চিন্তার এ দাসত্ব থেকে মুক্ত করার লড়াইযের ময়দানটি একদিনে গড়ে উঠে নি। আজ ইন্টারনেটের কল্যাণে বিশ্বাস এবং যুক্তির সরাসরি সংঘাতের ভিত্তিতে যে সামাজিক আন্দোলন বিভিন্ন ব্লগ কিংবা ফোরামগুলোতে ধীরে ধীরে দানা বাঁধছে, তা আমরা মনে করি প্রাচীনকালের ব্রাহ্মণ-চার্বাকদের লড়াইযেরই একটি বর্ধিত, অগ্রসর ও প্রায়োগিক রূপ। এ এক অভিনব সাংস্কৃতিক আন্দোলন, বাঙালির এক নবজাগরণ যেন। এ নবজাগরণকে রূপ দিতেই আবির্ভাব হয়েছিল মুক্তমনার, প্রথমে ফোরাম হিসেবে, পরে রূপ নিয়েছিল সামগ্রিক একটি ওযেব এবং পরবর্তীকালে ব্লগসাইটে। এর পরের কাহিনি তো ইতিহাস। মুক্তমনার অবদান যে কোথায় পৌঁছে গেছে তার উল্লেখ মেলে জাহানারা ইমাম পদকের স্মারক লিপিতে-’দেশে ও বিদেশে তরুণ প্রজন্মকে সেকুলার মানবিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করণের পাশাপাশি তাদের বিজ্ঞানমনস্ক করার ক্ষেত্রে মুক্তমনা ওয়েবসাইটের জগতে এক বিপ্লবের সূচনা করেছে।
মুক্তমনার আত্মপ্রকাশের ইতিহাসটি ছোট করে জেনে নেওয়া যাক। আরজ আলী মাতুব্বরের দর্শনে অনুপ্রাণিত হয়ে ২০০১ সালে প্রশ্ন আর তর্ক-বিতর্কের মাধ্যমে জ্ঞানার্জনের প্রচেষ্টা এবং ধর্মান্ধতা আর মৌলবাদের বিরুদ্ধে মুক্তমনার প্রাথমিক লড়াই সূচিত হলেও পাশাপাশি পৃথিবী জুড়ে নির্যাতিত, নিপীড়িত মুক্তচিন্তাবিদদের সহযোগী মানবতাবাদী সংগঠন হিসেবে কাজ করার সচেতন প্রয়াস নেওয়া হয়। আসলে মানবিক দিকটি শুরু থেকেই মুক্তমনা কখনোই অগ্রাহ্য করে নি। আমরা খবর পাই পাকিস্তানে ইউনুস শাযিথ নামের এক চিকিৎসক ব্লাসফেমি আইনের শিকার হয়ে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছেন। তার অপরাধ, তিনি শ্রেণীকক্ষে লেকচার দিতে গিয়ে নাকি ছাত্রদের বলেছেন মহানবী হযরত মুহাম্মদ তার নবুওত প্রাপ্তির আগ পর্যন্ত মুসলিম ছিলেন না। পাকিস্তানের মতো ইসলামিক রাষ্ট্রগুলোতে ধর্ম এবং ধর্মপ্রচারক সম্পর্কে সামান্য বিপরীত কথাবার্তা সহ্য করা হয় না। শাস্তি একটাই, মৃত্যুদণ্ড। ইউনুস শায়িখ বন্দি হলেন এবং যথারীতি কারাগারে মৃত্যুর প্রহর গুনছিলেন। মুক্তমনা এই হতভাগ্য ব্যক্তির পাশে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিল। আমরা পিটিশন আর প্রতিবাদলিপির বন্যায় পাকিস্তান সরকারের মেইলবক্স একেবারে ভর্তি করে ফেললাম। আমাদের পাশে এসে দাঁড়ালো আই. এইচ.ই.ইউ এবং জার্নালিস্ট ইন্টারন্যাশনাল। আর অন্যদিকে ঢাকাতে ইউনুস শাযিথের মুক্তি এবং ব্লাসফেমি আইন বিলোপের দাবিতে দাবিতে প্ল্যাকার্ড, পোস্টার হাতে বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন শুরু করলেন ড. অজয় রায়ের নেতৃত্বে অন্যান্য মুক্তমনা সদস্যরা। মুক্তমনার শুভানুধ্যায়ী এবং হোস্ট ড. অ্যালেন লেভিন চারিদিকে নেটওয়ার্ক তৈরি করে মানবতাবাদী সংগঠনগুলোকে উদ্বুদ্ধ ও এক ছাতার নিচে নিয়ে আসলেন। এমনিভাবে বিশ্বব্যাপী মানবতাবাদীদের প্রবল চাপে পাকিস্তান সরকার একসময় গোপনে ড. শাযিথকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়, ড. শায়িখও সাথে সাথে দেশত্যাগ করলেন। ড. শায়িখ ক’দিন পরেই আমাদের সাথে যোগাযোগ করে মুক্তমনাকে তার পাশে থাকার জন্য কৃতজ্ঞতা জানালেন। এরপর তিনি মুক্তমনায় যোগদান করেন এবং বেশ ক’বছর ধরেই মুক্তমনায় লিখছেন।
