মুক্তমনার সবচাইতে বড় অবদান সম্ভবত ইন্টারনেটে (এবং পরবর্তীকালে প্রিন্টেড মিডিয়ায়) বিজ্ঞানমনস্কতার প্রচার প্রসার। অভিজিৎ রায়ের ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ সে উদ্দেশ্যেই লেখা হয়েছিল, পরে এটি বই হিসেবে বেরোয় ২০০৫ সালে। বন্যা আহমেদের ‘বিবর্তনের পথ ধরে সিরিজটিও বই হিসেবে বেরিয়েছে (২০০৭), সেইসাথে বেরিয়েছে ‘মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে (২০০৭)। এছাড়া আরও বেরিযেছে ‘স্বতন্ত্র ভাবনা : মুক্তচিন্তা ও বুদ্ধির মুক্তি’ (২০০৮), এবং ‘সমকামিতা : বৈজ্ঞানিক এবং সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক অনুসন্ধান (২০১০), পার্থিব (২০১১), মানুষিকতা (২০১৩)। প্রতিটি গ্রন্থের উদ্দেশ্য একই। বিজ্ঞানমনস্কতার প্রচার ও প্রসার। বিজ্ঞানমনস্কতা প্রচারের উদ্দেশ্য নিয়ে লিখছেন ফরিদ আহমেদ, শাফায়েত, সিদ্ধার্থ, অপার্থিব, মেহুল কামদার, মীজান রহমান, অনন্ত, তানবীরা, জাহেদ আহমেদ, জাফর উল্লাহ, অজ্য রায়, বিপ্লব পাল, প্রদীপ দেব, আবুল কাশেম, আকাশ মালিক, শিক্ষানবিস, রৌরব, তানভীরুল, পৃথিবী, ইরতিশাদ আহমদ, সংশপ্তক, স্নিগ্ধা, আসিফ মহীউদ্দিন, হোরাস, টেকি সাফি, শফিউল জ্য, সৈকত চৌধুরী, আল্লামালাইনা, রূপম, তামান্না ঝুমু, নিলয়, লীনা রহমানসহ আরও অনেকেই। এ লেখকদের থেকেই উঠে এসেছে ‘যুক্তি’র মতো ম্যাগাজিন, নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে ‘মুক্তান্বেষা’ এবং ‘মহাবৃত্ত’। এই ‘বিজ্ঞানমনস্কতা’ ব্যাপারটি আমাদের কাছে সবসময়ই ভিন্ন অর্থ বহন করে। ‘বিজ্ঞানমনস্কতার প্রসার’ বলতে আমরা এটি বোঝাই না যে গ্রামে-গঞ্জে বিদ্যুৎ পৌঁছিয়ে দেওয়া কিংবা উন্নতমানের বীজ সরবরাহ করা। ওগুলোর প্রয়োজন আছে কিন্তু তা করার জন্য রাষ্ট্র এবং সরকারই আছেন। আমরা বিজ্ঞানমনস্কতার প্রসার বলতে বোঝাই কুসংস্কারমুক্ত, প্রগতিশীল ও বিজ্ঞানমুখী সমাজ গড়ার আন্দোলন। ঢাকা কলেজের প্রিয় শিক্ষক এবং বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের পরিচালক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ভাষায় আমাদের আন্দোলন হচ্ছে ‘আলোকিত মানুষ গড়ার আন্দোলন। বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করলেই সে ‘বিজ্ঞানমনস্ক হয় না, হয় না আলোকিত মানুষ। তাই দেখা যায় এ যুগের অনেকেই বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেও বা বিজ্ঞানের কোনো বিভাগকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেও মনে-প্রাণে বিজ্ঞানী হতে পারেন নি, পারেন নি মন থেকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিকে গ্রহণ করতে বাংলাদেশের এক বিখ্যাত ইসলামি পদার্থ বিজ্ঞানী’ আছেন যিনি একবিংশ শতাব্দীতে এসেও শতাব্দী প্রাচীন ধর্মগ্রন্থের মধ্যে ‘আধুনিক বিজ্ঞানের