি-জনসেবা করে আর যা ই করা যাক, সমাজব্যবস্থা পাল্টানো যায় না, সার্বিক শোষণ মুক্তি ঘটতে পারে না। শোষণ মুক্তি ঘটতে পারে শুধু সাধারণ মানুষের সচেতনতাবোধ থেকে। সচেতনতাবোধ যেন তৈরি না হয় সে জন্য শোষিতের ক্ষোভ ভুলিয়ে রাখে শাসকশ্রেণী। গরিবের ক্ষোভ ভুলিয়ে রাখতে ধনীর অর্থে চলে ‘দরিদ্র নারায়ণ সেবা।’ দরিদ্র-নারায়ণের সেবাই যাদের কেবল লক্ষ্য তারা আসলে কখনোই চায় না সমাজ থেকে দারিদ্র্য দূর হোক, কেন না দারিদ্র্য দূর নয়, বরং দারিদ্র্যকে পুঁজি করে জনগণের ‘মগজ ধোলাই’ই তাদের অন্যতম লক্ষ্য। এধরনের সেবামূলক কাজে দুয়েকটি দরিদ্রের তাৎক্ষণিক লাভ হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ দারিদ্র্যক্লিষ্ট মানুষের জন্য পড়ে থাকে অনন্ত বঞ্চনাময় জীবন। অর্থনৈতিকভাবে দেশকে স্বাবলম্বী করার চাইতে মগজ ধোলাই করে জনচিত্ত জ্য করার পদ্ধতিটি সফলভাবে কাজে লাগায় বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। সেজন্যই মাদার তেরেসা, রামকৃষ্ণ মিশন, ভারত সেবা সংঘ, তবলীগ জামাত ইত্যাদি নানা সংগঠন নানা কৌশলে জনকল্যাণমূলক কাজের সাথে নিজেদের জড়িত রেখেছে। গড়ে উঠেছে ইসলামি এনজিও কৌশলে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ঠিকমতো দান খয়রাত করলে, জাকাত দিলে দারিদ্র নাকি সমাজ থেকে এমনিতেই দূর হয়ে যাবে। কিন্তু ইতিহাস বলে অন্য কথা। এ ধরনের দান খয়রাত, জাকাত আর সমাজসেবার মাধ্যমে সমাজের শোষণ মুক্তি ঘটেছে এমন একটি দৃষ্টান্তও ইতিহাসে নেই। হাজারটা রামকৃষ্ণ মিশন, সেবা সংঘ, তবলীগ জামাত, হাজারটা মাদার তেরেসা, হাজী মুহাম্মদ মহসিন বাংলাদেশের কিংবা ভারতের জনতার শোষণ মুক্তি ঘটাতে পারবে না। আমরা সমাজসেবার বিরুদ্ধে নই, কিন্তু ‘উদ্দেশ্যমূলক’ জনসেবার মাধ্যমে মগজ ধোলাই করে মানুষকে অন্ধ রাখার অভিসন্ধির বিরুদ্ধে।