ড. শায়িখের বিষয়টি মুক্তমনার প্রথম দিককার অন্যতম সফল কাজগুলোর একটি। এটি সফল হওয়ায় আমাদের উৎসাহ অনেক বেড়ে যায়। আমরা ইতোমধ্যেই বহু জায়গায় পিটিশন করেছি। আমিনা লাওয়াল নামের এক মহিলাকে শারিয়ার রজম’ থেকে বাঁচানোর জন্য মুক্তমনা উদ্যোগী হয় এবং শেষ পর্যন্ত সফলও হয়। তারপর থেকে মুক্তমনা আন্তর্জাতিকভাবে নানা ধরনের পিটিশন করেছে, আবেদন করেছে, কখনও প্যালেস্টাইনে নির্বিচারে গণহত্যা বন্ধের দাবিতে, কথনও গুজরাতে গণহত্যার বিচারের দাবিতে, কখনোবা উপমহাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকার রক্ষায, কথনও আওয়ামী লীগের জনসভায় বোমা হামলার নিন্দা করে, কখনও ভারতে নদী সংযোগ প্রকল্পের বিরোধিতা করে, কখনও তথাকথিত ‘বাংলা ভাই কে গ্রেফতারের দাবিতে, কখনোবা কানসাটে গণহত্যা বন্ধের দাবিতে।
বিগত ২০০১ সালের নির্বাচনের পর বিএনপি জামাত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে-যখন সংখ্যালঘুদের ওপর নির্বিচারে অত্যাচার নিপীড়ন শুরু হলো, তখন এর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিকভাবে সচেতনতা তৈরি করতে শুরু করেছিল এই মুক্তমনাই। আসলে শুধু ‘অত্যাচার’ আর ‘নিপীড়ন’ বললে বোধহয় ভয়াবহতার মাত্রাটা বোঝা যাবে না। নির্বাচনের পরবর্তী কয়েক মাসে ঠিক কী হয়েছিল, তা বোঝা যাবে গার্ডিয়ানে প্রকাশিত জন ভাইদালের ‘Rape and torture empties the villages’ (জুলাই ২১, ২০০৩) একটি প্রবন্ধ পড়ে নিলেই। প্রবন্ধটিতে অত্যন্ত মর্মস্পর্শীভাষায় বর্ণনা করা হয়েছে পূর্ণিমা রানীর মতো হতভাগ্যদের ওপর সেসময় কীভাবে গণধর্ষণের স্টিমরোলার চালানো হয়েছিল। শুধু পূর্ণিমা রানীই একমাত্র শিকার নন, ভাইদালের মতে নির্বাচনোত্তর তিন মাসে ৬জনকে ডজন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, অন্তত এক হাজার নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছে আর কয়েক হাজার লোকের জমিজমা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এধরনের রিপোর্ট শুধু গার্ডিয়ানে বা হিন্দুস্থান টাইমসে নয়, পাশাপাশি প্রকাশিত হয়েছিল ডেইলি স্টার, প্রথম আলো, সংবাদ, জনকণ্ঠ, ভোরের কাগজসহ দেশের সকল শীর্ষস্থানীয় পত্রিকাগুলোতে। এমনকি মৌলবাদী আর সরকার সমর্থিত পত্রিকা ইনকিলাব আর সংগ্রামও একেবারে বাদ যায় নি। মুক্তমনার ঢাকা নিবাসী সদস্যরা ‘নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটির ব্যানারে ভোলা জেলায় অন্নদাপ্রসাদ নামের একটি গ্রামে সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করতে গিয়েছিল। তবে পর্যবেক্ষণই শুধু উদ্দেশ্য ছিল না, সেইসাথে কর্মসূচি নেওয়া হয়েছিল যারা সাম্প্রদায়িক নিপীড়নের শিকার হয়েছে তাদের আর্থিক ও মানসিকভাবে সহায়তা প্রদান করা। আমরা দৃষ্টিপাত নামের একটি সংগঠনের সাথে মিলে অন্নদাপ্রসাদ গ্রামের দশটি পরিবারকে আর্থিকভাবে সহায়তা করতে সম্মত হই। সরকার পক্ষ থেকে আমাদের কাজকর্মকে ভালো চোখে দেখা হলো না। বক্তব্য দেওয়া হলো এই বলে যে, দেশের বাইরে এক বাংলাদেশ বিরোধী কুচক্রী মহল’ দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী জনগণকে এ বিষয়ে সচেতন থাকার পরামর্শ দিয়ে বেশ কিছু জ্বালাময়ী ভাষণও দিলেন। রটিয়ে দেওয়া হলো যারা দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার অপচেষ্টায় লিপ্ত আছে তারা হয় ভারতের ‘র’-এর এজেন্ট, নয়ত ইহুদিদের ‘মোসাদ’-এর আর নাহয় আমেরিকার সি.আই.এর! সেসময় অভিজিৎ রায় মুক্তমনায় ‘যুক্তির আলোয় দেশের ভাবমূর্তি এবং দেশপ্রেম’ নামের একটি প্রবন্ধ লেখেন, বাংলায়। সে প্রবন্ধে তিনি তুলে ধরেছিলেন দেশপ্রেমের যৌক্তিক সংজ্ঞা। তিনি বলেছিলেন, দেশ মানে দেশের মাটি নয়, দেশপ্রেম মানে কখনোই দেশের মাটির প্রতি বা প্রাণহীন নদীনালা আর পাহাড়-পর্বতের জন্য ভালোবাসা হতে পারে না। দেশপ্রেম মানে হওয়া উচিত দেশের মানুষের প্রতি প্রেম; লাঞ্ছিত, বঞ্চিত অবহেলিত গণ-মানুষের প্রতি ভালোবাসা। রাষ্ট্রের একটি প্রধানতম উপাদান হলো জনসমষ্টি। এই জনসমষ্টিকে বাদ দিয়ে শুধু কতকগুলো প্রাণহীন নদীনালা, খাল-বিল, পাহাড়-পর্বত আর মাটির প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টিকে আর যা-ই বলা হোক, দেশপ্রেম’ বলে অভিহিত করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। উদ্ধৃতি হাজির করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের, আইনস্টাইনের আর হাল আমলের যুক্তিবাদী প্রবীর ঘোষের; দেখিয়েছিলেন ‘সনাতন দেশপ্রেম’ও শেষ পর্যন্ত কিন্তু একটা ডগমাই। মুক্তমনার অন্যান্য সদস্যরাও এ নিয়ে বিস্তর লেখালেখি করেছেন। দেশপ্রেম নিয়ে মুক্তমনাদের স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে সেসময় সচেতন মানুষ ধীরে ধীরে বুঝতে পেরেছিলেন, কোনো সরকারের অন্ধ আনুগত্যই দেশপ্রেম নয়। দেশে অরাজকতা, হত্যা নিপীড়নের কাহিনি যেকোনো মূল্যে কার্পেটের নিচে পুরে রেখে দেশকে আকাশে তুলে রাখার নামই দেশপ্রেম নয়, বরং অন্যায়ের বিরুদ্ধে দেশের মানুষের বিবেক জাগিয়ে তোলাটাও দেশপ্রেমের অংশ। সংকীর্ণ দেশপ্রেমের সংজ্ঞা থেকে বেরিয়ে এসে যুক্তিবাদী দৃষ্টি দিয়ে দেশের ভাবমূর্তি’ দেখবার এই মানসিকতার উত্তরণ একদিনে হয় নি। এর কৃতিত্ব মুক্তমনারা দাবি করতেই পারেন।