সন্ধান পান, মহানবীর মিরাজকে ‘আইনস্টাইনের থিওরি অব রিলেটিভিটি’ দিয়ে ব্যাখ্যা করতে চান। ভারতের এক স্বনামধন্য বিজ্ঞানী আবার বেদ আর গীতার মধ্যে ‘বিগব্যাং’ আর ‘টাইম-ডায়ালেশন’ খুঁজে পান। এরা বিজ্ঞান নিয়ে পড়েছেন ঠিকই, চাকরি ক্ষেত্রে সফলতাও হয়ত পেয়েছেন, কিন্তু মনের কোণে আবদ্ধ করে রেখেছেন সেই আজন্ম লালিত সংস্কারগুলো, আঁকড়ে ধরে রেখেছেন যুক্তিহীন ধর্মীয় ধ্যানধারণা। এই ‘বিজ্ঞানী’ তকমাধারী কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষগুলোই বাংলাদেশে বিজ্ঞানমনস্কতার প্রসারে সবচেয়ে বড় বাধা। বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী ‘বিজ্ঞানী’ নামধারী মানুষগুলোর কুসংস্কারের সাথে যেমন আমরা পরিচিত হয়েছি, ঠিক তেমনই আমাদের দেশে আরজ আলী মাতুব্বর বা রঞ্জিত বাওয়ালীর মতো স্বল্পশিক্ষিত, ডিগ্রিহীন, সংস্কারমুক্ত ও যুক্তিবাদী মানসিকতার নির্লোভ মানুষও আমরা দেখেছি। এরাই আমাদের শক্তি।
মুক্তমনাদের বিরুদ্ধে কারো কারো একটি অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায় যে, মুক্তমনারা দেশের মানুষের জন্য খুব বেশি কিছু করে না, যতটা না ঈশ্বর, আধ্যাত্মিকতার বিরোধিতা কিংবা ডারউইন দিবস উদ্যাপনে ব্যয় করে। এ ধরনের অভিযোগ যারা করেন তারা ভুলে যান এ ক’বছরে মুক্তমনাদের সফল প্রোজেক্টগুলোর কথা। হ্যাঁ, মুক্তমনা ঘটা করে ডারউইন ডে, হিউম্যানিস্ট ডে, র্যাশনালিস্ট ডে, আর্থ ডে ইত্যাদি পালন করেছে ঠিকই, কিন্তু যখন প্রয়োজন হয়েছে দেশের মানুষের প্রয়োজনে মুক্তমনা সচেতনভাবেই এগিয়ে এসেছে। অধ্যাপক অজয় রায় সেকথাগুলোই শুনিয়েছেন অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় জাহানারা ইমাম স্মারক সেমিনারে :[৩৪৫]
আমরা শুধু ধর্মান্ধতা আর মৌলবাদের বিরুদ্ধে যুক্তি শোনাই না, আমরা মানবতার সপক্ষে লড়াইয়ে নামি–
১. ব্লাসফেমির বিরুদ্ধে মানবতাকে বাঁচাতে পাকিস্তানের কারাদণ্ড প্রাপ্ত ফ্রিথিষ্কার ড. ইউনুস শাইখকে বাঁচাতে বিশ্বময় আন্দোলন গড়ে তুলি। আমাদের সক্রিয় সহযোগী ছিল ‘IHEU, Rationalist International, Amnesty International, Dhaka Rationalist and Secularist Union এবং ঢাকার মুক্তমনাদের Save Dr. Yunus Shaikh Committee’, যারা রাস্তায় নেমে দিনের পর দিন আন্দোলন, মিটিং, মিছিল, সেমিনার, পথসভা ও পাকিস্তানি দূতাবাসের সামনে প্রেসিডেন্ট মোশাররফের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছিলেন কবির চৌধুরী, বিচারপতি আবদুস সোবহানসহ দেশের খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবী ও প্রগতির পক্ষের মানুষ। আমাদের সাফল্য এসেছিল। পাকিস্তান সরকার তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। বর্তমানে তিনি যুক্তরাজ্যে রয়েছেন এবং আমাদের একজন সক্রিয় সদস্য।